বাসস
  ২৪ জুলাই ২০২৫, ১৯:৫৯
আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২৫, ২০:২৪

ফোন করে বলা হয়, তোমার মাথার দাম ১০ কোটি টাকা : সালাউদ্দিন আম্মার

সালাউদ্দিন আম্মার। ছবি ফেসবুক

রুদ্র আল মুত্তাকিন

রাজশাহী, ২৪ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : সালাউদ্দিন আম্মার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্ট্যাডিজ বিভাগের ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন। বর্তমানে রাবি সংস্কার আন্দোলনের একজন সংগঠক হিসেবে কাজ করছেন। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা বিষয় নিয়ে সরব থাকছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আগে তিনি সিনেমা নিয়ে কাজ করতেন। তখন রাজনৈতিকভাবে খুব একটা সরব ছিলেন না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনই তাকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলে বলে জানান তিনি।

সম্প্রতি জাতীয় বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর রাবি প্রতিনিধি রুদ্র আল মুত্তাকিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তার সম্পৃক্ততা ও আন্দোলনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার নানা দিক তুলে ধরেন সালাউদ্দিন আম্মার। নিচে তার সঙ্গে আলাপের বিস্তারিত তুলে ধরা হলো-

ক্যাম্পাসে আসার পর তার স্বপ্ন কী ছিল জানতে চাইলে সালাউদ্দিন আম্মার বলেন, ‘আমি খুব করে চাইতাম যে সিনেমা নিয়ে কাজ করব, একজন ফিল্মমেকার হব। এই কারণে আমি কয়েকটি জায়গায় কাজ করতাম, কিছু সিনেমায় অ্যাসিস্ট করতে হতো। কিন্তু দূরত্বের কারণে প্রপোজাল পেয়েও রিজেক্টেড হতে থাকলাম। এইভাবে আর চলা যাচ্ছিল না। এর মধ্যেই আব্বু স্ট্রোক করলেন। আমার খরচ আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। তখন আমার একটা চাকরি দরকার হয়ে গেল। আমি একটি কোচিং সেন্টারে মার্কেটিং অফিসার হিসেবে চাকরি নিলাম। সেখানে প্রায় ৩-৪ মাস কাজ করলাম। কিন্তু ওই চাকরির একটা বিশাল রেস্ট্রিকশন ছিল— কোনো একটিভিজমে থাকা যাবে না।’

ক্যাম্পাসের এ্যাক্টিভিটি নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি যেহেতু ক্যাম্পাসে শুরু থেকেই প্যালেস্টাইন মুভমেন্টসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ইস্যুতে একটিভিজমে যুক্ত ছিলাম, তারা বললো, তুমি এক্টিভিজমে থাকতে পারবে না। এতে আমাদের কোচিংয়ের সমস্যা হবে। এই কারণে আমি জুন মাসের প্রথম দিকে যখন হাইকোর্টের রায় আসে, তখন আন্দোলনে খুব একটা অংশগ্রহণ করতে পারিনি। কিন্তু জুলাইতে, ঈদের ছুটির পর যখন আন্দোলন শুরু হলো, তখন আমি কোচিং সেন্টারের পরিচালককে বললাম, আমি আন্দোলনে অংশ নিতে চাই। তিনি বললেন, ‘তুমি চাকরি করবে, না আন্দোলন?’

আম্মার বলেন, ‘তখন আমি বুঝতে পারলাম, আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ২০১৮ সালের আন্দোলনের একটা শিক্ষা আছে, আবার জীবনেরও শিক্ষা আছে। আমি তো সাত-আট বছর ধরে নিজের জন্মভূমিতে যেতে পারিনি। ২০১৭ সালের দিকে যখন জঙ্গিবাদের একটি উপদ্রব ছিল, তখন মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের, কালচারাল এক্টিভিজমে যুক্ত স্টুডেন্টদের সন্দেহভাজন হিসেবে টার্গেট করা হতো। থানায় থানায় নাম দেওয়া ছিল আমাদের মতো ছেলেদের। একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় আমাকে এলাকা থেকে বের করে দেওয়া হয়।'

তিনি বলেন, ‘ওই ঘটনার বিস্তারিত আমি আরেকদিন বলব, ইনশাআল্লাহ। সাত-আট বছর বাড়ি যাওয়া হয়নি। এই যে এক ধরনের যাযাবর জীবন, এর মধ্যে আমার মনে হলো, যে অধিকারগুলো আমরা আদায় করছি, তা আমার জীবনের একটি অ্যাচিভমেন্ট। তালিকাটা ভারী করতে চাই, তাই আন্দোলনটা আমার কাছে ইম্পরট্যান্ট হয়ে দাঁড়ায়।’

‘তাই সকালে গিয়ে কোচিং সেন্টারের পরিচালককে জানিয়ে দিলাম: আমি চাকরি করব না, আন্দোলন করব। তিনি রাগারাগি করলেন। আমি সেখান থেকে চলে এলাম। ওই দিনই ৪ জুলাই আমি আন্দোলন শুরু করলাম। আমি ভাবলাম, আমার সবচেয়ে কমফোর্টেবল জোন যেটা, সেটা অভিনয়, গান, স্লোগান। স্টেজ পারফরম্যান্সের অভ্যাস থাকায় আমি মব কন্ট্রোল করতে পারতাম সহজে। তাই আমরা ৫ বা ৬ জুলাই থেকে বিভিন্ন কালচারাল পারফর্ম্যান্স দিয়ে আন্দোলন শুরু করলাম— গান, পথনাটক, অভিনয়, স্লোগান।’

আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হওয়া নিয়ে সালাউদ্দিন আম্মার বলেন, ‘কিছুদিন পর ১১ জুলাই যারা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন, ছাত্রদের পালস না বোঝার কারণে তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হলো। আগের দিন বৃষ্টিতে ভিজে আন্দোলন করায় আমার জ্বর হয়েছিল। যখন শুনলাম তারা অবাঞ্ছিত ঘোষিত হয়েছেন, তখন আমি সবচেয়ে বেশি হতাশ হয়েছিলাম, কারণ আমি তো চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি— এখানেই কি সব শেষ হয়ে যাবে?’

