বাসস
  ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫:২৩

প্রাচীন শিলা আর প্রত্নসম্পদে সমৃদ্ধ পঞ্চগড়ের ‘রকস মিউজিয়াম’

পঞ্চগড়ে দেশের একমাত্র পাথরের জাদুঘর ‘পঞ্চগড় রকস মিউজিয়াম’। ছবি: বাসস

\ আবু নাঈম \

পঞ্চগড়, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : উত্তরের সীমান্ত জেলা পঞ্চগড় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শনের জন্য পরিচিত। শীত মৌসুম শুরু হলেই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনায় মুখর হয়ে ওঠে এ জেলা। জেলার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানের সঙ্গে পর্যটকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করছে দেশের একমাত্র পাথরের জাদুঘর ‘পঞ্চগড় রকস মিউজিয়াম’।

পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজ প্রাঙ্গণে ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই জাদুঘরটি দেশের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস ও প্রত্নসম্পদের একটি ব্যতিক্রমধর্মী সংগ্রহশালা। কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ড. নাজমুল হকের একক উদ্যোগে একটি কক্ষে যাত্রা শুরু করে রকস মিউজিয়ামটি। পরবর্তীতে এটি পর্যটক, শিক্ষার্থী ও গবেষকদের আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয়।

জাদুঘরটিতে নতুন ও পুরোনো বিভিন্ন ধরনের পাথর ও শিলার সমাহার রয়েছে। প্রতিটি পাথরের পাশে সংযুক্ত রয়েছে পরিচিতি ফলক, যেখানে সংগ্রহের স্থান ও সংশ্লিষ্ট তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে সংরক্ষিত আছে আগ্নেয় শিলা, পাললিক শিলা, নুড়ি পাথর, সিলিকা নুড়ি ও বালি, হলুদ ও গাঢ় হলুদ বালি, কাঁচবালি, খনিজবালি, লাইমস্টোন, পলি ও কুমোর মাটি এবং কঠিন শিলাসহ নানা ধরনের প্রত্নসম্পদ।

পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের মূল ফটক পার হলে ডান পাশে ছোট-বড় পাথরে সাজানো একটি খোলা অংশ চোখে পড়ে। জাদুঘরের সামনে গোলচত্বর আকৃতিতে বসানো বড় আকারের পাথরগুলোর বয়স আনুমানিক ২০ থেকে ২৫ বছর। প্রতিটি পাথরের পাশে রয়েছে সংক্ষিপ্ত বিবরণ সংবলিত নামফলক।

রকস্ মিউজিয়ামে দুটি গ্যালারি রয়েছে। ঘরের ভেতরের গ্যালারিতে বিভিন্ন আকৃতির আগ্নেয় ও পাললিক শিলা, তরঙ্গায়িত চ্যাপ্টা পাথর, লাইমস্টোন ও কঠিন শিলার পাশাপাশি আদিবাসীদের ব্যবহৃত তৈজসপত্রসহ নানা সামগ্রী সংরক্ষিত আছে। এছাড়াও নদীর নিচে ও ভূগর্ভ থেকে উদ্ধারকৃত অশ্মীভূত কাঁঠ, প্রায় দুই হাজার বছরের পুরোনো ইমারতের ইট-পাথরের ভাস্কর্য এবং পোড়ামাটির নকশা প্রদর্শন করা হচ্ছে।

জাদুঘরের অন্যতম আকর্ষণ হলো প্রায় হাজার বছরের পুরোনো একটি ঐতিহ্যবাহী ডিঙ্গি নৌকা। ২৫ ফুট দৈর্ঘ্যের এ নৌকাটি ১৯৯৯ সালে সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের চাওয়াই নদীর মাহানতের ঘাট এলাকা থেকে মাটির ৮ ফুট নিচে উদ্ধার করা হয়। একটি আস্ত শালগাছ খোদাই করে নির্মিত এই নৌকাটি প্রাচীনকালে আদিবাসীদের ব্যবহৃত ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বাইরের গ্যালারিতে বড় আকারের বেলে পাথর, গ্রানাইট, কোয়ার্জাহিট, ব্যাসল্ট, শেল ও সিলিকায়িত কাঠ প্রদর্শন করা হয়েছে। এসব পাথরের কোনোটি গোলাকার, কোনোটি চ্যাপ্টা কিংবা লম্বাকৃতির। কিছু পাথরের গায়ে রয়েছে সাংকেতিক চিহ্ন।

চলতি শীত মৌসুমে প্রতিদিনই জাদুঘরে ভিড় করছেন দর্শনার্থীরা। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর, জিরোপয়েন্ট ও তেঁতুলিয়ার চা বাগান ঘুরে এই জাদুঘর পরিদর্শনে আসছেন।

গত মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সাদিয়া সানজিদা পরিবার নিয়ে জাদুঘরটি পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি বলেন, অনেক দিন ধরেই রকস মিউজিয়ামের কথা শুনে আসছিলাম। সরাসরি দেখে এর ইতিহাস জানতে পেরে ভালো লেগেছে। অভিভূত হয়েছি যে, এত বড় বড় এবং প্রাচীন পাথরের সংগ্রহশালা আমাদের দেশে রয়েছে।

ঘুরতে আসা দিনাজপুরের হাকিমপুর মহিলা কলেজের শিক্ষক নাজ সুলতানা বিথী বলেন, আমার সন্তানকে নিয়ে এসেছি। মাটির নিচ থেকে উদ্ধার হওয়া পাথরগুলো দেখে বিস্মিত হয়েছি। বাচ্চাকে পুরোনো পাথরের সংগ্রহ শালা দেখাতে ভালো লাগছে।

ঢাকা থেকে আসা মুফাসসির রিহান বলেন, ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে আমি বেশি পছন্দ করি। রকস মিউজিয়ামের তথ্য ইউটিউবে দেখে কৌতূহল তৈরি হয়, এজন্য এখানে আসা। এখানে এসে ভালো লেগেছে, পাথরসহ অনেক পুরনো জিনিসের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছি।

পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান গোলাম কিবরিয়া জানান, তৎকালীন অধ্যক্ষ ড. নাজমুল হক বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা নিদর্শন নিয়ে রকস মিউজিয়ামটি প্রতিষ্ঠা করেন। ভূখণ্ডের বয়স নির্ণয়, ভূ-বৈশিষ্ট্য অনুসন্ধান, ঐতিহ্য ও নৃ-তাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই জাদুঘরটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

পরিসংখ্যান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আহসান হাবিব প্রধান বলেন, রকস মিউজিয়াম পঞ্চগড় ভ্রমণে আসা দর্শনার্থীদের জন্য একটি অন্যতম নিদর্শন। মিউজিয়ামটি পঞ্চগড়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখানে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে। এটি যদি আমরা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারি, তাহলে এ জেলার সুনাম আরও বাড়বে।