শিরোনাম

মো. সাইফুল ইসলাম
যশোর, ৮ ডিসেম্বর ২০২৫ (বাসস): প্রকৃতিতে সবেমাত্র শীত জাকিয়ে বসতে শুরু করেছে। কিন্তু যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী-পানিসারা এলাকার বিস্তীর্ণ মাঠে এখনও শীত-কুয়াশা হানা দেয়নি। নানানরকম ফুলের ঝলমলে রং আর সুগন্ধের উষ্ণতা যেন পৃথিবীর সব কালিমা উপেক্ষা করে আপন মহিমায় উজ্জ্বল। গাঁদা, গোলাপ, রজনীগন্ধা, জারবেরা, গ্লাডিওলাস, চন্দ্রমল্লিকা আর সূর্যমুখীর অপরূপ সাজে সেজে উঠেছে মাঠের পর মাঠ। পুরো এলাকা যেন ফুলের সমুদ্র।
বাংলাদেশের ফুলের রাজধানী খ্যাত গদখালীতে জমে উঠেছে ফুলের বাজার। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল এই পাঁচ মাস ফুলচাষিদের সোনালি সময়। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, খ্রিষ্টীয় ও বাংলা নববর্ষ, ভালোবাসা দিবস, বসন্ত বরণ এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মতো বিশেষ দিনগুলোতেই এখানকার ফুল সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। বছরের প্রায় অর্ধেক ব্যবসা এই দিনগুলোতেই হয়। গদখালী-পানিসারার ফুলচাষিদের তাই এখন দম ফেলার ফুরসত নেই।
পানিসারা গ্রামের ফুল চাষি মেহেদী হাসান এবার ১৫ কাঠা জমিতে চায়না গোলাপের চাষ করেছেন। আবহাওয়া ভালো থাকায় এবার ফলনও ভালো হয়েছে।
বাসসের সাথে আলাপকালে মেহেদী হাসান বলেন, ‘সামনের দিনগুলোতে যদি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকে, তবেই আমরা ভালো দামে ফুল বিক্রি করে লাভ দেখতে পাব। কিন্তু পরিস্থিতি যদি অস্থিতিশীল হয়, তবে ফলন ভালো হয়েও কোনো লাভ নেই। ফুল পরিবহন করা না গেলে ক্ষেতেই সব নষ্ট হয়ে যাবে।’
দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে ফুল চাষের সাথে যুক্ত আজিজ সর্দার। এবছর তিনি ৫ বিঘা জমিতে জারবেরা, রজনীগন্ধা, চায়না গোলাপ ও গাঁদার চাষ করেছেন। ঝুঁকি নিয়ে কিছু জমিতে প্রথমবারের মতো সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেছেন। তার বিশাল সূর্যমুখী গাছগুলো এখন মাঠে দারুণ শোভা ছড়াচ্ছে। নতুন বছরের শুরু থেকেই এই সূর্যমুখী ফুল বাজারে উঠবে। প্রতি পিস ফুল ১০০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি।
পানিসারার আরেক ফুলচাষি সাইফুল ইসলাম ৩৩ শতক জমিতে শেড তৈরি করে জারবেরা ফুলের চাষ করেছেন। শেড নির্মাণেই তার খরচ হয়েছে প্রায় ১১ লাখ টাকা। চারা লাগানোর তিন মাস পর থেকেই ফুল ধরতে শুরু করে। বর্তমানে তিনি একদিন পর পর এক থেকে দেড় হাজার ফুল তুলে বাজারে নিচ্ছেন। প্রতিটি ফুল ১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সামনে বিশেষ দিনগুলো আসায় দাম আরও বাড়বে বলে তিনি আশাবাদী।
গদখালীর ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম বাসসকে বলেন, গদখালী ও পানিসারা এলাকায় প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমিতে ছয় হাজারেরও বেশি চাষি ফুল চাষ করেন। এই ফুল শুধু আশপাশের জেলায় নয়, ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব জেলাতেই সরবরাহ করা হয়।
তিনি বলেন, আবহাওয়া এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে এই এলাকা থেকে বছরে চার থেকে পাঁচশ’ কোটি টাকার ফুল কেনা-বেচা হয়। যার অর্ধেকটাই আসে এই ডিসেম্বরের শুরু থেকে এপ্রিলের মধ্যেকার বিশেষ দিবসগুলোতে।
আব্দুর রহিম জানান, ‘এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফুলের উৎপাদন দারুণ হয়েছে। এখন শুধু দেশের স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে বিশেষ দিবসগুলোতে চাষিরা ভালো লাভ ঘরে তুলতে পারবেন।’
এদিকে ডিসেম্বরের শুরু থেকে গদখালী ফুলের বাজার জমজমাট হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার আগে থেকেই চাষিরা তাদের জমি থেকে টাটকা ফুল নিয়ে বাজারে আসতে শুরু করেন। সকাল ৯টার মধ্যেই বেশিরভাগ ফুলের কেনা-বেচা শেষ হয়ে যায়। এরপর সেই ফুল সুন্দর প্যাকেটে সাজিয়ে নসিমন, করিমন, ট্রাক বা বাসের ছাদে করে ছুটে চলে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।
মৌসুমের শুরুতে বাজারে ফুলের আমদানি কিছুটা কম থাকলেও, ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, কিছুদিনের মধ্যেই ফুলের আমদানি কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। আর গদখালীর ফুল সারাদেশে উৎসবের বার্তা পৌঁছে দেবে।