শিরোনাম
মো. রাসেল সরকার
ঢাকা, ২৪ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর যেসব নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সালমান সিদ্দিকী অন্যতম। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু করে সরকার পতনের গণঅভ্যুত্থানে সারাদেশে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করতে এবং আন্দোলনকে গতিশীল রাখতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
সালমান সিদ্দিকীর গ্রামের বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায়। তার বাবা প্রয়াত আবু বকর সিদ্দিক পেশায় একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। মায়ের নাম পাপিয়া নাসরীন। গ্রামের বিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষে তিনি বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর তিনি ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে থেকে তিনি স্নাতক সম্পন্ন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়ার পর প্রথম বর্ষ থেকেই তিনি সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টে যোগ দেন। পরে তিনি সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটিরও সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রগতিশীল ছাত্রজোট, ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’সহ বিভিন্ন সময় গড়ে ওঠা বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর জোটে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। সর্বশেষ আটটি বাম ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটেও তিনি সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সালমান সিদ্দিকী জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তার অংশগ্রহণ, দলীয় অবস্থান ও অভিজ্ঞতার নানা দিক তুলে ধরেন।
বাসস : ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট কীভাবে তৈরি হয়েছিল? এ আন্দোলনে আপনি কখন, কীভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন?
সালমান সিদ্দিকী : ২০১৮ সালে যখন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন হয়, তখন সেই আন্দোলনে আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম। ওই সময় আন্দোলনের একাংশ যখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়, আমরা কিন্তু তখন আন্দোলনটা চলমান রাখতে চেয়েছি। আমরা তখন জোরালোভাবে মাঠে ছিলাম। সরকারি চাকরিতে প্রায় ৫৬ শতাংশ কোটা প্রথা ছিল, এটা খুবই বৈষম্যমূলক ছিল। কোটা সংস্কারের দাবিটা খুবই যৌক্তিক এবং সেই দাবির পক্ষে আমাদের অবস্থান ছিল। সেই আন্দোলন সফল হয়। আমরা চেয়েছিলাম কোটা প্রথার যৌক্তিক সংস্কার। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেদ করে সব কোটা বাতিল করে দেন, এটা ঠিক হয়নি। নারী ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীসহ অনগ্রসরদের জন্য কোটা অবশ্যই রাখা দরকার ছিল। একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালে হাইকোর্ট কোটা প্রথা পুনর্বহালের রায় দেয়। শিক্ষার্থীরা আবারো আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়। ২০২৪ সালে যখন নতুন করে আবার কোটা সংস্কার আন্দোলন গড়ে ওঠে, সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের নেতাকর্মীরা মিছিলে অংশ নেয়।
ওই সময় আমরা বাম ছাত্র সংগঠনগুলো আরেকটি আন্দোলনে ছিলাম। আপনারা জানেন, আওয়ামী লীগ সরকার শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ ঘোষণা করেছিল। এটা বাতিলের দাবিতে ওই সময় আমরা সারাদেশে পাঁচ লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিলাম। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শিক্ষাবিদদের নিয়ে আমরা অনেকগুলো প্রোগ্রাম করি। ঠিক এই সময়েই কোটা সংস্কার আন্দোলনটা শুরু হয়। আমরা সিদ্ধান্ত নিই, আমাদের ওই কর্মসূচি স্থগিত করে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সর্বাত্মকভাবে অংশ নেব। গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটকেও আমরা সক্রিয় করি। কোটা ইস্যু নিয়ে ৭ জুলাই আমরা মধুর ক্যান্টিনে প্রেস কনফারেন্স করি। সেই প্রেস কনফারেন্সে আমরা সরকারের প্রতি দাবি জানাই, কোটা পুরোপুরি বাতিল না করে যৌক্তিকভাবে সংস্কার করতে হবে। আমরা বলেছিলাম, নারী ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীসহ অনগ্রসরদের জন্য কিছু কোটা রাখা উচিত। কিন্তু সরকার কারো দাবি প্রতি কর্ণপাত করেনি। তারপর থেকেই কিন্তু আন্দোলন জোরালো হতে থাকে। আমরা সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি।
বাসস : ২০২৪ সালের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীরা একটি নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করে। ছাত্র সংগঠনের নেতা হিসেবে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে শুরুতে আপনাদের জন্য কী ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল?
