বাসস
  ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১৭:২৯

নারী হকি দলের ভরসার নাম অর্পিতা পাল

দিনাজপুর ১০ অক্টোবর ২০২৫ (বাসস) : বাংলাদেশ নারী হকি দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রমান করেছেন দিনাজপুরের অর্পিতা পাল। যে তিনটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ খেলেছে, তার প্রতিটিতে অর্পিতা ছিলেন শতভাগ সফল। 

দিনাজপুরে সাবেক হকি খেলোয়াড় ও শহরের হকি ক্লিনিক ক্লাবের পরিচালক মোঃ মতিউর রহমান বলেন, সিঙ্গাপুরে এশিয়ান হকি ফেডারেশন (এএইচএফ) কাপের ৬ ম্যাচে বাংলাদেশের পক্ষে অর্পিতা দিয়েছে ১০ গোল। এর মধ্যে তিন ম্যাচে অর্পিতা হয়েছে সেরা খেলোয়াড়। অর্পিতাসহ জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের অনন্য কৃতিত্বে ৫ ম্যাচ জিতে প্রথমবারের মতো জুনিয়র নারী এশিয়া কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ। 

দিনাজপুরের প্রান্তিক এক পরিবার থেকে উঠে আসা অর্পিতার হকির প্রতি আগ্রহের বিষয়ে শহরের রাজবাড়ী মহল্লার সাবেক খেলোয়াড় নাসরিন জাহানের বাসস’কে বলেন, দিনাজপুর শহরে রাজবাড়ী জুবিলি উচ্চ সবিদ্যালয়ে অর্পিতা পাল ক্লাস সিক্সে ভর্তি হওয়ার পর অ্যাথলেট হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করে। হাই জাম্প, জ্যাভলিন ও ১০০ মিটারে স্কুলের পাশাপাশি জেলা পর্যায়ে জুনিয়র গ্রুপে অর্পিতা অংশ নেয়। জেলা দলের হয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে একাধিক পুরস্কার অর্জন করে অর্পিতা।

দিনাজপুর শহরের রাজবাড়ী জুবলি উচ্চ বিদ্যালয়ে শরীরচর্চা শিক্ষক মোঃ আকরাম হোসেন বাবলু বলেন, অর্পিতা যখন অ্যাথলেটিকসে নিজেকে প্রমান করছিল, তখনই একদিন স্কুলে শুরু হয় মেয়েদের হকি অনুশীলন ক্যাম্প। তাতে নাম লেখায় অর্পিতা। সপ্তম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়েটা সেই প্রথম হকিস্টিক হাতে নেয়। এক মাস চলে হকির অনুশীলন। এরপর দিনাজপুর বড় মাঠ হিসেবে পরিচিত গোর-এ-শহীদ বড় ময়দানে হকি টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। ওই খেলায় চ্যাম্পিয়ন হয় অর্পিতার জুবিলি স্কুল।

এরপর পরীক্ষা শুরু হওয়ায় স্কুলে অর্পিতার আর হকি খেলা হয়নি। কিন্তু ততদিনে হকির প্রতি ভালোবাসা জন্মে গেছে। হকিতে ভাল খেলবে, এমন একটা আত্মবিশ্বাস মনে গেঁথে গিয়েছিল। স্কুলের অনুশীলনে যাদের কাছে হাতেখড়ি, তারা তখন বড় মাঠে প্রশিক্ষণ দেন। অর্পিতাও এই সুযোগে সেখানে প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। 

এভাবেই শুরু হলো হকির সঙ্গে অর্পিতার পথচলা। অর্পিতার হকি খেলার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি এখানেই। নিজেকে আজ দেশ ও দেশের বাইরে হকির মাধ্যমে সম্পৃক্ত করে গৌরব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে অর্পিতা।

২০১৯ সালে ঢাকায় মেয়েদের দল গঠনের উদ্দেশ্যে দিনাজপুর থেকে ক্যাম্পে সুযোগ পান অর্পিতা পাল। বাবা আর ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম ঢাকায় এসে মাওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামের ক্যাম্পে থেকে অর্পিতা অনুশীলন শুরু করেন। এভাবে তৃতীয় দফা ক্যাম্প করার পরই অনূর্ধ্ব-২১ এশিয়ান হকি ফেডারেশন (এএইচএফ) কাপ নারী হকি টুর্নামেন্টের জন্য জাতীয় দলে প্রথমবারের মত সুযোগ পান অর্পিতা।

দেশের বাইরে সিঙ্গাপুরে বসেছিল সেই জমজমাট আসর। আন্তর্জাতিক হকিতে বাংলাদেশের মেয়েদের যাত্রা শুরু তখনই। প্রথমবার বিদেশের মাটিতে খেলতে গিয়ে প্রতিটি ম্যাচেই সুযোগ পায় অর্পিতা। সেই আসরে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে একটি মাত্র ম্যাচ জেতে বাংলাদেশ। ওই টুর্নামেন্টের ৪ বছর পর গত বছর আগস্ট মাসে আবার আসে আন্তর্জাতিক আসরে খেলার সুযোগ। ওমানে ফাইভ-এ সাইড বিশ্বকাপ বাছাই হকিতে বাংলাদেশের জার্সিতে গোলের বন্যা বইয়ে দিয়ে টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ২০ গোল করে অর্পিতা। ফাইভ-এ সাইড হকিতে অনভিজ্ঞ বাংলাদেশ জিতেছিল তিনটি ম্যাচ।

দিনাজপুর শহরে রাজবাড়ী মহল্লার কৃতি নারী হকি খেলোয়াড় অর্পিতা পাল বলেন তার জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে খেলাধুুলা। এখন খেলাধুলা না করলে ভালো লাগেনা। হকি খেলার প্রতি আগ্রহ কিভাবে জন্মালো, এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্পিতা পাল বলেন, জুবিলি স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় তার হাতে হকিস্টিক তুলে দেওয়া হয়েছিল। এরপর থেকেই এই খেলার প্রতি মনোযোগ বাড়ে। বাংলাদেশ জাতীয় নারী দলের একজন অপরিহার্য্য খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। 

এই পরিচিতির মাধ্যমে গত বছর সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত এএইচএফ কাপ অনূর্ধ্ব-২১ নারী হকিতে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে নিজেকে প্রমান করেছেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর নিজেদের দ্বিতীয় এএইচএফ কাপে ৬ ম্যাচের ৫ টিতেই জিতেছে বাংলাদেশ, যার ৩'টিতে ম্যাচ সেরা হয়েছেন তিনি। ৭ দলের মধ্যে দ্বিতীয় হয়ে গত বছর অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠেয় জুনিয়র নারী এশিয়া কাপে প্রথমবারের মতো খেলার যোগ্যতা অর্জণ করে বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের ৩১ গোলের সর্বোচ্চ ১০টি গোলই আসে মিডফিল্ডার অর্পিতা পালের কাছ থেকে, যার ৯টিই হয়েছেন পেনাল্টি কর্নারে। 

২০২০ সালে দিনাজপুর বিকেএসপিতে শুরু হওয়া মেয়েদের হকির প্রথম ব্যাচের ছাত্রী অর্পিতা। সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া অর্পিতা গত বছর মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করেছে। এখন কলেজে এইএসসিতে ভর্তি হয়েছেন। অর্পিতার এই পথ চলার পিছনে জড়িয়ে আছে তার মা-বাবার জীবন-যুদ্ধ। অমল পাল ও সরস্বতী পালের দুই সন্তানের মধ্যে ছোট অর্পিতা পাল।

অমল পাল রাজমিস্ত্রির কাজ করে পরিবার নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি বলেন, দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়ে তার কন্যা অর্পিতা পাল দেশ বিদেশে হকিতে অনেক সুনাম অর্জন করেছে। হকি খেলায় সাফল্য অর্জন করে অর্পিতা তাকে গর্বিত করেছে। মেয়ে খেলাধুলায় আরো এগিয়ে যাক, এটাই তার প্রত্যাশা।

অর্পিতা পালের মা সরস্বতী পাল বলেন, তার মেয়ে অর্পিতা হকিতে ভালো করছেন, প্রতিবেশীদের কাছে তাই বাড়তি সম্মান পান সরস্বতী পাল। তার স্বপ্ন ছিল মেয়ে পড়ালেখা করে নার্সিং পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করবে যাতে মানুষের সেবা করা যায়। কিন্তু মেয়ে খেলাধুলায় নিজেকে জড়িত করাতে অবশ্য তিনি খুশী।

বাবা-মায়ের কথায় অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে অর্পিতা বলেন, আমি কখনোই পিছনের সময়টা ভুলতে পারিনা। এমনও হয়েছে দুর্গা পূজায় নতুন কাপড় পাইনি। আব্বু-আম্মুর কাছে টাকা ছিল না। সে জন্য আমাকে নতুন কাপড় কিনে দিতে পারেনি। 

হকিতে এতদুর আসার পিছনে অর্পিতা সাবেক হকি খেলোয়াড় মতিউর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। নানা ভাবে তার সহযোগিতা পেয়েছেন। অর্পিতা বলেন, ‘মতিউর রহমান স্যার কখনোই কোন সমস্যা বুঝতে দেননি। খেলার সরঞ্জামসহ সবকিছু উনিই দিতেন। তিনি অনেক সহায়তা করেছেন, এখনো করেন।’

দিনাজপুর জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, দেশের হকিতে ১০ নম্বর জার্সিধারী অর্পিতা এখন অনেক নারী খেলোয়াড়ের আদর্শ। দিনাজপুর বাসীর জন্য এটা গর্বের বিষয়। অর্পিতা পালকে অনুসরণ করে এখন অনেক নারী খেলোয়াড় হকিতে সংযুক্ত হচ্ছেন। আগামীতে তারাও অর্পিতার পথ অনুসরণ করে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাবেন বলে তিনি আশাবাদী।