শিরোনাম
নেছার উদ্দিন
ঢাকা, ৬ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : গণঅভ্যুত্থান আমাদের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দল-মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক এই অভ্যুত্থানের প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছেন। মুক্তিকামী সকল রাজনৈতিক শক্তি ছিল এই অভ্যুত্থানের অন্যতম অংশীদার। নিজেদের সর্বোচ্চটুকু শক্তি দিয়ে সফল করেছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থান। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে(বাসস) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জুলাই অভ্যুত্থান সম্পর্কে এ কথা বলেন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির।
বছর ঘুরে আবারও জুলাই আমাদের মাঝে হাজির হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের বিভিন্ন পর্যায়ের স্মৃতিচারণ করেছেন দীর্ঘ সময় অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হওয়া নাছির। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৭-২০০৮ সেশনের স্যার এ এফ রহমান হলের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন ছাত্ররাজনীতির সাথে। গত বছরের মার্চ মাসে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মনোনিত হয়েছেন। ফ্যাসিবাদী শাসনামলের দীর্ঘ লড়াই পেরিয়ে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের যে সূচনা, তাতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন নাছির। তারই মুখে অভ্যুত্থানে ছাত্রদলের অংশগ্রহণের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে।
বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থানে কোন পর্যায়ে ছাত্রদল যুক্ত হয়েছেন?
নাছির : জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল শুরু থেকেই কোটা বিরোধী আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে গেছে। আন্দোলনের শুরু থেকে আমাদের কৌশল ছিল, ছাত্রদলের যারা পরিচিত মুখ তারা সামনে আসবেনা। কৌশলগত কারণে ছাত্রদল শুরুতে সাংগঠনিকভাবে এই আন্দোলনে যেতে চায়নি। কিন্তু জুলাইয়ের ৮ তারিখে আমরা আন্দোলনের সমর্থনের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলাম। কোটার বিষয়ে আমরা আমাদের অবস্থান জানিয়েছিলাম সেদিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারা বাংলাদেশে জুলাইয়ে যে আন্দোলন হয়েছিল সেখানে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা অবস্থান করেছিল। আমরা শুরু থেকেই চেয়েছি কোটা আন্দোলন যেন কোন রাজনৈতিক ব্যানারে না হয়। নাহিদ ও আসিফদের সাথে তখন এ বিষয়ে আমাদের কথা হয়েছে। জুলাইয়ের শুরু থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনকে একটি সাংগঠনিক ভিত্তি দেওয়ার চেষ্টা করেন। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম কমিটিতে ছাত্রদলের দুইজনকে রাখা হয়েছিল। সব ছাত্র সংগঠন থেকেই কয়েকজন করে সমন্বয়ক কমিটিতে রাখা হয়েছিল। পরে আবার ছাত্রদলের ৩ জনকে যুক্ত করেছিল সমন্বয়ক কমিটিতে। মোট ৫ জনকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন কমিটিতে দিয়েছে। আন্দোলনের নেতৃত্ব যারা দিয়েছে তাদের পরামর্শ ছিল ছাত্রদলের জুনিয়র কর্মীদের নাম যুক্ত করবে। কেননা সিনিয়র ছাত্র নেতাদের অনেকেই তখন ছাত্রদলের পরিচিত মুখ।
বাসস : ১৪ জুলাই রাজাকার স্লোগান দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হলগুলো থেকে মধ্যরাতে বেরিয়ে পড়ে। আন্দোলনের এই পর্যায়ে ছাত্রদলের প্রতি আপনাদের নির্দেশনা কী ছিল?
নাছির : জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন সময়ে শেখ হাসিনা আন্দোলকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে সম্বোধন করেছিলন। তার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেদিন রাতে শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের অনেক নেতাকর্মী তখন হলগুলোতে থাকতেন। অনেকের হলে থাকার সুযোগ ছিলনা। আগে থেকেই আমরা হলে থাকা শিক্ষার্থীদের সাথে যুক্ত ছিলাম। সে মিছিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের প্রতিটি নেতাকর্মী অংশগ্রহণ করেছিল। সেদিন রাতে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানের ‘কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ অংশটি উপস্থিত ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা যুক্ত করেছিল। শেখ হাসিনাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে সর্বপ্রথম ‘রাজাকার’ বলার দুঃসাহস দেখিয়েছিল ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা।
বাসস : শহীদ আবু সাঈদ ও ওয়াসিম আকরাম এর মৃত্যুর খবর কিভাবে পেয়েছেন?