সালমান সিদ্দিকী : কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরুতে ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের সাংগঠনিক পরিচয়ে মাঠে নামা চ্যালেঞ্জ ছিল। আমাদের যে মুখগুলো বেশি পরিচিত ছিল, আমরা শুরুতে চেষ্টা করেছি সম্মুখ সারিতে না থাকতে। যাতে এটাকে কেন্দ্র কোনো জটিলতা তৈরি না হয়। ওই সময় প্রায় সব ছাত্র সংগঠনই এমনটা করেছে। যেহেতু সাধারণ শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে, তাই আমরা ওই সময় এ বিষয়গুলো ভেবেছি। তবে আমরা মাঠে ছিলাম। আমাদের নেতাকর্মীরা শুরু থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছিল। ১৫ জুলাই যখন ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলা করে, তখন থেকে আমরা জোরালোভাবে মাঠে নামি এবং সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণে জুলাই গণঅভ্যুত্থান হয়।
বাসস : কোটা সংস্কার আন্দোলন এক পর্যায়ে গণঅভ্যুত্থান বা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেবে, এটা কি শুরুতে ধারণা করতে পেরেছিলেন?
সালমান সিদ্দিকী : কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেবে, এটা শুরুতে কেউই ধারণা করতে পারেনি। তবে ১৫ জুলাইয়ের পর আঁচ করা যায়, সরকার যেভাবে জনগণকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করছে, যেভাবে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগসহ সরকারি বাহিনী দমনপীড়ন শুরু করেছে, এটার একটা চূড়ান্ত পরিণতি হবে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে হাসিনার ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়েছি, কথা বলেছি। আমরা তাকে গদি ছাড়ার কথা বলতাম। আমাদের বিশ্বাস ছিল, এই ফ্যাসিবাদী শাসনের একদিন পতন হবেই। একটা অত্যাচারী শাসক যত শক্তিশালী হোক না কেন, আজ হোক কাল হোক তার বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্যবদ্ধ জাগরণ ঘটবে।
বাসস : কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ ছিল কিনা? কীভাবে আন্দোলনে সমন্বয় করতেন?
সালমান সিদ্দিকী : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন গড়ে ওঠে, তখন বাম ছাত্র সংগঠনগুলোকে তেমন একটা স্পেস দেয়া হয়নি। কিন্তু আমাদের প্রবল চেষ্টার মধ্য দিয়ে সেই স্পেসটা তৈরি হয়। যেহেতু এই আন্দোলনকে আমরা ধারণ করি, ফলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমরা বারবার চেষ্টা করে এ জায়গাটা তৈরি করতে হয়েছে। পরবর্তী সময়ে যখন রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন বেড়ে যায়, আমাদের নেতাকর্মীরা জোরালোভাবে মাঠে নামে। যেমন- আমি যদি ইডেন কলেজের কথা বলি, এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই কিন্তু ১৫ জুলাই প্রথম আক্রান্ত হয়। আমাদের সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি শাহিনুর আক্তার সুমি সেখানে শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করেন। আগের দিনই তারা ঘোষণা করেন, তারা ইডেন থেকে মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে আন্দোলনে যোগ দেবেন। তখন কলেজ প্রশাসন গেইটে তালাবদ্ধ করে তাদের আটকিয়ে রাখার চেষ্টা করে এবং শিক্ষার্থীরা তালা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইলে ছাত্রলীগ আক্রমণ করে। সেদিন সেখানে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের ভূমিকার কারণেই শিক্ষার্থীরা গেইট ভেঙে আন্দোলনে যোগ দিতে পেরেছে। ইডেন থেকে সেদিন প্রায় ৩০০ ছাত্রী রাজু ভাস্কর্যের সামনে আন্দোলনে যোগ দেন। আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নারী শিক্ষার্থীরা সামনে ছিল বলেই সরকার আন্দোলনকে চরমভাবে দমন করতে পারেনি।
বাসস : অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের তুলনায় বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী সংখ্যায় কম ছিল। আন্দোলনে তাদের ভূমিকা কেমন ছিল?
