শিরোনাম

।। আল-আমিন শাহরিয়ার।।
ভোলা, ১২ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : ১৯৭০ সালের ভয়াল ১২ নভেম্বর আজ। আর ১২ নভেম্বর রাতে উপকূলে আঘাত হানে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় "ভোলা" সাইক্লোন বা গোর্কি। রাত বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে বাতাসের গতি, নামছে বৃষ্টি। তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে ঝড়ের গতিবেগ। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মানুষ বাঁচার প্রত্যাশায় এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করে খুঁজছে এক চিলতে আশ্রয়। দিন গড়িয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতে ভয়ঙ্কর ঝড়ের পাষণ্ড ছোবলে এক মূহুর্তেই শান্ত উপকূলের জনপদ হয়ে উঠলো অশান্ত। লন্ডভন্ড হয়ে গেলে বাঁচার স্বপ্ন। চোঁখের পলকেই নিভে গেলো কয়েকলাখ মানুষের জীবন প্রদীপ। মৃত্যুপূরীতে রুপ নিলো বাংলার দক্ষিণ উপকূল। যারা বেঁচেছিলেন, তাদের নিদারুণ, কষ্ট, দুর্ভোগ আর স্বজনহারানো আর্তনাদে যেনো এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যপটের সৃষ্টি হয়েছিলো।
১৯৭০ ইং সালের ১২ ই নভেম্বরের এই দিনে প্রলয়ংকরী এ ঘূর্ণিঝড়টি মূহুর্তেই ব্যাপক জলোচ্ছ্বাসে ফুলে ফেপে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। পানির প্রবল স্রোত, ঝড়ের হিংস্রতা আর কালো মেঘের পেট থেকে নিক্ষিপ্ত বজ্রপাতে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিলো উপকূলীয় ভোলা ও তৎসংলগ্ন জেলাগুলোর প্রতিটি জনপদ। ওই সময়ে পুরো উপকূলজুড়ে ১০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিলো। এর মধ্যে শুধু ভোলাতেই লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। তখন উপকূলীয় দ্বীপাঞ্চল'সহ দক্ষিণাঞ্চলের বহু এলাকা বিরাভূমিতে পরিণত হয়।
তথ্য অনুযায়ী, ওই ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে দ্বীপ জনপদ ভোলা এবং পার্শ্ববর্তী জেলা নোয়াখালী উপকূলে। সেইসময় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় নোয়াখালী উপকূলের রামগতি, হাতিয়া, সন্দ্বীপ এবং পটুয়াখালীর জনপদ।
ধারণা করা হয়, সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভোলা জেলাতেই লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সেদিন উত্তাল নদী মেঘনা, তেঁতুলিয়া, কালাবাদর এবং তার শাখা-প্রশাখাগুলো রূপান্তরিত হয় লাশের মিছিলে।
সূত্র অনুযায়ী, ১৯৭০ সালের সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর উপকূলবাসীর কাছে এক ভয়াবহ হৃদয়বিদারক কালোরাত হিসেবে চিহ্নিত। সেই সময়ে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট "ভোলা সাইক্লোন" এ উপকূলে আঘাত হানে।
জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার তথ্য অনুযায়ী,"ভোলা সাইক্লোন" পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়ঙ্করতম প্রাণঘাতী একটি ঘূর্ণিঝড়। ১৯৭০ সালের সেই রাতে উপকূলে আঘাত হানে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় ভয়াল "ভোলা" সাইক্লোন বা গোর্কি।
এ দিনে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতায় কথা মনে পড়লে আজও আঁতকে ওঠেন উপকূলবাসী। উপকূলের বাসিন্দারা সেই ঘূর্ণিময় কালোরাতের অকস্মাত নির্মমতার ক্ষত এখনো বয়ে বেড়ান।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের র্বতমান বাংলাদশের দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপকভাবে আঘাত হানে ঘূর্ণঝড়টি। এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড় সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় এবং এটি সর্বকালের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতকি দুূর্যোগ বলে বিবেচিত। সরকারি হিসেবে এ ঝড়ের তান্ডবে প্রায় ৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারানোর কথা বলা হলেও বেসরকারি হিসেবে ১০ লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারান।
তথ্য অনুযায়ী, এটি ১৯৭০-এর উত্তর ভারতীয় ঘূর্ণিঝড় মৌসুমের ৬ষ্ঠ ঘূর্ণিঝড় এবং মৌসুমের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ছিল। এটি সিম্পসন স্কেলে ক্যাটাগরি ৩ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল। এ ঘূর্ণিঝড়ে ১৫ থেকে ২৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপগুলো প্লাবিত হয়ে ধংসযজ্ঞে পরিণত হয়।
সেই দিনের স্মৃতি বয়ে আজও যারা বেঁচে রয়েছেন, কিংবা স্বজনদের হারিয়েছেন, কেবল তারাই অনুভব করেন, সেদিনের ভয়াবহতার কথা।
সত্তরের সেই ভয়াবহ সাইক্লোনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ভোলার শতবর্ষী প্রবীন সাংবাদিক ও সাপ্তাহিক দ্বীকন্ঠ পত্রিকার সম্পাদক এম আবু তাহের বলেন, ‘বিভীষিকাময় সেইদিন ভোলার দৌলতখানের চৌকিঘাটায় আমি দেখেছি সাপ আর মানুষ জড়িয়ে পড়ে আছে। স্নেহময়ী মা তার শিশুকে কোলে জড়িয়ে মেঘনার পাড়ে মৃত পড়ে আছে।
তিনি বলেন, কাফনের কাপড়ের অভাবে কলাপাতা কিম্বা ছালার চট মুড়িয়ে দাফন করা হয়েছে হতভাগ্য মানুষের মরদেহ। একটি কবরে অনেকজনকে সমাহিত করা হয়েছে।
ভোলার বাতাসে ছিলো মরদেহের গন্ধ। এমনিভাবে মহকুমা ভোলার মনপুরা, চরফ্যাশন, লালমোহন, তজুমুদ্দিন ও দৌলতখানসহ সমগ্র এলাকার মৃত গবাদিপশু আর মানুষের মরদেহ বঙ্গোপসাগরের উত্তাল পানিতে ভেসে গেছে। প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছিল দ্বীপাঞ্চল ভোলা।’
যারা বেঁচেছিলেন, তাদের অধিকাংশ ১৫ থেকে ৪৯ বছরের পুরুষ ছিল। অপরদিকে, মৃত্যুর মধ্যে ৫০% শিশু (১০ বছরের কম)।
ওই সময়ে খুব কাছ থেকে দেখা সেই দুর্যোগের স্বাক্ষী শতবর্ষী প্রবীণ রাজনীতিক মনপুরা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মো. কামালউদ্দিন তার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আমরা চর বাদাম, চর সীতা এবং চর জব্বরে ধানক্ষেতগুলোতে অগণিত মানুষের মরদেহ নাকেমুখে নোনা পানি লেপ্টানো অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখেছি।

তিনি বলেন, অগণিত মানুষ আর গবাদিপশুর মৃতদেহগুলো সারিবদ্ধভাবেই ভাসছিল। রামগতি, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভোলা ও পটুয়াখালী পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে।
তিনি আরো বলেন, ‘১২৮৩ সালের ঘূর্ণিঝড় গোর্কির চেয়ে বহুগুণে করুণ এবং ভয়াবহ ছিল ৭০ এর প্রলয়ঙ্কারী সাইক্লোন গোর্কি। আর "ভোলা সাইক্লোন" এ গোটা উপকূলীয় অঞ্চলে দশলাখের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন।’
ওই সময়ের স্বজনহারানো পরিবারের একজন ভোলা প্রেসক্লাবের সদস্য সাংবাদিক জহিরুল ইসলাম বলেন, আমার মা'সহ পরিবারের লোকজনকে জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। প্রতিবছর এই দিন এলেই শোকে আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি।
১৯৭০ সালের ৮ই নভেম্বর বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে একটি নিম্নচাপ তৈরি হয়। এ নিম্নচাপটি ধীরে ধীরে সাগরের গরম পানি থেকে তাপশক্তি গ্রহণ করে এবং শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। ১১ নভেম্বর নাগাদ এটি একটি (ঝবাবৎব ঈুপষড়হরপ ঝঃড়ৎস)-এ পরিণত হয়, যা বাতাসের গতি ঘণ্টায় প্রায় ১৮৫ থেকে ২৪০ কি.মি. পৌঁছে যায়।
১২ নভেম্বর ১৯৭০, সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, চট্টগ্রামসহ দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে। তখন বাতাসের বেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১৮৫ কি:মি.২২৪ কিলোমিটার। সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল জলোচ্ছ্বাস, (ঝঃড়ৎস ঝঁৎমব) যা প্রায় ১০ মিটার উঁচু ঢেউ আকারে উপকূলীয় এলাকায় প্রবেশ করে।
