বাসস
  ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:১৬

কম খরচে মানসম্পন্ন চিকিৎসা পাবে ধনী-গরিব সবাই : ড্যাব মহাসচিব ডা. শাকিল

ড্যাব এর মহাসচিব এবং অ্যাজমা, বক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. জহিরুল ইসলাম শাকিল। ছবি: সংগৃহীত

\ কবির আহমেদ খান \

ঢাকা, ১ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : চিকিৎসা নাগরিকের মৌলিক অধিকার। বিদেশ নয়, নিজ দেশেই মানসম্মত সেবা পেতে চান রোগীরা। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে অনেক। এখন দরকার চিকিৎসার মান বাড়ানো, খরচ সহনীয় রাখা এবং রোগীর আস্থা ফেরানো। এতে ধনী-গরিব সবাই অল্প খরচে একই ধরনের চিকিৎসা পাবেন। স্বাস্থ্যখাত এভাবেই এগিয়ে যাবে।

সম্প্রতি বাসস-এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বিএনপি সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) এর মহাসচিব এবং অ্যাজমা, বক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. জহিরুল ইসলাম (শাকিল) এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠিত হলে স্বাস্থ্যখাতের নানা উন্নয়নের বিষয়ে ড্যাব আগেই পরিকল্পনা সাজিয়ে রেখেছেন। সাক্ষাৎকারে তিনি তার নানা পরিকল্পনা ও স্বপ্নের কথাও তুলে ধরেন।

বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ (বিএমআরসি)র ভাইস চেয়ারম্যান এবং দি চেস্ট এন্ড হার্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর সভাপতি  ডা. শাকিল বলেন, আগামীতে ক্ষমতায় আসলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষিত ৩১ দফার আলোকে স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন ঘটনো হবে। রোগ প্রতিরোধ, জনবল সৃষ্টি, গবেষণাসহ স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনসহ মানুষের মৌলিক অধিকার চিকিৎসা সেবাকে আস্থার জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে। 

তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে, মানুষের গড় আয়ু বেড়ে ৭২ বছরের বেশি দাঁড়িয়েছে। টিকাদান কর্মসূচি প্রায় শতভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে। কমিউনিটি পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবায় গড়ে উঠেছে বড় সংখ্যক দক্ষ জনবল। 

তবে এখনো জনসংখ্যার একটি বড় অংশ মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা ও প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত বলে তিনি মনে করেন। বিশেষ করে উপজেলা পর্যায়ে অবকাঠামো থাকলেও চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও ওষুধের ঘাটতি প্রকট। দেশের স্বাস্থ্যসেবার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, অবকাঠামোগত বিষয়ে উন্নতি, যাতে বাংলাদেশ বিশ্বের যে কোন দেশের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে। দেশের ওয়ার্ড লেবেল থেকে গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় পর্যায় এবং রাজধানীতে অবকাঠামোগতভাবে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে।

ডা. শাকিল বলেন, সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যসেবায় পরিচালন ব্যয় ও বিনিয়োগে এশিয়ার স্বল্প ব্যয়ের দেশ এখনো বাংলাদেশ। সরকারের মোট পরিচালন ব্যয়ের ৩ শতাংশের কিছু বেশি বরাদ্দ হয় এ খাতে। স্বাস্থ্যখাতে কমপক্ষে ৫শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

জনবলের ঘাটতিকে স্বাস্থ্যখাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা উল্লেখ করে ড্যাব মহাসচিব বলেন, স্বাস্থ্য খাতে ৭৭ হাজার ৮৭৭টি পদ খালি রয়েছে, যা মোট অনুমোদিত পদের ৩২ শতাশ। এই শূন্য পদের মধ্যে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি শ্রেণিতে শূন্য পদের হার সর্বোচ্চ ৬২ শতাংশ এবং চিকিৎসকদের ৪০ ভাগ পদ খালি রয়েছে। খালি পদের হার সবচেয়ে বেশি সিলেট বিভাগে ৪০ শতাংশ, সবচেয়ে কম ময়মনসিংহ বিভাগে ২৬ শতাংশ।

থানা পর্যায়ে ৮ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ৪ জন। এছাড়া চিকিৎসা সেবার জন্য পর্যাপ্ত মেশিনারিজ থাকলেও দক্ষ জনবলের অভাবে অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা ব্যাহত হয়। অনেক সময় মেশিনারিজ নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে। ডায়ালাইসিস, ওটি ফ্যাসিলিটিস থানা লেবেলে তৈরি করতে হবে বলে উল্লেখ করেন ডা. শাকিল।

স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সমন্বয়ের অভাব রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যার যে দায়িত্ব, সে অনেক সময় তা পালন করে না।’ পরীক্ষাুনিরীক্ষার জন্য উন্নত যন্ত্রপাতি বাড়ানো, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি এবং বেসরকারি খাতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। চিকিৎসা ব্যয় সহনীয় করা, চাকরির নিয়োগ ও পদোন্নতিতে স্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়নও দরকার।
 
বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে তিনি বলেন, আস্থার সংকট বড় কারণ। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনার ঘাটতিও আছে। মেডিক্যাল ট্যুরিজমও একটি বাস্তবতা। 

তিনি বলেন, ‘ভারত, সিঙ্গাপুর বা বা পৃথিবীর অন্য দেশেও চিকিৎসা পদ্ধতি কিন্তু একই। আমাদের দেশেও ভালো চিকিৎসা হচ্ছে। তবে লিভার, বোনমেরু বা কিডনি প্রতিস্থাপনের মতো জটিল চিকিৎসায় এখনও উন্নত যন্ত্রপাতির ঘাটতি রয়েছে।’

ওষুধ উৎপাদনের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশে এখন আন্তর্জাতিক মানের ওষুধ তৈরি হয়। আমাদের তৈরীকৃত ওষুধ বিদেশে রপ্তানীও হয়। একটি জাতীয় ওষুধ নীতিমালার মাধ্যমে সকল কোম্পানীর মানসম্মত ওষুধ উৎপাদনে আরও উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। তবে হার্ট ও লিভার ক্যান্সারসহ কিছু জটিল রোগের ওষুধ হয়তো আমদানি করতে হয়।

ডা. শাকিল বলেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা খাতে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে, ইম্যুনাইজেশনেও সফলতা স্পষ্ট। এখন দরকার উন্নত যন্ত্রপাতি, আরও দক্ষ নার্স, টেকনোলজিস্ট ও সাপোর্ট স্টাফ। গবেষণা ও প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে দক্ষ চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্ট গড়ে তোলা জরুরি হয়ে পড়েছে।

চিকিৎসা সেবায় নার্সের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, একজন নার্সের উপর চিকিৎসার অর্ধেকই নির্ভর করে। তাই দক্ষ নার্স তৈরিতে মনোযোগী হতে হবে।

মেডিক্যাল শিক্ষার মান বজায় রাখার কথা উল্লেখ করেন তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরিতে শিক্ষার মান ধরে রাখতে হবে। মান নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সঠিক চিকিৎসক তৈরি হবে না। আর চিকিৎসক ও রোগীদের মধ্যে পারস্পরিক আচরণে পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতে হবে। যাতে আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়। এককথায় রোগীবান্ধব চিকিৎসা পদ্ধতি চালু করতে হবে। আর নীতিমালার মাধ্যমে ওষুধের দাম নির্ধারণ করতে হবে এবং তা ধরে রাখতে হবে।

সারা দেশে সরকারি পর্যায়ে আরও হাসপাতাল স্থাপনের কথা উল্লেখ করে বলেন, ঢাকা মেডিক্যাল ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আরও বেশ কয়েকটি হাসপাতাল তৈরি করতে হবে। যাতে সাধারণ জনগণ সহজেই হাসপাতালে শয্যা ও চিকিৎসা সেবা পায়। সিটিেিজন চার্টারের মাধ্যমে রোগীর চিকিৎসা সেবার খরচ সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সাধারণের দৌঁড়গোড়ায় চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিতে হবে।

সরকার উদ্যোগ নিলে চিকিৎসা ব্যবস্থা ও সেবার আরও উন্নয়ন ঘটনো সম্ভব উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতকে আরও উন্নত করা সম্ভব। আধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও সেবা পদ্ধতির উন্নয়ন করা হবে।

দেশের সরকারি হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোয় বহু মানুষ চিকিৎসা নিলেও সেবা সন্তোষজনক নয়-উল্লেখ করে ডা. শাকিল বলেন, চিকিৎসাসেবায় জনগণের আস্থা বাড়াতে এ খাতে দক্ষ জনবলের দরকার। পাশাপাশি গবেষণার দিকেও সরকারি নজর দিতে হবে এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নও করতে হবে। এ সবকিছুর ক্ষেত্রেই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও অর্থ বরাদ্দ দেওয়া জরুরি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত হেলথ বুলেটিনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে নিবন্ধিত চিকিৎসকের (২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত) সংখ্যা ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৯৯। বাংলাদেশের জনসংখ্যা (১৭ কোটি ১০ লাখ) বিবেচনায় প্রতি হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক রয়েছেন দশমিক ৮৩ জন।

অপরদিকে, স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের মোট জনসংখ্যার বিপরীতে ৩ লাখ ১০ হাজার ৫০০ নার্স থাকা জরুরি, তবে আছে মাত্র ৫৬ হাজার ৭৩৪ জন। 

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশের স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের জোরালো উদ্যোগ নেয়। গঠন করা হয় স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন। কমিশন তাদের সুপারিশে এ খাতের সংস্কারে মোটা দাগে অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি উল্লেখ করে। জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ স্বাস্থ্য খাতে থাকা উচিত বলে সুপারিশ করেছে কমিটি।