নাছির : ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছিল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সেদিন ছাত্রদলের অনেক নেতাকর্মীও আহত হয়। আহত শিক্ষার্থীদের ওপর ঢাকা মেডিকেল গিয়েও হামলা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সেদিন রাতে ছাত্রদলের অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতারেরর শিকার হয়। গ্রেফতারের প্রতিবাদে পরদিন ১৬ জুলাই আমরা নয়াপল্টনে মিছিল করি ও একটি সংবাদ সম্মেলন করি। প্রোগ্রামে থাকাকালীন সময়ে আমরা রংপুরে আবু সাঈদ হত্যার কথা শুনতে পাই। এর কিছুক্ষণ পরে চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রদলের ওয়াসিম আকরামকেও খুনি হাসিনার পুলিশ হত্যা করেছে। সেদিন ওয়াসিম ফেসবুকে পোস্ট করেছিল ‘চলে আসুন ষোলশহর’। চট্টগ্রাম শহরে তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। এভাবেই ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা সারাদেশে আন্দোলনকারীদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল। ওয়াসিমের এই পোস্ট পুরো ছাত্রদলকে প্রতিনিধিত্ব করছে।
ওয়াসিমের শহীদ হওয়ার কথা সর্বপ্রথম আমাকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জানিয়েছে। পুরো বাংলাদেশে যেখানে আন্দোলন হয়েছে, সব জায়গায় ছাত্রদলের সব ইউনিটের নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সারাদেশে আমাদের নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া ছিল, তারা যেন আন্দোলনের শুরু থেকে যুক্ত থাকে।
বাসস : ১৬ জুলাই রাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হল থেকে বের করে দেয় শিক্ষার্থীরা। এই প্রক্রিয়ায় আপনাদের অংশগ্রহণ ছিল কী না?
নাছির : ১৫ তারিখের হামলার পর আন্দোলন সামগ্রিক আন্দোলনে রূপ লাভ করেছে। এরপরই ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দোলনে যুক্ত থাকার নির্দেশনা দিয়েছি ছাত্রদলের প্রতিটি ইউনিটকে। ১৬ জুলাই রাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে বিতাড়িত করা হয়। সেদিন ছাত্রদলের সভাপতি রাকিব ভাই, আমি ও এখনকার এক ছাত্র উপদেষ্টার সাথে একাদিক মিটিং হয়েছে। মিটিং এর বিষয়বস্তু ছিল কিভাবে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হল থেকে বের করে দেওয়া যায়। হলগুলো থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বের করে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় ছাত্রদলের ব্যাপক অংশীদারিত্ব ছিল। এটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
বাসস : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়ার পর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে। আপনাদের বেসরকারী ইউনিটকে কিভাবে যুক্ত করেছেন এই প্রক্রিয়ায়?
নাছির : ১৭ তারিখের পর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনকে আরও বেগবান করেছিল। ছাত্রদলের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটির মাধ্যমে আমরা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ রেখেছি। বিশেষ করে বাড্ডা রামপুরা রোডে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের যে ভূমিকা ছিল তা ইতিহাসে নজীরবিহীন। ১৭ তারিখের পর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে ভূমিকা নিয়েছে, তারা যদি সে ভূমিকা না রাখতো আমরা হয়তো এই পরিস্থিতি নাও দেখতে পেতাম। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে তাদের প্রতি সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তা তারা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে। তারা দেখিয়েছে তারাও বুকের তাঁজা রক্ত দিয়ে বাংলাদেশকে যে কোন অপশক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
আমাদের মধ্যে একটা শঙ্কা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হলে আন্দোলনের মাত্রা স্তম্ভিত হয়ে যাবে কীনা। আমরা আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারবো কী না এই নিয়ে আমাদের মধ্যে সন্দেহ ছিল। তখন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা জানায় আন্দোলন পরদিন থেকে চলবে। কিন্তু পরদিন যেভাবে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবদান রেখেছে তা সামগ্রিকভাবে এদেশের মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে। কোন ধরনের নেতৃত্ব ছাড়াই স্বতস্ফূর্তভাবে তারা আন্দোলনে জড়িয়েছে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই অবদান আমাদের শতবছর ধরে মনে রাখা উচিত।
বাসস : এই আন্দোলনে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অবদান নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
নাছির : যাত্রাবাড়ী রাস্তায় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছিল জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের আওয়ামীলীগ গত বছরগুলোতে ব্যাপক নির্যাতন করেছে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা যাত্রবাড়িতে যে ভূমিকা রেখেছে তা অবিস্মরণীয়। বাড্ডা, রামপুরা ও যাত্রাবাড়িতে যদি আন্দোলন কম হতো। হয়তো এই গণঅভ্যুত্থানের চিত্র ভিন্নভাবে হতো। ১৭ জুলাই পর আন্দোলন যে মাত্রায় গিয়ে ঠেকেছে তা সরকার পতন ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ ঢুকেছে। হ্যাঁ, তৃতীয় পক্ষ না ঢুকলে তো সরকার পতন হতো না। আন্দোলনের একটি পক্ষও তো বলেছে আমরা কোটা সংস্কার চাই, সরকার পতন চাই না। যদি তৃতীয় পক্ষ প্রবেশ না করতো তবে এই আন্দোলন একটা পর্যায়ে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে যেত। দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, তৃতীয় পক্ষ আমরা প্রবেশ করিয়েছি। সেজন্য আন্দোলনে সমাপ্তিতে খুনি হাসিনার বিদায় হয়েছে। যদি তৃতীয় পক্ষ প্রবেশ না করতো হাসিনার পতন হতো না। তৃতীয় পক্ষের প্রবেশের বিষয়টি সত্য।
বাসস : এই আন্দোলন সফল করতে আপনারা কোন কৌশলগুলো নিয়েছেন?
