শিরোনাম

ঢাকা, ২ ডিসেম্বর, ২০২৫(বাসস) : টেকসই গণতন্ত্রের জন্য সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার।
আজ মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজনের উদ্যোগে আয়োজিত ‘সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণ : নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে এ কথা বরেন তিনি।
সুজন সহ-সভাপতি বিচারপতি এম এ মতিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য রাখেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. দিলারা চৌধুরী, আলোকচিত্রী ড. শহীদুল আলম, লেখক ও সাবেক সচিব আবদুল আউয়াল মজুমদার, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমীন টুলী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. একেএম ওয়ারেসুল করিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ, ডা. হালিদা হানুম আখতার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ মোহাম্মদ সাহান ও ভয়েস ফর রিফর্ম-এর অন্যতম উদ্যোক্তা ফাহিম মাশরুর।
বিচারপতি এম এ মতিন বলেন, ‘নির্বাচন প্রক্রিয়াকে পরিশুদ্ধ করতে হলে যথাযথ আইন তৈরি করা লাগবে। নির্বাচনে নিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতের জন্য বিধি নয়, আইন তৈরি করতে হবে। কারণ, আইনে শাস্তির বিধান থাকলে কর্মকর্তারা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবে। তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার বিধান আরপিওতে যুক্ত করে তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে এবং এই বিধানের যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা-সেজন্য জনগণকে সোচ্চার হতে হবে। নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ করার জন্য ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন করার বিধান করতে হবে।’
ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, অভ্যন্তরীণ সংকট ও বহির্বিশ্বের নানা সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আগামী জাতীয় নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য রাজনৈতিক ঐক্য ও নির্বাচনের আবহ তৈরি করা দরকার। বর্তমানে দলগুলো ইস্যুভিত্তিক আলোচনা থেকে যেকোনো মূল্যে নির্বাচনে জিতে আসার চেষ্টা করছে, যা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কার হবে, কিন্তু সেটা হয়নি। নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। নির্বাচনে এআই-এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্বাচনের কমিশনের দক্ষতা বাড়াতে হবে।’
ড. শহীদুল আলম বলেন, ‘সত্যিকার অর্থেই নির্বাচনে দুটো জিনিস ব্যবহার হয়, একটা হলো টাকা, আরেকটা হলো লাঠি। এ দুটো থেকে কীভাবে আমরা রক্ষা পাব সে নিয়ে ভাবতে হবে। নির্বাচনী ব্যয়ের সীমা রয়েছে, কিন্তু তা মানছে না। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি নাগরিকদেরকেও দায়িত্ব পালন করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের নাগরিকরা এমনকি আমাদের একজন রিকশাওয়ালাও এখন অনেক সচেতন। কারণ সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এই রিকশাওয়ালারা, এ দেশের সাধারণ মানুষেরাই ক্ষমতাসীনদের হটিয়ে দেয়।’
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হওয়া দরকার বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন নয়, নির্বাচনের প্রথম পক্ষ হলো সরকার। কারণ সরকারের সদিচ্ছা মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করে। দ্বিতীয় পক্ষ হলো মাঠ প্রশাসন। তারা যদি দলদাস হয়ে যায়, সৎভাবে দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনকে কবর থেকে তুলে এনে সিইসি করা হলেও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। তাই প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। তবে নির্বাচন কমিশনকেও অনিয়ম রোধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।’
জেসমীন টুলী বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে অনেকগুলো সমস্যা রয়েছে। প্রধান সমস্যা হলো নৈতিকতার অভাব। দ্বিতীয় সমস্যা হলো সামাজিক বৈষম্য। সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকাও একটি বড় সমস্যা।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত সৎ, যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের মনোনয়ন দেওয়া এবং যে কোনো মূল্যে জয়ী হওয়ার মানসিকতা পরিহার করা। তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে যদি রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী মনোনয়ন দিত, তাহলে দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতো না।’
ড. ওয়ারেসুল করিম বলেন, ‘৫৪, ৭০ ও ৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এসব নির্বাচনের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল নির্বাচনে সরকারের হস্তক্ষেপ না থাকা, প্রশাসনের দলনিরপেক্ষ আচরণ এবং ভোটারদের আস্থা।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনকে ছোটোখাটো বিষয় থেকে নজর সরিয়ে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করতে হবে। ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের ব্যাপারে কোনো আপস করা যাবে না। শুধু মুখে বললেই হবে না, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।’
ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, ‘সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন আয়োজন করতে হলে কতগুলো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তার মধ্যে অন্যতম হলো, নির্বাচনের আগের রাতে যে সংকট তৈরি হয় তার জন্য ক্রাইসিস প্রশমন কমিটি গঠন করা- যাতে কোথাও ভোট কেনা-বেচা হলে এবং সংঘাত হলে সে কমিটি দ্রুত কাজ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, এবার একইসঙ্গে দুটো নির্বাচনের কারণে ভোটার বেশি হবে, তাই বুথের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত, ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হলে অনিয়ম কমে যাবে এবং ভোট গণনা স্বচ্ছভাবে করা যাবে।’