‘রুমে ফিরে এসে কাঁদলাম। তারপর ভাবলাম, ওনারা না থাকলেও আমরা কেন এগিয়ে যাবো না? আমি দ্বিতীয় সারির নেতৃত্বে থাকা মুনিমুল ভাই, আনোয়ার ভাই এবং অন্যদের সাথে যোগাযোগ করলাম। বললাম, কাল থেকে আমরা আবার আন্দোলন শুরু করবো।’

‘পরদিন ১২জুলাই জ্বর উপেক্ষা করে আবার আন্দোলনে যোগ দিলাম। রেল অবরোধ ছিল আমাদের দায়িত্ব। ওইদিনই একটা দাদু (বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা) বলেছিলেন, ‘আমি একাত্তরের একজন মুক্তিযোদ্ধা, আমি চাই কোটা না থাকুক।’ ওই ভিডিওটা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এটা আমাদের আরও অনুপ্রেরণা দেয়।’

‘পরদিন আমরা আন্দোলনের গ্যাপ রাখলাম এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে বসে সমন্বয় পরিষদ গঠন করলাম। আগের নেতৃত্বের ভুল ছিল কেন্দ্রের (ঢাকার) সঙ্গে কোনো সমন্বয় না করা। কেন্দ্রীয় ব্যানার ছিল ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’, আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যানার ছিল ‘কোটা পদ্ধতি সংস্কার আন্দোলন’। এ কারণে যোগাযোগের অভাব ছিল।

‘আমরা ঠিক করলাম এবার কেন্দ্রের সঙ্গে কানেক্টেড থাকবো। প্রায় ১৭-২০ জন শিক্ষার্থীর একটি প্রতিনিধিত্বমূলক তালিকা তৈরি করলাম—মাস্টার্স থেকে শুরু করে প্রথম বর্ষ পর্যন্ত। এরপর ঢাকার কর্মসূচিগুলো ফলো করা শুরু করলাম।’

তিনি বলেন, ‘পরের দিন ১৪ জুলাই ছিল রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান। আমরা ডিসির কাছে স্মারকলিপি দেব বলে ঠিক করলাম। ডিসি অফিস যে ১৩ কিমি দূরে, এটা আমাদের জানা ছিল না—আমরা ভেবেছিলাম ৫-৭ কিমি। কিন্তু তখন স্টুডেন্টদের স্পিরিট এমন ছিল যে ১৩ কিমি হেঁটে যেতেও কেউ পিছু হটেনি। আমি সবসময় বলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জাগানো সহজ, কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জাগানো কঠিন। কিন্তু একবার জেগে উঠলে চেঞ্জ আসবেই। সেই জুলাইয়ের গরমে, প্রচণ্ড রোদে মেয়েরাও আমাদের সাথে হাঁটলো। রুয়েট, রাজশাহী কলেজ, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও স্টুডেন্টরা যোগ দিলেন। আমরা প্রায় ২-৩ হাজার মানুষ স্মারকলিপি দিতে গেলাম।’

‘সবাই তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্দোলনের কেন্দ্র হিসেবে দেখছিল, ইগো প্রবলেম ছিল না। তারা বলতো—ওদের ইউনিভার্সিটিতে একটা আন্দোলন হচ্ছে, আমরা সংহতি জানাতে যাচ্ছি। আমরা ফোনে বলতাম, ‘আসেন, একসাথে থাকলে ছাত্রলীগ কিছু করতে পারবে না।’ সেইদিন আমরা পায়ে হেঁটে স্মারকলিপি দিলাম।

তারপর সেই কালজয়ী রাত! খুনি হাসিনা আমাদের রাজাকার বললো!’

‘মেয়েদের হলের তালা ভেঙে, ছেলেদের হল থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী স্লোগান দিতে থাকলাম আমরা ওই রাতে-

‘তুমি কে? আমি কে?/রাজাকার! রাজাকার!!/কে বলেছে? কে বলেছে?/স্বৈরাচার! স্বৈরাচার!!/চেয়েছিলাম অধিকার,/হয়ে গেলাম রাজাকার!

পরদিন ১৫ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কোনো কর্মসূচি ছিল না। তখন সারা দেশেই তোলপাড়—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হামলার শিকার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও তাই।

১৬ জুলাই যেদিন ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগ পালাতে বাধ্য হয় সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে সালাউদ্দিন আম্মার বলেন, ‘১৬ জুলাই হলো সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট যদিও এটা ধরে রাখতে পারিনি ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেওয়ার কারণে। তো ওইদিন এগুলো নিয়ে যারা আছে সবার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছি।’

‘ওইদিন শিবির আমার সাথে প্রথম যোগাযোগ করে। আনুমানিক সাড়ে ৭টার দিকে ছাত্রশিবিরের তখনকার সাংগঠনিক সম্পাদক মুজাহিদ ফয়সাল ভাইয়ের কাছ থেকে কল আসলো। উনি আমার বিভাগের বড় ভাই এজন্য আমি ওনার সাথে দেখা করলাম। আমি তখন বুঝিনি— এনএসআই, সিটিএসবি কীভাবে ট্র্যাক করতে পারে। পলিটিক্যাল আইডিয়া বা নিরাপত্তা বোধ তখনও স্পষ্ট ছিল না। শুধু আত্মবিশ্বাস ছিল।’

‘মুজাহিদ ভাই বললেন, ‘আপনি এখানে নিরাপদ না, এনএসআই যেকোনো মুহূর্তে আপনাকে তুলে নেবে। আপনি আমার সঙ্গে আসেন।’ তিনি তখন শিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদক, এখন সাধারণ সম্পাদক। তিনি আমার ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই। রুমমেট সাব্বির ভাই বললেন, ‘যাও, সমস্যা নাই।’’

‘আমি একটু ভয় পাচ্ছিলাম। তার সাথে গেলে আমি ‘শিবির ট্যাগ’ খেয়ে যাবো না তো? আন্দোলনটা নষ্ট হয়ে যাবে না তো? পরিচালক বললেন, ‘না, সমস্যা হবে না।’ তখন আমি শুধু দুইটা প্যান্ট, একটি টি-শার্ট আর চার্জার নিয়ে বের হয়ে গেলাম।’

‘আমাকে শিবিরের ভাইয়েরা খুব কৌশলে একটি অজানা জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলো এবং এমন এক জায়গায় রেখেছিলো, যেটা আমি চিনতাম না। একটা টিনের ঘর। তবে ওই বাসার মানুষজন যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন। ওখানে আমাকে রেখে তারা চলে যায়।’

‘রাতে  আমি ওখানে পৌঁছে মোকাররম ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। তিনি তখনো রাবিতে ছিলেন। আমাদের পরদিন মুভ করতে হবে— এই চিন্তায় আমরা কিছু জিআই পাইপ কিনতে বলি ভাইকে। ওরা যেহেতু আমাদের ওপর হামলা করতে পারে, আমাদেরও কিছু প্রস্তুতি রাখার চিন্তা থেকে। আমরা ক্রাউডফান্ডিং করে পাইপ কিনে তার সাথে পতাকা টাঙিয়ে দিতে বলি ভাইকে, যাতে কেউ এটাকে নেতিবাচকভাবে প্রচার করতে না পারে।’

শিবিরের ভাইয়েরা বলছিল, ‘আপনি এখন একা আছেন নেতৃত্ব দেওয়ার মতো। আপনাকে সাসটেইন করতে হবে। আমরা যখন বলবো, তখন আপনি বের হবেন।’ দুই-তিনজন ভাই, যাদের দায়িত্বে দিয়েছিলো শিবিরের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক, তারা আমাকে নিরাপদে নিয়ে যেত এবং ফিরিয়ে আনতো।

আম্মার জানান, তখন তাকে রাজশাহীতে নিরাপত্তা দেওয়ার মতো তেমন কেউ ছিল না। তাই তাকে অনেকটা গোপনে, সাবধানে চলাফেরা করতে হতো। এবং তাদের কমান্ড অনুযায়ী চলতে হতো যদিও এই কৌশলের কারণে তাকে অনেক বিপদে পড়তে হয়েছিল। 

তিনি বলেন, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠে বুঝতেই পারছিলাম না, কোন দিকে গেলে মূল রাস্তায় বের হতে পারব। বিকাল ৩টায় আমাদের কর্মসূচি ছিল, আর তখন ৩:৩০ বাজে।’

‘আমি তখন গোসল সেরে নামাজ পড়লাম। একা থাকায় আত্মবিশ্বাস কিছুটা কমে যাচ্ছিল। অনেককেই ফোন দিচ্ছিলাম কিন্তু কাউকে রিচ করতে পারছিলাম না। মাথা ঘুরতে লাগলো, বুঝতে পারছিলাম না, কী করব। ওই সময় মোকাররম ভাই শহরে গিয়েছিলেন পাইপ কিনতে। তিনি অটোতে করে পাইপ আনছিলেন। শহরে তো ছাত্রলীগের ঘাঁটি! সব মিলিয়ে মাথা কাজ করছিল না।’

তিনি আরও বলেন, ‘১১টার দিকে শিবিরের আব্দুল্লাহ ভাই এবং জনি ভাই এলেন। আমাকে বাইকে করে নিয়ে গেলেন। আমাকে মাস্ক পরিয়ে, অন্য একটা টিশার্ট ও ক্যাপ পরিয়ে তারা নিয়ে গেলেন। আমি গিয়ে দেখি, হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিনোদপুর থেকে বের হয়ে মেইন গেইটের দিকে আসতেছে। আমি বিনোদপুর গেইটের কাছে তাদের সাথে যুক্ত হলাম।’

আম্মার জানান, ‘ওইদিন আমি কল্পনাও করতে পারিনি, এতো মানুষ হবে! অথচ ছাত্রলীগ হামলা করার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল। আমরা ওই মিছিলটা নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ঢুকে মেইন গেট দিয়ে মেয়েদের হলের দিকে যাচ্ছি—মেয়েরা তখন মিছিলে যোগ দিলো। বিশাল একটা ক্রাউড! আমরা একেবারে জিয়া হলের সামনে দিয়ে, সিলসিলার সামনে দিয়ে বঙ্গবন্ধু হলের দিকেও গেলাম।’

‘সেখানে গিয়ে দেখি, এই বিশাল মিছিল কন্ট্রোল করা সম্ভব না! যতটুকু সম্ভব, ততটুকু কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলাম। এরপর আমরা আবার ঘুরে মেইন গেটের দিকে গেলাম। তখনো স্টুডেন্টদের মনের ক্ষোভ মেটেনি। তারা পুরো ক্যাম্পাসকে ছাত্রলীগমুক্ত করতে চায়। এমন একটা পরিবেশ, আর আমি একা। আমি তখন একদমই প্রস্তুত ছিলাম না।’

‘২০-২৫ হাজার স্টুডেন্ট- মিছিলের শুরু কোথায়, শেষ কোথায় বোঝা যাচ্ছিল না। আমি একা একটা মাইক হাতে দাঁড়িয়ে আছি। সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না, কী করব। আশপাশে একজন সিনিয়র ভাইকে খুঁজছি। আমি আসলে কী সিদ্ধান্ত নেব, বুঝতে পারছিলাম না। কারণ তখন ক্যাম্পাসে আমি অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে ছিলাম— একবারে শিশু! এমন একটা মুহূর্তে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।’

তখন অধিকাংশই বলছিল, আমরা আবার হলের দিকে যাব। তাদের বললাম, ‘ঠিক আছে, চলেন হলের দিকে যাই।’ হলের দিকে রওয়ানা হতেই শুরু হলো দ্বিতীয় দফা অভিযান। প্রত্যেকটা হলের সামনে ৫-১০ মিনিট করে থেমে রুমগুলো একে একে ছাত্রলীগমুক্ত করতে থাকলো ছাত্ররা। এরপর আমরা লতিফ হল, আমির আলী হলসহ সব হল প্রদক্ষিণ করে, শেষে বিনোদপুর দিয়ে আবার মেইন গেটে অবস্থান নেই।’

‘মেইন গেটে অবস্থান নেওয়ার পর প্রথম যেটা শুনলাম, সেটা হলো— আবু সাঈদ ভাই শাহাদাত বরণ করেছেন। আবু সাইদ ভাইয়ের শাহাদাতের ঘোষণা দিতে গিয়েই শুনি, ওয়াসিম ভাইও শহীদ হয়েছেন। ১৬ জুলাই কর্মসূচি শেষ করে আমাকে শিবিরের ভাইয়েরা ওই বাসা থেকে আরেকটা বাসায় নিয়ে যান।’

ইন্টারনেট শাটডাউনের সময়টার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমরা তখন চিন্তা করলাম, ১৮ জুলাইয়ের পর থেকে যেহেতু নেট অফ, ইন্ডিয়ান সিম ব্যবহার করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আমি বললাম, ‘ভাই, কিছু যদি করার থাকে, এখন আমাদেরই করতে হবে। অন্য কেউ পারবে না।’’

১৮ জুলাই সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি ফেইসবুকে লিখলাম : ‘বাংলাদেশ ভালো নেই। আমার বন্ধু পারভেজ শাকিল ইতিমধ্যে শাহাদাত বরণ করেছে। আমার ছোট ভাই রাহাত— তার দুই চোখই গুলিবিদ্ধ। এখন যেটুকু করার আছে, তা প্রবাসীদেরই করতে হবে।’ তারপর অস্ট্রেলিয়ায় আমার বন্ধু মাসুম, লন্ডনে সিয়াম, জাপানে তাজবীর—ওদের সঙ্গে আমি কনফারেন্স কল করলাম। ওরা কথা বলার সময় হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। বলল, ‘বাংলাদেশের কী অবস্থা! মা-বাবার খবর পাচ্ছি না, কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না।’ আমি বললাম, ‘দেখ, এখন যা করার, তোরাই করতে পারবি। আমরা তো যে রাস্তায় বের হচ্ছি, সেখানে লাশ পড়ছে—এর কোনো হিসাব নেই।’ তাজবীর বললো, ‘ঠিক আছে ভাই, কালকে আমরা দূতাবাস ঘেরাও করব।’ লন্ডনের এক ভাই তাওহিদ ভাই, আমেরিকায় থাকা এক আপু—অনেকেই এগিয়ে আসলেন।’

আম্মার বলেন, ‘অজানা কিছু ভালোবাসা আছে, যা সেই সময় আমাদের কাছে বিশাল ব্যাপার ছিল। সাবেক ভাই-বোনেরা খবর নিচ্ছেন, খোঁজ রাখছেন। লন্ডনে কর্মসূচি ঘোষণা হলো—দূতাবাস ঘেরাও করা হলো, হাইকমিশন ঘেরাও করা হলো। জাপানে আমার বন্ধু তাজবীর আন্দোলন শুরু করলো। সব জায়গায় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত যে সময়টা গেলো—পুরোটাই ছিল এক ভয়াবহ চাপের সময়। এই পুরো সময়টাতে প্রবাসীরাই আমাদের সাহস যুগিয়েছেন। অনেক প্রবাসী ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমি রেমিট্যান্স পাঠাব না। আমি সরকারকে গুলি কিনতে সহযোগিতা করব না।’ এই সময়েই বাংলাদেশের অর্থনীতি একটা নিম্নগামী অবস্থায় পড়ে যায়। তারপর আস্তে আস্তে আমরা ফোনে কথা বলা শুরু করলাম—অফলাইনে যোগাযোগ। জেলার সঙ্গে ভালো একটা সমন্বয় তৈরি হল। এই সময়েই, ১৭ তারিখের দিকে ক্যাম্পাস একেবারে ফাঁকা হয়ে যায়।’