নাছির : আবু সাঈদ, ওয়াসিম যেদিন শহীদ হয়েছিল সেদিনের পর থেকে আমরা পুরো ঢাকাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছি। এই আন্দোলনে যারা শুরু থেকে যুক্ত ছিলেন তারা জানতো আমরা কোনদিন কোথায় থাকবো, ঢাকার কোন অংশে ছাত্রদলের কারা থাকবে। এই আন্দোলনে শিবিরের সাথে আমাদের পরোক্ষ যোগাযোগ ছিল। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আব্দুল কাদের ও গণ অধিকার পরিষদের রাশেদ খান শিবিরের সাথে আমাদের সমন্বয় করতেন। আন্দোলনের সময়ে তারা আমাদের বলতেন, শিবির কোন জায়গায় থাকবে আর আমরা কোন জায়গায় থাকবো। এই আন্দোলনের শেষ দিকে ছাত্রদলের সবকিছুই আব্দুল কাদেরর সাথে সমন্বয় করা হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এর সাথেও আব্দুল কাদেরের যে পরোক্ষ যোগাযোগটা হয়েছে তা আমাদের মাধ্যমে হয়েছে।
বাসস : আপনার কাছে পুরো জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে সবচেয়ে ভয়াবহ মুহূর্ত কোনটি ছিল?
নাছির : আমার রাজনৈতিক জীবনে ১৯ জুলাই একটি ভয়াবহ দিন ছিল। আমরা যে বেঁচে আছি এটিই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। বেঁচে থাকা এখনো অবিশ্বাস্য লাগে। ১৯ জুলাই পল্টন এলাকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। পুরো আন্দোলনে একদিনই পল্টন এলাকায় সংঘর্ষ হয়েছে সেটা হয়েছে ১৯ জুলাই। সেদিন আমাদের কয়েকজন সহযোদ্ধা একদম কাছ থেকে শহীদ হয়েছেন। আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এমন কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। ঢাকা কলেজের ইমরান আমাকে ধরে পাশে দাঁড়িয়েছিল সেও গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমি নিজেও সেদিন রাবার বুলেটের গুলিবিদ্ধ হয়েছি।
বাসস : দীর্ঘ সময় ধরে আপনারা ইন্টারনেট নির্ভর যোগাযোগে অভ্যস্ত ছিলেন। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার পর আপনারা যোগাযোগ কিভাবে করতেন?