সালমান সিদ্দিকী : গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট প্রথমে আটটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয়। আন্দোলনের সময় এ জোটে সাতটি বাম ছাত্র সংগঠন যুক্ত ছিল। আমরা সংখ্যায় কম হতে পারি, কিন্তু আমরা আমাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে মাঠে ভূমিকা রেখেছি। আমাদের নেতাকর্মীরা কেউ নিহত না হলেও অনেক গুলিবিদ্ধ হয়েছে, আহত হয়েছে। ঢাকাসহ সারাদেশে আমাদের নেতাকর্মীরা যে যেখানে ছিল, এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। ইডেন কলেজে ছাত্রফ্রন্টের শাহিনুর আক্তার সুমি, সুমাইয়া শাহিনা, ছাত্র ইউনিয়নের সানজিদা আক্তার, তিলোত্তমা ইতি, ছাত্র কাউন্সিলের স্কাইয়া ইসলাম, ঢাবিতে নূজিয়া হাসিনা রাশাসহ অনেকেই এ আন্দোলনে সামনে থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইভান তাহসিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, আন্দোলনে তার হাত ভেঙে যায়। দলীয়ভাবে আমাদের নির্দেশনা ছিল, আন্দোলন সফল করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা এবং মাঠে সক্রিয় থাকব।
বাসস : জুলাই-আগস্টে পুরো আন্দোলনের সময় আপনি কোথায় ছিলেন? ব্যক্তিগতভাবে আপনি কীভাবে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন?
সালমান সিদ্দিকী : আন্দোলনের শুরুতে আমি সোবহানবাগে মেসে থাকতাম। সেখানে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আন্দোলনে অংশ নিতাম। কিন্তু পরে আমি মেসে থাকতে পারেনি। আমি আমার পরিচিত বা আত্মীয়-স্বজনের বাসা থেকে এসে আন্দোলনে যোগ দিতাম। আমরা জানতাম, আমাদের মেসটা আক্রান্ত হবে। পরে আক্রান্ত হয়েছিল। আন্দোলনের সময় আমি ব্যক্তিগতভাবে টিএসসি, শাহবাগ, প্রেসক্লাব, পল্টন এবং শহীদ মিনারে বেশি মুভ করেছি।
বাসস : কোন ঘটনা বা প্রেক্ষাপটের পর আপনারা সাংগঠনিকভাবে খুব জোরালোভাবে মাঠে নেমেছিলেন?
সালমান সিদ্দিকী : আমরা শুরু থেকেই এ আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু শুরুতে এ আন্দোলন কোটা সংস্কারের দাবির মধ্যে সীমিত ছিল। ১৫ জুলাই যখন ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর বর্বর ও নৃশংস হামলা করে এবং ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে, তখন আমরা ছাত্র-জনতাকে আন্দোলনে নামার আহ্বান জানাই এবং নেতাকর্মীদের জোরালোভাবে মাঠে থাকার নির্দেশনা দিই।
বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের কোন ঘটনা আপনার মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছিল? যে স্মৃতি এখনো নাড়া দেয়, সে সম্পর্কে জানতে চাই।
সালমান সিদ্দিকী : জুলাই আন্দোলনের অনেক স্মৃতি রয়েছে। ১৪ জুলাই থেকে যখন সারাদেশে ছাত্রলীগের হামলা শুরু হয়, সেই নিউজগুলো আমরা পাচ্ছিলাম। ১৫ জুলাই ছাত্রলীগের হামলায় আহতদের দেখতে আমরা হাসপাতালে ছুটে যাই। সেখানে আমরা ছাত্রলীগের উপর্যুপরি হামলা দেখেছি। নারী শিক্ষার্থীদের রক্তাক্ত মুখ আমাদের সেদিন খুব ব্যথিত করেছিল। ১৬ জুলাই রংপুর থেকে আমাদের সহযোদ্ধারা ফোনে জানায়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে পুলিশ নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করেছে। তখন আমি নামটাও জানতে পারিনি। একটু পর শুনলাম চট্টগ্রামে ওয়াসিম আকরাম নামে আরেক শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়েছে। সেদিন এভাবে ছয়জনকে হত্যা করা হয়। তারপর একের পর এক হত্যাযজ্ঞ চলতেই থাকে। প্রতিটা মুহূর্ত বা ঘটনা ভীষণ স্মৃতিময়। একক কোনো ঘটনা আলাদাভাবে বলা কঠিন। তবে যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা মধ্যরাতে সমস্ত হলগুলো থেকে বেরিয়ে এসে রাজু ভাস্কর্যে সামনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়, সেই স্মৃতিটা বেশি মনে পড়ে। স্মৃতি কোনো মৃত বিষয় নয়, এটা জীবন্ত। এই স্মৃতি আমাদের করণীয় নির্ধারণ করে দেয়, যারা অনেক ত্যাগ স্বীকার করে দেশকে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা থেকে মুক্ত করেছে, তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে।
বাসস : আন্দোলনের এক পর্যায়ে সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়, ওই সময় আপনারা কীভাবে আন্দোলনের তথ্য পেতেন? আন্দোলনে অংশ নিতে নেতাকর্মীদের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করতেন?