এর পর তিনি বলেন, ২৪ জুলাই, মোকাররম ভাই, মুনিমুল ভাই, তপু ভাইকে ডিজিএফআই জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায়। তাদের দিয়ে বিবৃতি আদায় করানো হয়: ‘আমরা আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছি, এই আন্দোলন এখানেই শেষ।’ তখন আমি ফেসবুকে লিখলাম: ‘আন্দোলন থেকে কেউ সরে দাঁড়ায়নি।’

‘যতক্ষণ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি টিম তৈরি করতে না পারছি, ততক্ষণ পর্যন্ত ভাববো যদি সবাই মিলে সরেও যায়—আমার জন্য আন্দোলন শেষ হয়নি।’ ওই পোস্টটা সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে গেল। রাজশাহী শহরের যতগুলো প্রতিষ্ঠান আছে, সবাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলো। ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে গেলেও আমরা ১৭ জুলাইয়ের পর থেকে বাইরে থেকেই আন্দোলনের কাজ শুরু করলাম। আমি তখন ভাবলাম, একটা সমন্বয়ক পরিষদ দরকার।’

সালাউদ্দিন আম্মার স্মরণ করেন, ‘সার্জিস ভাইয়ের সঙ্গে আমি ওইদিন প্রথমবার যোগাযোগ করি। বললাম, ‘আসলে একটা সমন্বয় পরিষদ গঠনের প্রয়োজন আছে। কী করা যায়?’ সম্ভবত তখন ইন্টারনেট এক-আধটু পাওয়া যাচ্ছিল। ৯ দফা দাবিগুলো তখন ফোনেই টাইপ করা হয়েছিল। তারপর আমি সবাইকে ফোন দিলাম— ‘তোমরা সমন্বয় পরিষদে থাকো।’ কিন্তু তখন কেউ নেই। সবাই বলছে, ‘আমার পরীক্ষা আছে, আমার সংসার আছে, আমি পরিবারের একমাত্র সন্তান, আমার দায়িত্ব আছে... আরও কতো কী!’

‘এভাবেই চলতে থাকলো। তখন থেকেই আমরা সমন্বয়ক খোঁজা শুরু করলাম। আর মনে মনে ঠিক করলাম, যদি আবার কিছু করি, সেটা রাজশাহী থেকেই শুরু করব। এরপর ২৮ তারিখের দিকে ইন্টারনেট সংযোগ খুলে দেওয়া হলো। তখন এক ধরনের গুঞ্জন উঠল, আন্দোলন বিক্রি হয়ে গেছে। সরকার নাকি কোটা সংস্কারের দাবি মেনে নেবে এবং সবাই যে যার মতো ফিরে যাবে।’

‘ইতিমধ্যে আমাদের শত শত ভাই-বোন শাহাদাত বরণ করেছে। তখন তো এটা আর সাধারণ কিছু ছিল না—এটা তো রক্তের ওপর দিয়ে গিয়েছিল। এটা এমনভাবে শেষ হতে পারে না! আমি তখন কাউকে ফোনও দিতে পারছিলাম না।’

তিনি বলেন, ‘২৮ তারিখে যখন শুনলাম আন্দোলন বিক্রি হয়ে যেতে পারে, তখন বুঝলাম এটা ঠেকাতে কিছু একটা করতেই হবে। ২৯ তারিখে কারফিউ জারি হলো। তখন আমরা ভাবলাম, কারফিউ ব্রেক করাটা জরুরি। এদিকে মাইকিং চলছে: ‘কেউ বের হলে রাষ্ট্রীয়ভাবে গুলি করার অনুমতি আছে। আমরা সাহস করে বেরিয়ে এসে বিনোদপুর রেডিও-বেতার মাঠে, গাছের নিচে বসলাম। বসে স্যারদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম—কখন তাঁরা আসবেন। ওই সময় দুটো জিনিস সবচেয়ে বেশি সাহস জুগিয়েছিল: এক আমাদের প্রিয় শিক্ষকরা, দুই হলো মিডিয়া। কারণ মিডিয়া থাকলে মনে হতো—আমাদের যদি মেরেও ফেলা হয়, সবাই জানবে। এবং সেটা আরও একবার আন্দোলনকে উজ্জীবিত করবে। আমরা চাই না কেউ আমাকে গুম করে ঘরের ভেতর মেরে ফেলুক!’

‘এরপর সালেহ্ হাসান নকীব স্যার, ইফতেখার আলম মাসুদ স্যারসহ আরও কয়েকজন শিক্ষক এলেন। তাঁরা বক্তব্য দিলেন। মেহেদী সজিব ভাইও বক্তব্য দিলেন। তখন আমরা স্যারদের অনুরোধ করলাম: আমাদের একটা ছোট করে মানববন্ধন করতে দিন।’

ওনারা কিছু বলার আগেই সেনাবাহিনীর প্রায় ২০০-৩০০ জন সদস্য আমাদের চারপাশ ঘিরে ফেলল, তার ওপর পুরো আরএমপি’র পুলিশ, নতুন গার্ড, আনসার—সব মিলিয়ে বিশাল বাহিনী। আমরা মাত্র ৮০ জন। সে তুলনায় প্রশাসনের বাহিনী কমপক্ষে ১০০০ জন। তবু আমরা স্লোগান দিলাম। ওরা কল্পনাও করতে পারেনি আমরা কী স্লোগান দেব! হঠাৎ মাথায় এল: ‘শেইম শেইম ডিক্টেটর!’ আমরা সেই স্লোগান দিলাম। ওখান থেকে স্লোগান দিতে দিতে বিনোদপুর পর্যন্ত এলাম। এই স্লোগানটা ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করেছিলেন পিনাকী ভট্টাচার্য। তিনি তখনই এটি নিয়ে পোস্ট করলেন। এরপর বিষয়টা সারাদেশে ছড়িয়ে গেল। নিউজ হতে শুরু করল: ‘তৃতীয় দফা আন্দোলন শুরু হয়েছে!’ প্রথম দফার আন্দোলন তো আগেই শেষ হয়েছিল।’

দ্বিতীয় দফা চালু করেছিল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, এবং তৃতীয় দফা মানে ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নতুন জাগরণ। কষ্টের বিষয় হলো—এই ইতিহাসটাকে বলা হয় না। আমি জানি না, এটা ভবিষ্যতে ইতিহাসে স্থান পাবে কি না। কিন্তু ২৯ তারিখে যেভাবে ৮০-৮৫ জন মানুষ শহর থেকে, এবং রাজশাহী থেকে এসেছিল, কিছু শিবিরের ভাই-ব্রাদাররাও ছিলেন, সব মিলিয়ে আন্দোলনটাকে পুনরুজ্জীবিত রাখা হয়েছিল। কিন্তু এটা কখনো স্বীকার করা হয় না—রাজশাহী করেছে। কিন্তু ২৯ তারিখের পরে ৩০ ও ৩১ তারিখে কিছুটা ‘সফট’ কর্মসূচি দেওয়া হলো। ৩১ তারিখে আমাদের শিক্ষকদের একটি কর্মসূচি ছিল—তাঁরা লাল কাপড় বেঁধে ক্যাম্পাসে একটি মৌন মিছিল করবেন।

ক্যাম্পাসে বাইরের যারা ছিল, যেমন স্কুল-কলেজের পোলাপান— তাদের বললাম আসতে। ওদের ভূমিকা ছিল বিশাল। আমি জানি না, ওদের জন্য কিছু করা হয়েছে কি না। কিন্তু ওরা এসেছিল, এবং ওরা ভেবেছিল ওখানে দাঁড়াবে, শিক্ষকদের পাশে থাকবে। তারা শিক্ষকদের কাছে গিয়েছিল, আমি তখন ওদের সঙ্গে ফোনে ও মেসেঞ্জারে কথা বলছিলাম,আমি বুঝিয়ে বলছিলাম কী করতে হবে। একপর্যায়ে, হঠাৎ করে ডিবি এসে হামলা চালায়। কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যেতে শুরু করে। তখন আমাদের শিক্ষকদের যে ভূমিকা ছিল ঠিক যেন জোহা স্যারের সেই সময়কার প্রতিরোধের অনুভূতি আমরা ওইদিন পেয়েছিলাম। তাঁরা রীতিমতো যুদ্ধ করে ছাত্রদের ছাড়িয়ে নিচ্ছিলেন।

৩ আগস্ট, একেবারে একটি ক্রুশ্যাল মুহূর্ত। আমি আম্মুকে অনেকদিন পর, প্রায় ১৫-২০ দিন পরে ফোন দিলাম। আমার সঙ্গে আম্মুর কোনো যোগাযোগ ছিল না, তবে উনি আমার ২-৩ জন বন্ধুদের মাধ্যমে আমার খবর নিচ্ছিলেন। ওরা—যেমন মহিমা—আমার জামাকাপড় পরিষ্কার করতো, আমার সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট—সব কিছুই ওর কাছে ছিল। আমার বন্ধু মাহমুদ পুরো সময় এখানে ছিল। সানজিদাও ছিল। ওদের সঙ্গেই আম্মু সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন। আম্মুকে কল দেওয়ার পর বুঝলাম—তিনি প্রায় আশা ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ তখন আম্মু-আব্বুকে ৭ দিন ধরে বাসার ভেতরে আটকে রেখেছিল স্থানীয় প্রশাসন।

তাঁদের বাইরে বের হতে দেওয়া হয়নি। ৫ আগস্টে আমাদের এলাকার সেই চেয়ারম্যানকে সবাই মিলে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে (আল্লাহ তাকে মাফ করে দিন)। আমার আব্বু ব্রেনস্ট্রোকের রোগী। তিনি তখন মানসিকভাবে খুব খারাপ অবস্থায় ছিলেন। বাসার চাল-ডাল পর্যন্ত শেষ হয়ে গিয়েছিল। চেয়ারম্যান আম্মুকে বারবার বলছিলো—‘আগে তোমাদের ছেলেকে এনে দাও। আগে ছেলেরে ফোন দাও!’ আব্বু একেবারে অসহায়, সহজ-সরল মানুষ। তাকে ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল, মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন।

তখন আম্মুও কঠোর হয়ে গিয়েছিলেন। যখন স্বামীকে নির্যাতন করা হচ্ছে, তখন তিনি যেন একেবারে পাথর হয়ে যান। তিনি বলেন— ‘ঠিক আছে, তোমাকে আমি আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিলাম। আল্লাহ যদি চান, তোমাকে শহীদ হিসেবে কবুল করবেন।’