ড. আসিফ মোহাম্মদ সাহান বলেন, ‘নির্বাচন হলে গণতান্ত্রিক যাত্রাপথের সূচনা হয়, কিন্তু এতেই গণতান্ত্রিক উত্তরণ হয় না। এজন্য দরকার কতগুলো কাঠামোগত সংস্কার। কাঠামোগত সংস্কার হলে এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ থাকলে কোনো খারাপ মানুষ নির্বাচিত হয়ে গেলেও নিয়ম-পদ্ধতির কারণে চাইলেও তিনি দুর্নীতি-অনিয়ম করতে পারবেন না। একইভাবে বিরোধী দলগুলোর জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা গেলে তারা রাজপথের বদলে গঠনমূলক ভূমিকা রাখবে।’
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে যথাযথ কাজ করতে পারে, সেজন্য সেখানে স্বচ্ছ নিয়োগ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা বাড়ানো দরকার বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সোহরাব হাসান বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে কথা বললেও অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে সেভাবে কথা বলছি না। গণঅভ্যুত্থানের পরও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি, এটা দুঃখজনক। ফলে আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য দ্বন্দ্ব-সংঘাতের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। নির্বাচনের পর যাতে গণতান্ত্রিক রুপান্তর সুন্দরভাবে হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।’
হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, ‘সরকার চাইলে ত্রয়োদশ জাতীয় সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। তবে সরকারের পাশাপাশি অংশীজনদেরকেও যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই গণতান্ত্রিক উত্তরণ হবে না, যদি না নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ না হয়, ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত না হয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারে এবং দুর্নীতি-দুর্বৃতায়ন বন্ধ না হয়।’
মূল প্রবন্ধে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, একটি রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছিল জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাসহ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী অতিক্রান্ত হলেও সেই স্বপ্ন আজও পূরণ হয়নি। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে এই আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে যে, আর যেন কর্তৃত্ববাদী শাসনের পুনরুত্থান না ঘটে, নির্বাচন ব্যবস্থা যেন পরিশুদ্ধ হয়, গণতন্ত্র যেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।
তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক উত্তরণ তথা একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন পূর্বশর্ত হলেও তা যথেষ্ঠ নয়। আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন তথাকথিত ’একদিনের গণতন্ত্র’- ভোট প্রদানের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও গণতান্ত্রিক উত্তরণ ঘটে না।
বদিউল আলম মজমদার বলেন, কারণ যদিও নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রাথমিক এবং অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, এটি এককভাবে গণতান্ত্রিক যাত্রাপথকে সুদৃঢ় করতে পারে না। বস্তুত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে টেকসই করতে হলে ‘ডেমোক্রেটিক ডেফিসিট’ বা গণতন্ত্রের ঘাটতি দূর করা আবশ্যক, যার জন্য কতগুলো সুদূরপ্রসারী সংস্কার জরুরি।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির গভীর বিশ্লেষণ থেকে আমরা বাংলাদেশে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে মোটাদাগে সাতটি প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করেছি। প্রতিবন্ধকতাগুলো হলো, নির্বাচনী অঙ্গনে দুর্বৃত্তায়ন, রাজনৈতিক অঙ্গনে দুর্বৃত্তায়ন, নির্বাচনে টাকার অশুভ খেলা, নির্বাচন কমিশনের অকার্যকারিতা, নাগরিক সমাজের নিষ্ক্রিয়তা, নির্বাচনকালীন সরকারের পক্ষপাতদুষ্টতা এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ও ভারসাম্যহীনতা।
তিনি বলেন, জটিল এবং ক্রমবর্ধমান এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করার ওপরই নির্ভর করবে ভবিষ্যতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণ। আর এর জন্য প্রয়োজন হবে কতগুলো গভীর আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কার।
তিনি বলেন, অতীতের জালিয়াতি ও বিতর্কিত নির্বাচনের জন্য দায়ী মূলত নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারের পক্ষপাতদুষ্টতা, নির্বাচনী অঙ্গনে দুর্বৃত্তায়ন, রাজনৈতিক অঙ্গনে দুর্বৃত্তায়ন, টাকার অশুভ প্রভাব, নির্বাচন কমিশনের অপারগতা, নাগরিক সমাজের অক্ষমতা ও ক্ষমতার বিদ্যমান ভারসাম্যহীনতা তথা নজরদারিত্বের কাঠামোর দুর্বলতা।
তিনি বলেন, তাই ভবিষ্যতে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণ নিশ্চিত করতে হলে এসব বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়া এবং কতগুলো সুদূর প্রসারী আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ আবশ্যক।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ স্বাক্ষর ও সরকারের পক্ষ থেকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সাংবিধানিক সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ জারির মাধ্যমে এসব সংস্কারের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। তবে কাঙ্ক্ষিত সংস্কারগুলো বাস্তবায়িত হলেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত হবে না। টেকসই গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন।