শিরোনাম

\ বাবুল আখতার রানা \
নওগাঁ, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ (বাসস): সমাজের এমন কিছু নারী রয়েছেন, যারা প্রতিনিয়তই প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে জীবন যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ সেই যুদ্ধে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। কেউ কেউ সমাজের আর ১০জন নির্যাতিত ও অবহেলিত নারীদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন। কেউ শত বাধা বিপত্তিকে পায়ে দলে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। এমন সব নারীদের সাহসিকতার, অবদান এবং ভালো কাজের স্বীকৃতি ও প্রেরণা দিতে পাশে আছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর এবং বিভিন্ন সংগঠন।
আমাদের সমাজে এমন অসংখ্য নারী আছেন যারা নিজেদের মনোবল, ইচ্ছাশক্তি এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে হয়ে উঠেছেন স্বাবলম্বী। আর এসব নারীদের তৃণমূল পর্যায় থেকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কাজ করে চলেছে। জীবন যুদ্ধে জয়ী নারীদের স্বীকৃতি প্রদানের জন্য নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে এই অধিদপ্তর।
সম্প্রতি নওগাঁর রাণীনগরে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ‘অদম্য নারী পুরস্কার’ কার্যক্রমের আওতায় আন্তর্জাতিক নারী প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবসে উপজেলার পাঁচ অদম্য নারীকে পুরস্কার ও সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছে।
উপজেলার গুয়াতা গ্রামের মোছা. মোমেনা বিবি একজন রত্নগর্ভা মা। মাত্র ১০ বছর বয়সে উপজেলার গুয়াতা গ্রামের আহম্মদ আলী আকন্দ নামের এক কৃষকের সঙ্গে পরিবার তাকে বিয়ে দেয়। পড়ালেখা করার কোনো সুযোগ পাননি। বিয়ের পর ঘরে আসে তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। অনেক কষ্ট করে জায়গা জমি বিক্রি করে ছেলে-মেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন।
বাসসের সাথে আলাপকালে মোমেনা বিবি বলেন, ‘এক বছর বন্যায় সব ফসল নষ্ট হয়ে যায়। একবেলা খেয়ে সন্তানদের জন্য সামান্য হলেও খাবারের ব্যবস্থা করেছি। বছরের পর বছর এক কাপড় সেলাই করে পরেছি। টাকার অভাবে দূরের স্কুলে যাওয়ার জন্য ছেলে মেয়েদের একটি সাইকেলও কিনে দেওয়া সম্ভব হয়নি। সবাই পায়ে হেঁটে কয়েক কিলোমিটার দূরের স্কুলে গিয়ে পড়ালেখা করেছে। জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। আমার কষ্ট সফল হয়েছে।’
আজ তার পাঁচ সন্তানই উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। প্রথম পুত্র ডা. মুনীর আলী আকন্দ রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করে বিদেশি ডিগ্রি অর্জন করে বর্তমানে নওগাঁর ডেপুটি সিভিল সার্জন হিসেবে কর্মরত। দ্বিতীয় পুত্র আব্দুল মজিদ মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক হিসেবে ও তৃতীয় ছেলে ডালিম উদ্দীন বুয়েট থেকে পড়ালেখা শেষ করে বর্তমানে বিআরটি বিভাগে সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত। চতুর্থ সন্তান রোকসানা পারভীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে অনলাইন ব্যবসায় যুক্ত। কনিষ্ঠ সন্তান কাকলী দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পড়ালেখা শেষ করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে কর্মরত আছেন।
মোমেনা বলেন, ‘জীবনে কষ্ট করেছি বলে আজ সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলাম। সন্তানদের সফলতায় আমি আজ গর্বিত মা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি। সবকিছুর জন্য সব সময় মহান আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া জানাই।’
শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী উপজেলার খাগড়া গ্রামের অদম্য নারী মোছা. শাহানাজ বেগম। তার বাবা সামান্য বেতনের সরকারি কর্মচারী ছিলেন। পরিবারে অনেকগুলো ভাই-বোন ছিলো। ফলে পরিবারে সব সময় অভাব লেগেই থাকতো। এ কারণে তাকে অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করতে হয়েছে।
শাহনাজ বলেন, ‘অভাবের সংসারে আমার পড়ালেখার খরচ দেওয়ার অবস্থা ছিলো না। তাই টিউশনি করে পড়ালেখার খরচ জোগাড় করেছি। সমাজের নানা কুসংস্কার ও বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে। নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার দৃঢ় মনোবল আর কঠোর পরিশ্রমের ফলে আজ এখানে পৌঁছাতে পেরেছি।’
তিনি বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করে বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। লক্ষ্য অটুট রেখে দৃঢ় মনোবল নিয়ে পথচলা শুরু করলে জীবনে সফলতা একদিন না একদিন আসবেই।’
অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী উপজেলার জামালকুড়ি গ্রামের অদম্য নারী মোছা. সাবিনা বিবি। এক সময় তিনি পরিবার নিয়ে খুব অভাবে দিনাতিপাত করতেন। তিনি ডাসকো নামক এক এনজিওর সহযোগিতায় দুইটি ছাগল কিনেছিলেন। সেই দুইটি ছাগল থেকে বর্তমানে তার ১৭টি ছাগল, ১টি গরু ও ৭০টি হাঁস রয়েছে। এই গবাদিপশুগুলো পর্যায়ক্রমে বিক্রি করে তিনি প্রতি মাসে গড়ে ১৫ হাজার টাকা আয় করছেন। এছাড়া দুই বিঘা জমিও বন্ধক নিয়েছেন। বর্তমানে তার সংসারে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ফিরেছে। তার সন্তানরা পড়ালেখা করছে। তার পরিবার থেকে অভাব নামক বাধা দূর হয়েছে। প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকলে জীবনে সফল হওয়া সম্ভব।
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখা উপজেলার আতাইকুলা গ্রামের অদম্য নারী মোছা. ফেনী বিবি। তিনি একটি উন্নয়ন সংস্থার পরিবেশ প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে বিভিন্ন এলাকায় সচেতনতামূলক উঠান বৈঠক করছেন। বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিসহ বাল্য বিয়ে প্রতিরোধ ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে উঠান বৈঠকও অব্যাহত রেখেছেন। এলাকার দু:স্থ ও অসহায় জনগণের বিভিন্ন দপ্তর থেকে সরকারি সেবা পেতে সহায়তা করে আসছেন। সমাজ উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করার চেষ্টা করে আসছেন তিনি।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উপজেলার সরিয়া গ্রামের অদম্য নারী মোছা. ছালমা। খুব অল্প বয়সে তার পরিবার বিয়ে দেয়। বিয়ের এক বছর পর থেকে স্বামী শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন শুরু করে। এরই মধ্যে এক পুত্র সন্তান আসে তাদের সংসারে। তারপরও স্বামীর নির্যাতনের মাত্রা একটুও কমে না। এক পর্যায়ে তিনি তালাক নিতে বাধ্য হন। তালাকের পর তিনি বাবার বাড়িতে এসে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল পালন শুরু করেন। ছেলেকে শত অভাব-অনটনের মধ্যেও পড়ালেখা করে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কাজও চালিয়ে যান। বর্তমানে তার ৩টি গরু ও ৭০টি হাঁস রয়েছে। এছাড়া সংসারের কাজের ফাঁকে সেলাই মেশিনের কাজ করেন তিনি। তার এই আয় দিয়ে নিজের সন্তানের পাশাপাশি ছোট দুই বোনের পড়ালেখার খরচ দিচ্ছেন। তার এক বোন রুয়েট থেকে পড়ালেখা শেষ করেছে। আরেক বোন বিএ পড়েন। তার সন্তান এইচএসসি পাশ করেছে। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে তিনি সংসার জীবনে একজন সফল যোদ্ধা। বর্তমানে তিনি পরিবার নিয়ে ভালো আছেন।
রাণীনগর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শাহিনা আকতার বাসসকে বলেন, আজকের এই অদম্য নারীরা সমাজের পিছিয়ে পড়া অন্য নারীদের জন্য এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তাদের খুঁজে বের করে সম্মানিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্বের একটি অংশ। তাই আমরা চেষ্টা করেছি এই নারীদের ক্ষুদ্র হলেও সম্মানিত করার। আমাদের চেষ্টা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে।