শিরোনাম

ঢাকা, ৯ ডিসেম্বর ২০২৫ (বাসস): জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান আজ দেশের ভ্যাট ও আয়কর ভিত্তি সম্প্রসারণের জরুরি প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
তিনি বলেন, আমদানি-নির্ভর রাজস্ব থেকে নির্ভরতা কমিয়ে আর্থিক স্থিতিশীলতা জোরদার এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ করভিত্তি অপরিহার্য।
তিনি আরও বলেন, ‘পর্যাপ্ত রাজস্ব আহরণ না হলে উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং প্রয়োজনীয় জনসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।’
ভ্যাট দিবস ও ভ্যাট সপ্তাহ উপলক্ষ্যে রাজধানীর রাজস্ব ভবনে আয়োজিত ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি জানান, দেশের উন্নয়ন ও প্রশাসনিক কার্যক্রম মূলত রাষ্ট্রের সংগৃহীত রাজস্বের ওপর নির্ভরশীল।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, স্বাধীনতার পর প্রথম দিকে বাংলাদেশ আমদানি শুল্কের উপর অত্যধিক নির্ভরশীল, যেখানে মোট রাজস্বের প্রায় ৯০ শতাংশই আমদানি পর্যায়ে সংগ্রহ করা হতো।
তিনি বলেন, এমন কাঠামোতে ধনী-গরিব সকলের ওপর একই ধরনের করের বোঝা চাপিয়ে দেয়, যা না টেকসই, না ন্যায়সংগত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভ্যাট ও আয়কর অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের প্রধান স্তম্ভে পরিণত হয়েছে। গত অর্থবছরে এককভাবে মোট রাজস্বের ৩৮ শতাংশ অবদান রেখেছে ভ্যাট।
তিনি জানান, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ভ্যাট আদায়ে প্রবৃদ্ধি শক্তিশালী ছিল, যদিও অক্টোবর-নভেম্বরে কিছুটা মন্থর হয়। তবুও জুলাই-নভেম্বর সময়ে ভ্যাট আদায় ২২ শতাংশ বেড়েছে, যা সম্প্রসারণের বড় সম্ভাবনা নির্দেশ করে।
এনবিআর চেয়ারম্যান জানান, দেশে বাস্তবে যে পরিমাণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তার তুলনায় মাত্র ৬ লাখ ৪৪ হাজার প্রতিষ্ঠান ভ্যাট নিবন্ধন করেছে-যা খুবই কম।
তিনি বলেন, গত বছর ভ্যাট নিবন্ধনের সীমা ৩ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৫০ লাখ টাকায় নামানো হয়েছে, ফলে প্রায় সব ব্যবসাই এখন ভ্যাট নেটের আওতায় আসার কথা।
‘তারপরও নিবন্ধনের সংখ্যা আনুপাতিকভাবে বাড়েনি। এ কারণে এ বছরের ভ্যাট দিবস ও ভ্যাট সপ্তাহে ভ্যাট নিবন্ধনকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ডিসেম্বরে অন্তত ১ লাখ নতুন ব্যবসাকে ভ্যাট ব্যবস্থার আওতায় আনাই আমাদের লক্ষ্য-উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, ভ্যাটের একটি একক হার চালু করা এবং উৎপাদন থেকে বিতরণ পর্যন্ত সব পর্যায়ে পূর্ণ ইনপুট ক্রেডিট ব্যবস্থা কার্যকর করা প্রয়োজন। এতে প্রতিযোগিতা বিকৃতির সুযোগ কমবে এবং স্বয়ংক্রিয়করণ আরও সহজ হবে।
আবদুর রহমান খান বলেন, একটি সাধারণ ভুল ধারণা হলো-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যাট ‘পরিশোধ’ করে। বাস্তবে ব্যবসা কেবল সরকারের পক্ষে ভ্যাট সংগ্রহ করে, আর এর চূড়ান্ত ভার ভোক্তার ওপর পড়ে। ভ্যাট বাস্তবায়নে বিকৃতি তৈরি হলে বাজারে অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হয়।
ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ভ্যাট সঙ্গতি সহজ করতে এনবিআর খাতভিত্তিক ভ্যাট সিস্টেম চালুর পরিকল্পনা করছে, যেখানে ব্যবহারকারীরা লেনদেনের তথ্য ধারণ করলে সিস্টেম নিজে থেকেই ভ্যাট রিটার্ন তৈরি করবে।
তিনি জানান, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যয়বহুল সফটওয়্যার বা পরামর্শকের খরচ বহন করতে না পারায় এনবিআরই এ সিস্টেমের উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ, হোস্টিং ও ক্লাউড সেবার সব ব্যয় বহন করবে।
রহমান খান বলেন, ভ্যাট ও আয়কর অডিটকে আধুনিকায়নের কাজ চলছে। কাগজভিত্তিক অডিট নির্বাচন বন্ধ করা হয়েছে এবং ঝুঁকিভিত্তিক ডিজিটাল অডিট পদ্ধতিতে রূপান্তর করা হচ্ছে।
ভ্যাট রিফান্ড সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় করতে কাজ চলছে, যাতে রিফান্ড সরাসরি করদাতার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠানো যায়। ভবিষ্যতে আয়কর রিফান্ডও একইভাবে স্বয়ংক্রিয় করা হবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, রাজস্ব কর্তৃপক্ষ কোনো চাপ সৃষ্টি বা হয়রানি করার পরিবর্তে রাজস্ব ফাঁকি বন্ধ করার দিকে মনোনিবেশ করছে।
তিনি বলেন, ভ্যাট, কাস্টমস, সেন্ট্রাল ও ট্যাক্স গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন ইউনিট তাদের নজরদারি বাড়িয়েছে, যার ফলে প্রচুর পরিমাণে ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। হালনাগাদ তথ্য শিগগিরই জানানো হবে।
রহমান আরও বলেন, চলতি বছর রাজস্ব আদায়ে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে-ব্যাংক খাত থেকে কোম্পানি কর আদায় দুর্বল, সংকোচনমূলক বাজেটের কারণে উন্নয়ন ব্যয় কমেছে, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নও ধীর। বড় ব্যবসা গোষ্ঠীগুলিও আর্থিক চাপের মুখে রয়েছে।
এসব সত্ত্বেও, প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের ওপরে ছিল, যদিও কাস্টমস শুল্ক কমায় তা কিছুটা ধীর হতে পারে। তারপরও নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশের ওপরে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে এবং পুরো অর্থবছর শেষে প্রায় ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশা এনবিআরের।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখনো কম, এবং অর্থনীতির কিছু অংশ কেন করের বাইরে রয়ে গেছে-তা খুঁজে বের করতে গবেষণা বাড়ানো দরকার। দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে হওয়ায় বৈশ্বিক বাণিজ্য বাধ্যবাধকতার কারণে আমদানি শুল্ক অনিবার্যভাবে কমবে, তাই অভ্যন্তরীণ আয়কর ভিত্তি শক্তিশালী করা অপরিহার্য।
তিনি জানান, দীর্ঘদিনের বিলম্বের পর বিশ্ব ব্যাংক-অর্থায়িত এনবিআরের স্বয়ংক্রিয়করণ প্রকল্পটি শিগগিরই শুরু হবে এবং এর আওতায় এনবিআরের সব অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় করা হবে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমটি বাংলাদেশে সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি-এটি আরও দক্ষভাবে ব্যবহারের প্রয়োজন।
এনবিআর চেয়ারম্যান কর আইন সহজ করা, আয়কর ভিত্তি সম্প্রসারণ করতে, কমপ্লায়েন্স জোরদার এবং একটি ন্যায়সঙ্গত ও কার্যকর রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে যৌথভাবে কাজ করার জন্য ব্যবসায়ী ও গণমাধ্যমের সহযোগিতা কামনা করেন।