আমি আম্মুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, কাফনের কাপড় পরে বেরিয়ে গেলাম। ৩ আগস্ট, আমরা শুধু ‘শেখ হাসিনা গদি ছাড়’ -এই স্লোগান দিতে দিতে ভদ্রা পর্যন্ত গেলাম। তো ভদ্রা থেকে ফিরে এলাম। আসলে, রক্ত এড়িয়ে চলতে চাইছিলাম আমরা, কারণ বিনা রক্তপাতে কতটুকু যাওয়া যায়—এই চেষ্টাটাই আমাদের ভেতরে ছিল।

৩ আগস্টে ফিরে এলাম। এইভাবেই, ভেজা কাফনের কাপড় নিয়ে ফিরে এলাম। এরপর আবার ৪ আগস্টের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ৪ আগস্টের কর্মসূচিও ঘোষণা করে দিলাম।

৪ আগস্ট, সব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘একজোট’ নামে একটা গ্রুপ করলো কলেজের শিক্ষার্থীরা। আবার ১৫-২০ হাজার মানুষ চলে এলো। কাফনের কাপড় পরেছি। আমার নিজের স্যাররাও আছেন। তাঁরা আমাকে বললেন—‘সামনের সারিতে যেও না।’ আমি তো বাসা থেকে বিদায় নিয়ে এসেছি। তাই আমি একেবারে সামনের রিকশাতেই। ওইদিন আমরা রেলগেট পর্যন্ত গিয়েছিলাম। আমার মনে হয়, আমরা প্রথম দিন রেলগেট পর্যন্ত গিয়েছিলাম, পরের দিন ভদ্রা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। এলোমেলো হতে পারে। তো ওই দিন যখন গেলাম, দেখলাম মাঝখানে কিছু ছাত্রলীগের কর্মী ঢুকছে। তারা খুবই বিধ্বংসী। তারা হামলা করছে এবং বলছে—‘আমরা নিউ মার্কেটে যাবো।’ কারণ, নিউ মার্কেটের ওদিকেই অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে সন্ত্রাসীরা বসে আছে—এই খবর আসছে আমার কাছে।

আমি নিউ মার্কেট এভয়েড করতে চাইছিলাম। ওরা দুইটা কথা বলছে—একটা, হয় নিউ মার্কেট যাইতে হবে, না হলে থানায় ভাঙচুর করতে হবে। দুইটাই বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত। মানে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। মতিহার থানা যদি ভাঙচুর হয়, ওদের তো অর্ডার আছে—গুলি করতে বাধ্য হবে। তখন হঠাৎ করে, আমরা ফার্স্ট রিকশায় ছিলাম। হিউজ ক্রাউড। দুই-তিনটা রিকশায় মাইক ছিল। ফার্স্ট রিকশায় আমি এবং মেহেদী সজীব ভাই। আমরা বললাম—‘আমরা তালাইমারী রুয়েট গেটে অবস্থান নেব।’

হঠাৎ করে মেহেদী সজীব ভাই বললেন—‘আমরা আমাদের কর্মসূচি এখানেই শেষ করছি।’ আমি বললাম—‘আপনি কর্মসূচি শেষ করছেন, কিন্তু এখনও পেছনে হাজার হাজার মানুষ! ওদের কী হবে?’ 

শিবিরের ভাইয়েরা আমাকে রিকশা থেকে নামিয়ে নিয়ে গেল। এখন যেহেতু ওনারা চেইনে আছেন, সেহেতু যেতে হবে। আমি আর কিছু বলতেও পারছিলাম না, কারণ তাদের নিরাপত্তায় আছি। আমাকে নিয়ে ওরা রুয়েট গেটের সামনের পাম্পে রাখল। যেমনটি আশঙ্কা করেছিলাম, সেইটাই হলো। পুলিশ হামলা শুরু করলো। স্বাভাবিকভাবে, এই জিনিসগুলো আমি চাইনি।’

আম্মার বলেন, ‘আমার কিছু কিছু আক্ষেপ আছে যে, আমি কেন জোহা চত্বরে যেদিন হামলা হলো, সেদিন থাকতে পারলাম না! আসলে আমাকে বাধ্য হয়ে যেতে হয়েছিল। যাই হোক, সেদিন রুয়েটের অনেক বোনকে ছাত্রলীগ আটকিয়ে রাখলো, হামলা করলো। তারা আমাকে ফোন দিচ্ছে, আমি কিছুই করতে পারছিলাম না। পরে আমি শিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদককে প্রথমবারের মতো বললাম, ‘ভাই, আপনারা কাজটা ভালো করেননি।’

ওইদিন রাতে আমার বিরুদ্ধে প্রচুর লেখালেখি হলো। ‘গাদ্দার’, আরও কত কিছু! সেদিন না গিয়ে একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। না হলে ওরা মব করে থানায় হামলা করতো, নিউ মার্কেটে হামলা করতো। ১০-২০টা লাশও পড়তে পারতো। এটা সবাইকে বলে বোঝানো যাবে না! সেদিন সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি। সেদিন তাহাজ্জুদ পড়ে মনে মনে বললাম: আল্লাহ, আমাকে যেন কেউ অবাঞ্ছিত না করে, অসম্মানিত না করে, কারণ তুমি তো পুরোটা জানো। আল্লাহ দোয়া কবুল করলেন।

