বাসস
  ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯:৫৩

রাজস্বব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সংস্কার, ডিজিটালাইজেশন ও করদাতা পরিধি বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ 

ঢাকা, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস): দেশের রাজস্বব্যবস্থা, বিশেষ করে মূসক (ভ্যাট) কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করতে গভীরতর সংস্কার, উন্নত ডিজিটালাইজেশন এবং করদাতা পরিধি বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী নেতা ও নীতি বিশেষজ্ঞরা। 

অর্থনৈতিক রূপান্তরের নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করতে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য এসব উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি বলে তারা মন্তব্য করেন।

বুধবার রাজধানীর রাজস্ব ভবনে আয়োজিত ‘ভ্যাট দিবস ও ভ্যাট সপ্তাহ ২০২৫’-এর আলোচনায় তারা ভ্যাট প্রশাসন ও সামগ্রিক কর ব্যবস্থার সাম্প্রতিক অগ্রগতি ও বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেন। 

অর্থ সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ভ্যাট এখনো বিরাট সম্ভাবনাময় রাজস্ব উৎস। গত এক বছরে বাস্তবায়িত বেশ কিছু একীভূত পদক্ষেপ ইতোমধ্যে দৃশ্যমান ফল দিচ্ছে। যদিও কিছু উদ্যোগ শুরুতে ব্যবসায়ীদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল, দীর্ঘমেয়াদে এর সুফল স্পষ্ট হচ্ছে। 

তিনি জানান, কর ব্যয়ের যৌক্তিকীকরণের মাধ্যমে ভ্যাটের আওতা বাড়ানো হয়েছে এবং চলতি অর্থবছরের বাজেটে এর প্রতিফলন রয়েছে। নভেম্বর পর্যন্ত রাজস্ব বৃদ্ধির হার ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে, যা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। সরকারি ব্যয় সংযত থাকার মধ্যেও রাজস্ব প্রবৃদ্ধি বাড়ায় বেসরকারি খাতের কার্যক্রম ইতিবাচকভাবে বাড়ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, ভ্যাট নিয়ে অনেক সময় ভুল ধারণা থাকে। আসলে ব্যবসায়ীরা ভ্যাট দেন না বরং সরকারের পক্ষে তা সংগ্রহ করেন। আমদানি শুল্কও শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ওপরই পড়ে। উন্নত কোনো অর্থনীতি বাণিজ্য করের ওপর নির্ভরশীল নয়। তাই বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব উৎস, বিশেষ করে আয়কর ও ভ্যাটের দিকে যেতে হবে।

তিনি বলেন, আয়করে এখনো বড় ধরনের রাজস্ব ফাঁকি আছে। সঠিকভাবে ভ্যাট বাস্তবায়িত হলে অনেক ব্যবসার কার্যকর ভ্যাটহার ১ শতাংশের নিচে নেমে আসতে পারে। কারণ ভ্যাট শুধু ভ্যালু অ্যাডিশনের ওপর প্রযোজ্য। কিন্তু অদক্ষতার কারণে অনেক সময় কার্যকর হার আরও বেড়ে যায়।

ভ্যাট ও আয়কর ব্যবস্থার মধ্যে ডিজিটাল সমন্বয় জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, তিন দশকের বেশি সময় পেরোলেও কাস্টমস পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় হয়নি। বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া ভবিষ্যতের ব্যয়চাপ মোকাবিলায় পর্যাপ্ত রাজস্ব সংগ্রহ কঠিন হবে।

তিনি জানান, ভ্যাট-যোগ্য টার্নওভার সীমা ৩ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৫০ লাখ টাকায় আনা হয়েছে, যা রেজিস্ট্রার্ড ভ্যাটদাতার সংখ্যা বাড়াবে। ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলো বাইরে থাকলে বড় করদাতাদের ওপর অসহনীয় চাপ থেকে যাবে।

এনবিআর চেয়ারম্যান স্বয়ংক্রিয় ও তথ্যনির্ভর করব্যবস্থার ওপর জোর দেন যেখানে করদাতার তথ্য নিজে থেকেই সিস্টেমে যুক্ত হয়ে প্রি-ফিল্ড রিটার্ন তৈরি করা সম্ভব হবে উন্নত দেশগুলোর মতো। 

ইআরডি সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী ভ্যাট সংগ্রহে এনবিআর’র কেন্দ্রীয় ভূমিকার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ভ্যাট ও আয়কর—দুই ক্ষেত্রেই করদাতা পরিধি বাড়ানো জরুরি। ডিজিটালাইজেশনের বিকল্প নেই। এতে করদাতা ও কর কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ কমবে, হয়রানি কমবে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।

ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস ডিভিশনের সচিব নাজমা মোবারেক বলেন, ভ্যাট সরাসরি জাতীয় বাজেটকে সমর্থন করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষাসহ বহু জনকল্যাণমূলক কর্মসূচির অর্থায়নে সহায়তা করে। জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বাড়লেও দেশ এখনও কর আহরণে পিছিয়ে রয়েছে।

তিনি বলেন, অর্থ উপদেষ্টা ও এনবিআর চেয়ারম্যানের দিকনির্দেশনায় বেশ কিছু দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সংস্কার বাস্তবায়িত হয়েছে। গত বছরের তুলনায় কর ছাড় ১৭ শতাংশ কমেছে এবং প্রয়োজনীয় খাতে যৌক্তিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়লে স্বতঃস্ফূর্ত কর অনুবর্তিতা বাড়বে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জাইদি সত্তার বলেন, মাথাপিছু আয় বাড়লেই কর-জিডিপি অনুপাত বাড়বে এমন ধারণা ভুল। ১৯৭০-এর দশক থেকে মাথাপিছু আয় দশগুণ বাড়লেও রাজস্ব আহরণ প্রায় স্থির রয়েছে, যা কাঠামোগত দুর্বলতার নির্দেশ দেয়। দক্ষতা বাড়াতে ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ডিজিটালাইজেশন ও ক্যাশলেস অর্থনীতির দিকে যাওয়া অপরিহার্য।

তিনি বলেন, ট্যাক্স পলিসি থেকে প্রশাসনকে পৃথক করা। অর্থাৎ রেভিনিউ পলিসি ডিভিশন প্রতিষ্ঠা। একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পদক্ষেপ। বর্তমানে এনবিআর রাজস্বের ২৮ শতাংশ বাণিজ্য কর থেকে পায়। যা অস্বাভাবিকভাবে বেশি, এটি কমাতে হবে।

এফআইসিসিআই(ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি) ভাইস প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আজমান বলেন, প্রতিষ্ঠানটির ১৯৮টি সদস্য কোম্পানি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্বের এক-তৃতীয়াংশ অবদান রাখে। তিনি এনবিআর’র ডিজিটালাইজেশনের অগ্রগতির ডায়নামিক ওয়েব পোর্টাল, অনলাইন ভ্যাট প্রকল্প, ই-পেমেন্ট সুবিধা এবং ১০০ শতাংশ অনলাইন আয়কর রিটার্ন জমার প্রশংসা করেন। এসব উদ্যোগ ভবিষ্যতের কর ব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি করবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

আইসিসি বাংলাদেশ সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, ভ্যাট প্রদানে ব্যবসায়ীদের আন্তরিকতা এবং ভ্যাট সংগ্রহে কর্মকর্তাদের সততা, দুটিই জরুরি। বহু দেশ শক্তিশালী ভ্যাট ব্যবস্থার মাধ্যমে দ্রুত উন্নতি করেছে।

তিনি বলেন, ভোক্তাদেরও ভ্যাট দিতে আগ্রহী হতে হবে। যথাযথ নথিপত্র রাখতে হবে। তবেই ফাঁকি রোধ সম্ভব। এসব নিশ্চিত হলে ভ্যাট জাতীয় উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে।