বাসস
  ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪:৪৬

বাধা ডিঙিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী উদ্যোগে সফল হচ্ছেন গ্রামীণ নারীরাও

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রশিক্ষণকে কাজে লাগিয়ে গ্রামীণ নারীরা এখন নিজেরা উদ্যোক্তা হওয়ার পথ বেছে নিয়েছে। ছবি : ইউনিসেফ

ঢাকা, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস): একুশ শতকে জীবন-জীবিকা নিয়ে গোটা বিশ্ব জুড়ে এসেছে নতুন নতুন ভাবনা। নেয়া হয়েছে নতুন ধরনের কাজের উদ্যোগ।

বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। চাকরির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে মানুষ সরকারি-বেসরকারি বা ব্যক্তিগত উদ্যোগ কাজে লাগিয়ে নিজেরা উদ্যোক্তা হওয়ার পথ বেছে নিয়েছে। 

তবে বড় শিল্পনির্ভর কাজে যুক্ত হওয়ার সুযোগ গ্রামীণ মানুষদের ক্ষেত্রে কম। সে কারণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোর প্রতি তারা ঝুঁকেছে বেশি। বাংলাদেশের গ্রামগুলো কৃষিপ্রধান হলেও ক্ষুদ্র ব্যবসার অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছে। যেমন, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, হস্তশিল্প তৈরি, নার্সারি স্থাপন, মুদির দোকান, পোশাকের দোকান, সেলাই ও বুটিকের কাজ, ফাস্ট ফুডের মোবাইল দোকান, হোম ক্যাফে, কসমেটিকসের দোকান, অনলাইন ব্যবসা, ব্যালান্স রিচার্জ ও বিকাশের দোকান ইত্যাদি। তবে গ্রামীণ এলাকায় এ সকল উদ্যোগের সুবিধা পুরুষরা যতোটা গ্রহণ করেছে, নারীরা ততোটা গ্রহণ করতে পারেনি। এক্ষেত্রে নারীর কাজের সীমার প্রতি সমাজের কিছু চিরাচরিত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাব রেখেছে। 

উদ্যোক্তা হওয়ার জন্যে কিছু নির্দিষ্ট বিষয় নারীর জন্যে নির্ধারণ করে দেয় গ্রাামীণ সমাজ। যেমন সেলাই ও বুটিকের কাজ, হস্তশিল্প তৈরির কাজ, হোম ডেলিভারির রান্নার কাজ, অনলাইনে পোশাক বা সাজসজ্জার উপকরণ বিক্রির কাজ ইত্যাদি। যে সকল কাজ ঘরের বাইরে বা দূরদূরান্তে না গিয়ে করা সম্ভব বলে ভাবা হয়, সে সকল কাজে গ্রামীণ নারীর অংশগ্রহণে সমাজ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে না। 

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে কিংবা স্বাধীন ভাবনা-চিন্তার বশবর্তী অনেক গ্রামীণ নারী ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে কাজ শুরু করেছে। তাদের প্রতি সমাজের বিরূপ ভাব পরিলক্ষিত হয় ঠিকই, কিন্তু শক্তি সাহস ও বুদ্ধিমত্তার সাথে অনেকেই বাধা পেরিয়ে উদাহরণ তৈরি করতে পেরেছে। সকলে যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সফল ভাবে ব্যবহার করতে পারছে, বিষয়টা এমন নয়। অনেক গ্রামীণ নারী সরাসরি গ্রাহকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বা যোগাযোগ তৈরি করে তার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। 
যেমন মায়া রাণী পাল। বয়স ৪৭ বছর। লেখাপড়া করেছেন ক্লাস থ্রি পর্যন্ত। পালবাড়ির মেয়ে হিসেবে তিনি মাটির জিনিস গড়তে জানেন, পোড়াতেও জানেন। বাবা দাদাদের সাথে হাতে হাতে কাজ করে দিলেও কৃতিত্বের ভাগ তার ভাগ্যে জোটেনি। শৈশবেই বুঝে গেছিলেন টাকা-পয়সা ও মানসম্মানের গুরুত্ব। তবে যে কাজে তার কৃতিত্ব নেই, স্বাধীনতা নেই, সেই কাজ মায়া করতে চাননি। তাই খুঁজেছেন মনমতো কাজ যা করে তিনি নিজে পয়সা কামাই করতে পারবেন। বিয়ের পর মায়া স্থানান্তরিত হন ঢাকার বসিলায়। স্বামীর রোজগার যথেষ্ট  মনে হলেও খুব বেশি সঞ্চয় করা যেত না তা থেকে। একটি সন্তান জন্মানোর পর মায়া বুঝতে পারেন তার স্বামী জুয়া ও নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছেন। নেশা ছাড়ানোর জন্যে চেষ্টা করলে অশান্তি বাড়তে থাকে এবং এক পর্যায়ে মায়ার স্বামী তার কাছ থেকে সন্তানকে কেড়ে নিয়ে মায়াকে ত্যাগ করে। মায়া ফিরে আসে তার পিত্রালয়ের গ্রামীণ জীবনে। গ্রামটির নাম ময়মন্দি। এ ঘটনায় সকলেই মায়াকে দোষী সাব্যস্ত করে। তাকে একরোখা, জেদি ও মুখরা হিসেবে দোষ দিতে থাকে।

কয়েক বছর পর মায়ার সন্তানটি মারা যায় এবং এর জন্যেও দায়ী করা হয় মায়াকে। মায়া বাপের বাড়িতে থাকতে থাকতে বুঝে যায় নিজের খরচ নিজেকেই যোগাড় করতে হবে। তাই রোজগারের পথ খুঁজে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মায়া রাণী পাল। ভাই বা তাদের বউদের কাছে হাত না পেতে নিজের সাথে পাল্লা  দিয়ে কাজে নেমে পড়ে। শহরে থাকার সময় আশেপাশের অনেক নারীকে জিনিস ফেরি করতে দেখেছিল সে। গ্রামে খোঁজ-খবর নিয়ে দেখে, থানার বাজারে গেলে হরেক মালের আড়তে যাওয়া যায় আর জিনিস কিনে বিক্রিও করা যায়। সেইদিনই ছোট একটা ঠেলা আর মেয়ে ও শিশুদের জন্যে কিছু সাজসরঞ্জাম কিনে মালামাল সাজাতে শুরু করে মায়া। আশেপাশের গ্রামগুলোয় ঠেলা নিয়ে ঘুরে ঘুরে জিনিস বিক্রি করা শুরু করে। যেমনটা মফস্বল শহরগুলোতে এককালে চুড়ি-ফিতাওয়ালারা কাচের বাক্স হাতে ফেরি করতে আসতো সেরকম। এর কিছুদিন পরে মায়া আরও একটু সাশ্রয়ী উপায় বেছে নিলো। মিলে ছাপা সুতি শাড়ি চুক্তি ভিত্তিক কিনে এনে বিক্রি করতে শুরু করল। শাড়ি বিক্রির জন্যে ঠেলা নয়, বোঁচকা বেছে নিলো মায়া। কাঁধে শাড়ির বিরাট বোঁচকা নিয়ে আশেপাশের খ্রিষ্টান গ্রাম থেকে শুরু করে বাগমারা পর্যন্ত ঘুরে আসতে পারে সে পায়ে হেঁটে। প্রতিদিন যে শাড়ি বিক্রি হয় তা নয়, তবে এতে গ্রাহকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ থাকে। তাছাড়া ভীষণ পরিশ্রমের কাজ হলেও গ্রামে বাড়ি বাড়ি ঘোরার, মানুষের সাথে কথা বলার একটা প্রবল ইচ্ছাও কাজ করে মায়া রাণী পালের মনে। বিকেলে বাড়ি ফিরে স্নান সেরে খাবার খেতে খেতে সন্ধ্যা ঘনায়। মায়া ভাবে, স্বামী পরিত্যক্তা হলেও তার এই স্বাধীন কাজের জন্যে পরিবারের সবাই তাকে খানিকটা সমীহ করে চলে। সহসা কেউ তাকে ঘাঁটাতে সাহস করে না। সমাজের কেউ কেউ টিপ্পনী কাটলেও তারা মায়ার মুখের ওপর কিছু বলতে পারে না। মায়ার ভরণপোষণের দায়িত্ব কাউকে নিতে হয়নি। সে-ই উলটে  পরিবার ও প্রতিবেশীদের সমস্যা হলে নিজে থেকে সহায়তা করে।

মায়ার গল্প থেকে আমরা বুঝতে পারি, ছোট ছোট উদ্যোগ নারীর জীবনকে প্রতিকূল পরিবেশেও সচল রাখে, এগিয়ে নিয়ে যায়। নারীদের সাহস ও শক্তি সঞ্চয় করে পথে বেরিয়ে আসা খুব জরুরি। গৃহস্থালী কাজের  পাশাপাশি তারা পরিবারের কল্যাণের জন্যে অর্থ উপার্জনের কাজে নানা ভাবে সহায়তা করে চলেছে। পরিবারে সেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বীকৃতি পায় না। স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে অর্থ উপার্জনকারী কোনো পেশা যতক্ষণ না নারী বেছে নেবে, এই অবহেলা বজায় থাকবে। বাংলাদেশে অনেক গ্রামীণ নারী নানা রকম ক্ষুদ্র উদ্যোগ নেবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। 

সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের নীতিমালা ও তার প্রয়োগ এবং নানা কর্মসূচী বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারীর এই এগিয়ে যাওয়ার পথ আরও সুগম হবে বলে মনে করা হচ্ছে।