শিরোনাম

ঢাকা, ১ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পর আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে একদিন ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন যশোরের গৃহবধূ রাখি সাহা। চুল পড়া যেন থামছেই না। গোছা গোছা চুল পড়ে যাচ্ছে প্রতিবার চুল আঁচড়ালেই। সন্তান জন্মের পর বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে করোনা-পরিস্থিতির মানসিক চাপ মিলিয়ে তিনি তখন বেশ বিপর্যস্ত সময় পার করছিলেন। এমন সময় মা দুর্গা সাহা তাঁকে মনে করিয়ে দেন তাদের বাড়ির পুরোনো একটি টোটকার কথা-কয়েকটি সহজ উপাদান দিয়ে বানানো চুলের বিশেষ তেল।
মায়ের কথায় ভরসা করে রাখি রান্নাঘরে বসেই মেথি, কালিজিরা, জবা ফুল, নিমপাতা, অ্যালোভেরা, আমলকি আর খাঁটি নারকেল তেল মিশিয়ে তৈরি করতে শুরু করেন সেই ঘরোয়া তেল। প্রথম কয়েকদিনেই তিনি চুল পড়া কমে যাওয়ার অনুভূতি পান, আর কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন চুলও উঠে আসতে দেখা যায়। নিজের জীবনে এই পরিবর্তন যেন তাঁর আত্মবিশ্বাসকে নতুনভাবে জ্বালিয়ে দিল। মনে হলো-এই তেল যদি তাঁর কাজে আসে, অন্যেরও তো কাজে লাগতে পারে। আর সেখান থেকেই জন্ম নেয় এক নতুন স্বপ্নের বীজ।
রাখি প্রথম তাঁর ছোট ভাই ভিক্টর সাহাকে বিষয়টি বলেন। ভিক্টর তখন ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে বেশ দক্ষ হয়ে উঠছেন। রাখির ব্যবহারে পাওয়া সফলতার কথা শুনে ভিক্টর বুঝতে পারেন-এটি শুধু ঘরোয়া টোটকা নয়, এটি একটি সম্ভাব্য ব্র্যান্ড হতে পারে। ঠিক করেন তারা অনলাইনে কাজ শুরু করবেন। তাদের সেই সিদ্ধান্তই আজ দেশের অন্যতম সফল স্থানীয় ব্র্যান্ড ‘ন্যাচারালস বাই রাখি’র (https://naturalsbyrakhi.com) জন্ম দেয়।
শুরুটা ছিল খুবই বিনয়ী। পুঁজি মাত্র ১ হাজার ৭০০ টাকা। বাড়ির রান্নাঘরই ছিল প্রথম ‘প্রোডাকশন হাউস’। একটি পুরোনো কড়াই, হাতে-ঘষা উপাদান, আর মাুমেয়ের উৎসাহ-এই ছিল শুরুর যন্ত্রপাতি। অন্যদিকে ভিক্টর ফেসবুক পেজ খুলে দেন, ডিজিটাল মার্কেটিং শুরু করেন। তিনি নিজের দক্ষতা দিয়ে লোগো তৈরি করেন, পেজ সাজান, এবং গল্প বলার মতো করে তুলে ধরেন তেল তৈরির প্রতিটি ধাপ।
তখনকার বাজারে অনেক অসাধু বিক্রেতা ‘৭ দিনে চুল গজাবে’-এর মতো মিথ্যা দাবি করে গ্রাহক প্রতারণা করছিল। এইরকম ভরা বাজারে সৎভাবে গ্রাহকের আস্থা অর্জন করাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ভিক্টর-রাখি সেই চ্যালেঞ্জটাই আলাদা কৌশলে মোকাবিলা করেন। তারা বাড়ির রান্নাঘর থেকে লাইভ ভিডিওতে দেখাতেন কীভাবে উপাদান সংগ্রহ করা হচ্ছে, কীভাবে ধাপে ধাপে তেল তৈরি হচ্ছে। কোনো অতিরঞ্জিত প্রতিশ্রুতি নয়-শুধু সত্যিকার উপকার আর স্বচ্ছতার গল্প।
এভাবেই প্রথম দিনে পাওয়া ২ থেকে ৪টি অর্ডার কিছুদিনের মধ্যে ১০, তারপর ৫০, তারপর শত ছুঁয়ে যায়। বাড়তে থাকে গ্রাহকের আস্থা, আসে ইতিবাচক রিভিউ। একসময় বাড়ির রান্নাঘর আর সামাল দিতে না পারায় তারা একটি ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। এরপর আরও কিছুদিন পর যশোরের রুপদিয়া এলাকার চাউলিয়ায় ৮ হাজার বর্গফুটের একটি পূর্ণাঙ্গ কারখানা গড়ে তোলেন।
আজ সেই কারখানায় কাজ করছেন শতাধিক কর্মী-যাদের অধিকাংশই স্থানীয় নারী। অনেক নারীই আগে কোনোদিন বাড়ির বাইরে কাজ করতে পারেননি। কেউ স্বামীর ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, কেউ পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। ‘ন্যাচারালস বাই রাখি’ুর চাকরি তাদের জীবনে এনে দিয়েছে স্বাধীনতা ও আত্মবিশ্বাস। রাখি তাদের ‘পরিবারের সদস্য’ ভাবতেই ভালোবাসেন।
ব্যবসা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ব্যবস্থায় যুক্ত হয় আধুনিক মেশিনের ব্যবহার। কিন্তু যন্ত্র বাড়লেও পণ্যের প্রাকৃতিক গুণাগুণ যাতে অপরিবর্তিত থাকে, সেদিকে ছিল কঠোর নজরদারি। এজন্য গড়ে তোলা হয় নিজস্ব ল্যাব। নিয়োগ করা হয় কেমিস্ট। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকও নিয়মিত তাদের পরামর্শ দেন।
গ্রাহকদের আস্থাই আজ এই ব্র্যান্ডের মূল শক্তি। রিপিট কাস্টমারের হার প্রায় ৪০ শতাংশ-যা দেশের নতুন উদ্যোক্তা উদ্যোগগুলোর জন্য বিরল সাফল্য। শুধু অনলাইন নয়, ক্রমবর্ধমান চাহিদা দেখে তারা ঢাকার বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে খুলে ফেলেছেন একটি শোরুম। হেয়ার অয়েলের পাশাপাশি এখন রয়েছে শ্যাম্পু, হেয়ার সিরাম, স্কাল্প সিরাম, স্পা প্যাকসহ আরও নানা পণ্য। ত্বকের যত্নেও তারা যুক্ত করতে চলেছেন নতুন লাইন।
সবচেয়ে বড় অর্জন- ‘ন্যাচারালস বাই রাখি’ এখন বিএসটিআই, আইএসও ও জিএমপি সনদপ্রাপ্ত। যা দেশের বাইরে রপ্তানির সম্ভাবনাকেও উন্মুক্ত করছে।
রাখির চোখ এখন আরও বড় স্বপ্নে ভরা। তাঁর লক্ষ্য-একদিন দেশের প্রতিটি দোকানে থাকবে তাঁদের পণ্য। কেবল অনলাইন নয়, প্রতিটি জেলার মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে তাদের ব্র্যান্ড। আর দীর্ঘমেয়াদে তিনি দেখতে চান—বাংলাদেশ থেকে উঠে আসা একটি স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড হয়ে দাঁড়াবে ‘ন্যাচারালস বাই রাখি’।
একজন গৃহবধূর ব্যক্তিগত সমস্যায় শুরু হওয়া ছোট্ট উদ্যোগ আজ কত মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে-তাই-ই যেন রাখির কাছে সবচেয়ে বড় আনন্দের জায়গা। তাঁর মাুএর শিখিয়ে দেওয়া সেই ঘরোয়া টোটকা আজ অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থানের উৎস, আর নতুন উদ্যোক্তা প্রজন্মের জন্য এক অনুপ্রেরণার গল্প।