নাছির : ১৯ জুলাই রাতে প্রথম কারফিউ ঘোষণা করা হয়। সেদিন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। ছাত্রদলের সভাপতি রাকিব ভাইয়ের সাথেও সেদিন আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ইন্টারনেট ছাড়া ওই সময়টায় যোগাযোগ রক্ষা করা খুব কঠিন ছিল। আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে ছিলাম। তাই ইন্টারনেট নির্ভর যোগাযোগে অভ্যস্ত ছিলাম। এমন ও হয়েছে আমাদের অনেকের অফলাইন নাম্বারে কয়েক বছর ধরে যোগাযোগ নেই। হঠাৎ করে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ায় আমাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে যোগাযোগের একধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে। ১৯ তারিখ রাত থেকে রাকিব ভাইয়ের সাথেও আমার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের দুইজনের মধ্যকার যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আমি সেদিন রাতে যে বাসায় ছিলাম সেখানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আমার সাথে যোগাযোগ করে আমার নাম্বার নিয়ে রাকিব ভাইয়ের কাছে আমার নাম্বার দেন।
সেদিন রাতে তারেক রহমান আমাকে পরদিন কারফিউ ভাঙার পরামর্শ দিয়েছেন। সেদিন উনি বলেছেন, একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে কারফিউ ভাঙা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। আমরা কারফিউ ভেঙে প্রথম মিছিলটি করি শান্তিনগর এলাকায়। যমুনা টেলিভিশন এটি প্রচার করলেও পরক্ষণে তা সরকারের চাপে সরিয়ে ফেলে।
ইন্টারনেট বন্ধ থাকার সময় আমাদের দল থেকে ছোট ছোট ফোন দেওয়া হতো। একদিন একটা ফোন ব্যবহারের নির্দেশ ছিল আমাদের। এটি ব্যবহার করে আমরা ফেলে দিতাম। এটিই ছিল আমাদের নির্দেশনা। প্রতিদিন নাম্বার পরিবর্তন করা হতো। নতুন নাম্বার যখন ব্যবহার শুরু করতাম তখন সালাহউদ্দিন ভাইয়ের কাছে আমাদের নাম্বারটি দিতাম। উনি আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে আমাদের নাম্বার দিয়ে রাখতেন। উনিই আমাদের অন্যান্যদের নাম্বার দিয়ে রাখতেন। অন্যদের সাথে যেন যোগাযোগ করা যায়। এভাবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আমরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতাম।
ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য আমরা সেই ফ্যাসিবাদী সময়ে সাথে একটি ছোট রাউটার রাখতাম। ১৪-১৫ বছর ধরে আমরা ওভাবে যোগাযোগে অভ্যস্ত ছিলাম। আমাদের পরিবারের সাথে বড় একটি সময় ধরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। আমাদের বাবা মা গ্রামে থাকেন। তারা চাইলেই হুট করে অনলাইনে যোগাযোগ করতে পারতেন না। আবার আমাদের কেউ কেউ যদি অফলাইনে তাদের বাবা, মায়ের সাথে যোগাযোগ করতো, তাহলে তার বাবা-মাকে ধরে নিয়ে আসতো আইনশৃৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
বাসস : এই আন্দোলনের সময়ে আপনি কোন কোন এলাকায় সংগঠনের পক্ষ থেকে সমন্বয় করেছেন?
নাছির : আন্দোলনের মধ্যে মিরপুর, বনশ্রী, আফতাবনগর, উত্তরাতে আমি ছিলাম। আমরা যেখানে রাতে থাকতাম সেখান থেকে ২-৩ কিলোমিটার দূরে আমরা যোগাযোগ করতাম। যে ফোনটা দিয়ে যোগাযোগ করতাম তা ওখানে রেখে অন্য জায়গায় চলে যেতাম। পার্টির পক্ষ থেকে আমরা আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিগুলোতে সমন্বয় করতাম। আব্দুল কাদের সহ যারা বাহিরে থেকে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের সাথে আমরা প্রোগ্রামের রূপরেখা নিয়ে কথা বলতাম। অনেক সময় মোবাইলে আলোচনা করতাম। অনেক সময় যেখানে ইন্টারনেট আছে এমন কোথাও যেয়ে সমন্বয় করতাম। একবার মিটিং করার জন্য এক বাসায় যাই যেখানে ওয়াইফাই আছে। হঠাৎ করে মিটিং এর কিছুক্ষণ আগে ওয়াইফাই বন্ধ হয়ে যায়। মিটিং এ যুক্ত হবার জন্য পরে উত্তরা থেকে মিরপুরে যাই রিকশা করে। মিটিং এ থাকা সবাই চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল যে, আমি গ্রেফতার হয়ে গেছি কী না। খুব কঠিন সময় অতিবাহিত করেছি আমরা।
একদিন রাতে আমাকে জানানো হয়েছে বাড্ডার রাস্তায় আন্দোলনে যোগ দিতে হবে। সেদিন রাতে আমি ছিলাম মিরপুরে। রাতের বেলা রিকশা নিয়ে যখন বাড্ডার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। তখন বনানী এলাকায় আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী অবস্থান করছিল। সবার হাতেই লাঠি, হকস্টিক ইত্যাদি অস্ত্রসস্ত্র ছিল। এসময় যেহেতু আওয়ামীলীগের জীবন মরন লড়াই তারা প্রকাশ্যে সশস্ত্র হামলা করছিল তাই অনেক বেশি ভয় পেয়েছিলাম সেদিন রাতে। কিন্তু, আমার চিন্তা ছিল যা হবার হবে। আমাকে আমার গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। এমন বেশ কয়েকবার হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আমাদের এমন পরিস্থিতিতে সাহস যোগাতেন। বড় ভাইয়ের মত আগলে রাখতেন।
বাসস : লন্ডনের সময়ের সাথে বাংলাদেশের সময়ের ছয় ঘন্টার ব্যবধান আছে। এমন পরিস্থিতিতে তারেক রহমান আপনাদের সাথে যেগাযোগ রক্ষায় কোন সমস্যা হতো না?