এই জলোচ্ছ্বাসে সমুদ্রের পানি গ্রাম, ক্ষেত, নদীপাড় ভাসিয়ে দেয় এবং পুরো জনপদকে মুহূর্তেই পানির নিচে ডুবিয়ে দেয়। ওই সময় উপকূলের বেশিরভাগ মানুষ রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন, তাই সরে যাওয়ার সুযোগও পাননি।
প্রাণঘাতী প্রবল সেই ঘূর্ণি বাতাস আর ঝড়ের আতঙ্কে মানুষ গাছের সঙ্গে বাঁধা পড়ে, কেউ ছাদে উঠে বা নৌকা নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। নদীর পানি গ্রামে ঢুকে মানুষ, পশু, ফসল সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বেঁচে থাকা লোকেরা ঠান্ডা, ক্ষুধা আর আহত শরীর নিয়ে পানিতে ভেসে থাকতে বাধ্য হন।
ঘূর্ণিঝড়ের বাস্তবতা অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর ভোর নাগাদ ঘূর্ণিঝড়টি স্থলভাগ অতিক্রম করে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়। স্থলে আঘাতের পর বাতাসের গতি দ্রুত কমতে থাকে এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এটি নিম্নচাপে পরিণত হয়। তবে পেছনে রেখে যায় লাখো মানুষের মৃত্যু, কয়েক মিলিয়ন মানুষের ক্ষয়ক্ষতি এবং বাংলাদেশ ও পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
এ ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের পর মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী রাষ্ট্রীয় উচ্চ পদস্থ ব্যাক্তিদের নিয়ে সেই ধ্বংসযজ্ঞ ও বেদনাহতদের দেখতে ভোলায় আসেন। তার সাথে আসেন তৎকালীন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ। এসব দৃশ্য দেখে তারা শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন। তিনি উপকূলবাসীর জন্য দাতা সংস্থাগুলোর কাছে মানবিক সাহায্য কামনা করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুযায়ী, জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) এ ঘূর্ণিঝড়কে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উল্লেখ করেছে। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে ১৩ নভেম্বর ভোর পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়টি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৮৫ কিলোমিটার বেগে আঘাত হেনেছিলো বলেও উল্লেখ করা হয়েছে জাতিসংঘের ওই জরিপে।
এদিকে প্রলয়ঙ্কারী সেই ঘূর্ণিঝড়ে নিহতদের স্মরণে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও তাদের রুহের মাগফিরাত কামনায় আজ বুধবার (১২ নভেম্বর) ভোলার বিভিন্ন এলাকায় দোয়া, আলোচনা ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
দিবসটি পালনে ভোলার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন-উপকূল ফাউন্ডেশন, ব-দ্বীপ ফোরাম, যুব রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ, যুব শক্তি ছাত্র কল্যাণ, যুব শক্তি ফাউন্ডেশন, ব-দ্বীপ ছাত্র কল্যান সংসদ, পরিবর্তন যুব উন্নয়ন সংস্থা, বাংলাদেশ স্বেচ্ছা সেবক ফাউন্ডেশন, আলোকিত জীবন ছাত্র সংগঠন, ভলান্টিয়ার্স ফোরাম বাংলাদেশ, ইয়ুথ নেটওয়ার্ক ফর ডেভেলপমেন্ট, মানবতার বন্ধন যুব উন্নয়ন সংস্থা এবং মোস্তফা চেয়ারম্যান স্মৃতি সংঘ ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা শীর্ষক আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
আজ সকাল সাড়ে ১১ টায় ভোলা প্রেসক্লাবে আয়োজিত উপকূল দিবসে ১২ নভেম্বরের বিশেষ স্মৃতিচারণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ভোলা প্রেসক্লাব আহ্বায়ক অ্যাড. আমিরুল ইসলাম বাছেত এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন, ভোলা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আলহাজ্ব গোলাম নবী আলমগীর।
বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন, জেলা বিএনপির সদস্য সচীব রাইসূল আলম, যুগ্ম আহব্বায়ক এনামুল হক, হুমায়ুন কবির সোপান, দৈনিক আজকের ভোলা সম্পাদক আলহাজ্ব মু. শওকাত হোসেন, সমাজকর্মী মীর মোশাররফ হোসেন অমি, যুব রেডক্রিসেন্ট সভাপতি মো.আনোয়ার হোসেন, সাংবাদিক শিমূল চৌধরী প্রমুখ।