লং মার্চের দিন নিয়ে সালাউদ্দিন আম্মার বলেন, ‘তারপর লংমার্চের আগের দিন একটা কল আসলো। ফোনের ওপাশ থেকে বলল, ‘সালাউদ্দিন, তোমার মাথার দাম ১০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। যেকোনো মূল্যে স্নাইপার দিয়ে তোমাকে শুট করা হবে। তুমি সামনের রিকশায় যেও না।’

‘যেহেতু এক দফার ঘোষণা চলে এসেছে, সেহেতু নিউ মার্কেট যেতেই হবে। ওখানেই গুলি হতে পারে। অনেকে বলল, বাস নিয়ে ঢাকা যাবে। কিন্তু রাজশাহীর যে স্বতন্ত্র ইতিহাস আছে, সেটা ধরে রাখতে হলে আমাদেরকে রাজশাহীতেই থাকতে হবে। আর বাস নিয়ে গেলে পথে হামলা হতে পারে—এসব ভেবে আমরা যাইনি। তখন তো কে বাম, ছাত্রদল, শিবির—এসব ছিল না। আমরা সবাই সেদিন বের হলাম। রাজশাহী কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, রুয়েট—সব জায়গায় যোগাযোগ করে একত্রিত হলাম। নিজ নিজ জায়গা থেকে সবাই সর্বোচ্চটা করছে।’

‘যখন শাহ মখদুম কলেজের সামনে গেলাম, হামলা শুরু হলো। হামলা শুরু হতেই, আমি যেহেতু রিকশার হুডের ওপর থেকে স্লোগান দিচ্ছিলাম, সেখান থেকেই চোখ বন্ধ করে ভাবছিলাম—এই বুঝি কোনো ছাদ থেকে গুলি এসে আমার মাথায় লাগে! হঠাৎ করে আলী রায়হান ভাই (রাজশাহীর দ্বিতীয় শহীদ) আমার হাত ধরে টান দিয়ে নামিয়ে ঘিরে ধরলেন। তারপর বড় রাস্তার পাশে নিয়ে গেলেন।’

রাজশাহীর আন্দোলনে মেয়েদের অবদানের কথা স্মরণ করে আম্মার বলেন, ‘ততক্ষণে ছেলেরা অনেকে চলে গেছে, কিন্তু মেয়েরা সবাই আছে। মেয়েরা তো চাইলেই দৌড়াতে পারে না। আর আমাদের মেয়েরা ছিল অপ্রতিরোধ্য। মানে রাজশাহীর এই আন্দোলনে মেয়েদের অবদান হচ্ছে ৭০%। যদি আমি বলি—রাজশাহীর ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা বেশি সাহসী—ভুল হবে না। সামনের ১০-১৫ জন হয়তো ইট চালাচালি করছে। শিবিরের ভাইয়েরা তালাইমারি পর্যন্ত আমাকে সেইফটি দিয়ে নিয়ে গেল। তালাইমারিতে যখন এলাম, এসে শুনলাম আড়াইশ’রও বেশি মানুষ মারা গেছে। এবং এটা অসম্ভব কিছু না—এত এত অস্ত্র!’

‘আমরা তালাইমারির দিকে আসতে আসতে দেখি, শহীদ মিনারের পাশে মতিহার থানার পুলিশ অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। তখন চিন্তা করলাম—পুলিশ দুই রকম হতে পারে। এক, আমাদের সেইফ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে যেন আমাদের ভাইয়েরা হামলা না করে, নইলে আত্মঘাতী ঘটনা ঘটবে। আর দুই, যদি পুলিশই হামলা করে তাহলে কোন দিকে যাব? ওদিকে ছাত্রলীগ-পুলিশ, এদিকেও পুলিশ! তখনকার মতিহার থানার পুলিশ এনায়েত ভাই—সম্ভবত তখন ডিসি ছিলেন—বললেন, ‘আমরা কিছুই বলবো না।’ মাইকে বললেন, ‘আমরা কিছুই বলবো না। আমরা সবাইকে এক এক করে তালাইমারিতে নিয়ে যাচ্ছি।’

‘আমাদের মাথায় তখন সীমাহীন টেনশন। কারণ একেক জায়গা থেকে একেক রকম খবর আসছে—আড়াইশ’ মানুষ মারা গেছে! আমার জন্য কতটা বড় একটা সিচুয়েশন! আর আমি তো একজনকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে এসেছি। এগুলা নিয়ে টেনশন করছিলাম। হঠাৎ করে বিএনপির কেন্দ্রীয় একজন নেতা আমাকে কল দিলেন। আমি জানি না, উনি আমার নাম্বার কোথা থেকে পেলেন। কল দিয়ে বললেন—‘শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছে। চারটার সময় সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধান সংবাদ সম্মেলন করবেন।’ তখন আনন্দের চেয়ে বেশি টেনশন হচ্ছিল। মনে হচ্ছিলো, যারা আন্দোলন করেছে—ওরা এসে গলা জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছে—‘ভাই, আমার বোন পাইতাছি না। ‘ভাই, আমার বাবাকে পাইতাছি না।’ এমন একটা অবস্থা!

‘মাইকে ঘোষণাও দিতে পারছিলাম না। ৪টার আগে তো কিছু বলতেও পারছিলাম না। রিউমার তো আসছেই অনেক। তারপর অবশেষে চারটা বাজলো। দেখি, সেনাপ্রধান ব্রিফ করছেন—চারটা ১৫ বা ২০/২৫-এর দিকে। ফাইনালি আমরা শিওর হলাম, ‘শেখ হাসিনা পালিয়েছে। তারপর আমরা নামাজ আদায় করলাম তালাইমারিতে।’