সালমান সিদ্দিকী : ইন্টারনেট যখন শাটডাউন করে দেওয়া হয়, তখন আমরা সাংবাদিকদের কাছে আমাদের বিবৃতি এসএমএস করতাম। বিবৃতিটা ছোট ছোট ভাগ করে ম্যাসেজ করতাম। ওই সময় কখনো কখনো কিছু ইন্টারনেট পাওয়া যেত, সেটা দিয়ে ম্যাসেঞ্জার চালানো যেত। আমরা আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দিয়ে গ্রুপে ম্যাসেজ দিতাম। যখন সমন্বয়কদের একটা অংশকে ডিবিতে আটকে রাখা হয়, তখন আমরা অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন সমন্বয় করার জন্য একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ছিল। আমরা সেখানে ম্যাসেজ করতাম। আমাদের জুনিয়র কর্মীদের দ্বারা আমাদের বক্তব্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের কাছে পৌঁছাতাম।
বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থান কেন অপরিহার্য ছিল? এ আন্দোলন সফল না হলে দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যেত বলে মনে করেন?
সালমান সিদ্দিকী : আওয়ামী লীগ নিজেদের যতই শক্তিশালী মনে করুক না কেন, তারা ধীরে ধীরে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। তারা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন কায়েম করেছিল। আজ হোক কাল হোক, তাদের পতন অবশ্যই হতো। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের দুঃশাসনের পতন হয়েছে। তবে কারো একক ডিজাইনে আওয়ামী লীগের পতন হয়নি। জনজাগরণে বা গণমানুষের অংশগ্রহণে তাদের পতন ঘটে। আমি মনে করি, এ আন্দোলন সফল না হওয়ার কোনো কারণই ছিল না । কেননা এ আন্দোলনে ছাত্র-জনতা সবাই মাঠে নেমে এসেছিল। বাবা-মা তাদের ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল। যখন গণজাগরণ হয়, তখন আন্দোলন অবশ্যই সফল হয়। তারপরও যদি এ আন্দোলন সফল না হতো, তাহলে আওয়ামী দুঃশাসন আরও দীর্ঘায়িত হতো। মানুষের ওপর নিপীড়ন আরও বাড়ত। আন্দোলনকারীদের জেল-জুলুম বা বিচারের নামে প্রহসন করত। তবে আমি মনে করি, আওয়ামী লীগের একদিন অবশ্যই পতন হতো। এ আন্দোলন যদি ২০২৪ সালে না-ও হতো, সেটা ২০২৫, ২৬ কিংবা ২৭ সালের যেকোনো সময় তাদের পতন হতোই।
বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ও শহীদদের স্মরণীয় করে রাখতে ছাত্র সংগঠনগুলোর করণীয় কী? আপনারা তাদের স্মরণে মোটাদাগে কী কী করেছেন এবং ভবিষ্যতে কী পরিকল্পনা রয়েছে?