নাছির : আমাদের সাথে লন্ডনের সময়ের বড় একটা অমিল ছিল। কিন্তু জুলাই আগস্টের সময় তারেক রহমানকে যখনই ফোন করেছি তিনি সাথে সাথে ফোন উঠিয়েছেন। ঢাকার বাইরের ঘটনাগুলোর খবর উনি আমাদের আগে পেতেন। আমাদের উনি প্রতিটি সময়ে নির্দেশনা দিতেন। পুরো আন্দোলনে বিএনপির যারা শহীদ হয়েছে, আহত হয়েছে সবার সাথে উনি যোগাযোগ করে ফেলেছেন। সাহস যোগাতেন। গ্রেফতার এড়িয়ে কী করতে পারি, তার নির্দেশনা দিতেন।
বাসস : এক দফা ঘোষণা নিয়ে আপনাদের সে সময়ে ভাবনা কী ছিল?
নাছির : জুলাইয়ের শেষের দিক থেকে আমাদের দল থেকে বলা হচ্ছিল এক দফার কোন বিকল্প নেই। স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ আমাদের বলেছিলেন, তোমরা এক দফার দিকে কিভাবে নেওয়া যায় তা নিয়ে ওদের সাথে কথা বল। সবার একটাই কথা ছিল, আমাদের একদফার দিকে যেতে হবে। একদফা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই, তা যেন আমরা শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপ করি। জুলাইয়ের শেষ থেকেই আমরা তাদেরকে এক দফার জন্য পুশ করতে থাকি। একদফা ছাড়া এখন উপায় নেই। এটি সালাহউদ্দিন ভাইও বলতেন। সে সময়ে আমাকে ও রাকিব ভাইকে একই স্পটে যেতে নিষেধ করা হয়েছিল। ৩ তারিখে রাকিব ভাই শহীদ মিনারে ছিল। ৪ তারিখ আমি শাহবাগে ছিলাম।
সেদিন সারাদেশে শতাধিক মানুষ মারা যায়। শাহবাগ থেকে বনশ্রী আসতে আমার খুব ক্লান্ত লাগছিল। সেদিন রাতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সাথে আমার কথা হচ্ছিল। আমি উনার কাছে একটু অসহায়ত্ব প্রকাশ করছিলাম। এত এত মানুষ মারা যাচ্ছে। শেষের দিকে ছাত্রদলের এত এত নেতাকর্মী শহীদ হচ্ছিল। আমি একটু হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে সাহস যুগিয়ে তিনি বলছিলেন, এটি দ্রুতই সমাধান হয়ে যাবে। সেদিন আব্দুল হান্নান, কাদের এর সাথে আলাপ করছিলাম যে, প্রোগ্রাম এর শিডিউল পরিবর্তন হয়েছে।
বাসস : জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে আপনাদের ভাবনায় কি রকম?
নাছির : গত ১৫-১৬ বছরে ছাত্রলীগ যে সংস্কৃতি কায়েম করেছিল, বিশেষ করে পিটিয়ে মানুষ মারা, গণরুম কালচার, যে দখলদারিত্বের সংস্কৃতি তারা কায়েম করেছে সেটি চিরতরে বন্ধ হওয়া উচিত। গত একবছরে বাংলাদেশে জোর করে মিছিলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা আমরা দেখিনি। গেস্টরুম বিলুপ্ত হয়েছে। ছাত্রলীগ ছাত্ররাজনীতিতে পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলার যে সংস্কৃতি কায়েম করেছে তা চিরতরে বন্ধ হওয়া উচিত। মেধাভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি বিনির্মাণের যে চেষ্টা তা চালু হওয়া উচিত। ক্যাম্পাসে দখলদারিত্বের, জোর করে মিছিলে নেওয়া, নারীদের নির্যাতন, পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলা, মতামত পছন্দ না হলে তার উপর হামলার যে প্রবণতা আমরা দেখেছি তা চিরতরে বন্ধ হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। একটি ইতিবাচক ও গ্রহনযোগ্য ছাত্ররাজনীতি বিনির্মাণ করতে আমরা সচেষ্ট রয়েছি।