সালমান সিদ্দিকী : দেখুন এ আন্দোলনে আবু সাঈদ, মুগ্ধ, শাকিল, আনাসসহ প্রায় দেড় হাজার মানুষ শহীদ হয়েছেন এবং অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছেন। আমরা তাদের স্মরণীয় করে রাখতে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। আমরা শহীদদের নিয়ে প্রকাশনা করছি। আমরা তাদের স্মরণে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এর মধ্যে রয়েছে- আলোচনা সভা, সেমিনার, স্মৃতিচারণ, আলোকচিত্র প্রদর্শনী, সাইকেল র্যালি, মোমবাতি প্রজ্বলন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি। আমরা জুলাই-আগস্ট মাসজুড়ে সারাদেশে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আমরা সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছি, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের কথা যেন পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমরা দাবি জানিয়েছি, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতে শহীদদের স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়। আগামী ৯ আগস্ট রাজু ভাস্কর্যে জুলাই জাগরণ নামে অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। আমরা কিন্তু সারাদেশে শহীদ পরিবারের সঙ্গে দেখা করছি, খোঁজ-খবর নিচ্ছি। আমরা শহীদদের স্মৃতিময় ছবি তাদের পরিবারের হাতে তুলে দিচ্ছি।
বাসস : ছাত্রলীগের নির্যাতন ও অপরাজনীতির কারণে জুলাই আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীরা রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গনের দাবি জানান । অনেকে ছাত্র রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা বলেছেন। ৫ আগস্টের পর ছাত্র রাজনীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন আসছে?
সালমান সিদ্দিকী : ছাত্রলীগ পেশিশক্তি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে আধিপত্য ধরে রেখেছিল। ছাত্রলীগের নিপীড়ন দেখে শিক্ষার্থীদের অনেকে ছাত্র রাজনীতির প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করত। কিন্তু ছাত্র রাজনীতি অবশ্যই থাকা উচিত। এটা ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি থাকবে না, এটা সমাধান নয়। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে এক করে দেখলে চলবে না। আমরা ছাত্রলীগের দখলদারিত্ব, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়েছি। দেশে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। আমরা মনে করি, ছাত্ররাজনীতিতে পরিবর্তন আসা দরকার। শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে রাজনীতি করা উচিত। এটা আমরা বিগত দিনেও করেছি। কিন্তু যারা ক্ষমতার কাছাকাছি ছিল, তারা শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়ন, ক্যাম্পাসে বা হলে দখলদারিত্ব, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। আমরা এগুলো আর দেখতে চাই না। ডাকসুসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ সচল করা উচিত। এর মাধ্যমে ছাত্রনেতারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আরো কাছে যেতে পারবে, শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করতে পারবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সচেতন হতে হবে, যারা ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস ও দখলদারিত্ব কায়েম করবে, তাদের না বলতে হবে। যে ছাত্র সংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের পক্ষে থাকবে, তাদের হাতকে শক্তিশালী করতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো অন্যায় হলে প্রতিবাদ জারি রাখতে হবে।
বাসস : গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান? দেশকে কীভাবে আরো সুন্দরভাবে গড়ে তোলা যায়?
সালমান সিদ্দিকী : ফ্যাসিস্ট হাসিনা মানুষের যে অধিকারগুলো কেড়ে নিয়েছিল, যেসব অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা হয়েছে, সেই অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। প্রথমে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচার , শহীদ পরিবারকে পুনর্বাসন করা এবং আহতদের সুচিকিৎসা দেওয়া জরুরি। বিভিন্ন খাতে সংস্কার করা জরুরি ছিল। কিন্তু সেটা তেমন বাস্তবায়ন হয়নি। বিচার, সংস্কার ও মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশে পরিবর্তন আসবে। সরকারের উচিত, অবিলম্বে সংস্কার পরিকল্পরা বাস্তবায়ন করা এবং একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়া।
বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সুফল পেতে ছাত্র-জনতার করণীয় কী?
সালমান সিদ্দিকী : জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা এখনো তৈরি হয়নি। রাষ্ট্রে চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়নি। তাই আমরা বলি, জুলাই আন্দোলনে ব্যাপ্তি শেষ হয়ে যায়নি। জুলাই এখনো বহমান। শহীদদের স্বপ্ন ছিল, একটা শোষণ ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা। তারা রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য লড়াই করে গেছেন, সেই লড়াই আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। একাত্তরে শোষণ ও বৈষম্যহীন দেশের জন্য মানুষ শহীদ হয়েছেন, তারা তাদের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ২০২৪ সালেও আবু সাঈদ-মুগ্ধরা লড়ে গেছেন, কিন্তু তারা একটা বড় দায়িত্ব আমাদের কাঁধে তুলে দিয়ে গেছেন। ফলে আমরা এই দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারি না। রাষ্ট্রগঠনে আমাদের লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে।
বাসস : নানা ব্যস্ততার মাঝেও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সালমান সিদ্দিকী : আপনাকে এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকেও অনেক ধন্যবাদ।