শিরোনাম

মুহাম্মদ আমিনুল হক
সুনামগঞ্জ, ৪ নভেম্বর ২০২৫ (বাসস): মেঘ পাহাড়ের দেশ সুনামগঞ্জ। এই সুনামগঞ্জেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন মরমী কবি হাসন রাজা। আর সুনামগঞ্জ পৌর শহরের লক্ষণশ্রী গ্রামে (বর্তমানে তেঘরিয়া নামে পরিচিত) তার বসতভিটাই এখন ‘হাসন রাজা মিউজিয়াম’ (জাদুঘর)। মরমী কবির এ জাদুঘরটিকে আরো সমৃদ্ধ করার দাবি স্থানীয়সহ দর্শনার্থীদের।
জানা যায়, সুরমা নদীর তীরের তেঘরিয়া (লক্ষ্মণশ্রী) গ্রামে ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর জন্মেছিলেন এই সুর সাধক। বাবার নাম দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী। মায়ের নাম হুরমত জান বিবি। তাঁর পূর্বপুরুষেরা সনাতন ধর্মের ছিলেন। তাঁদের একজন বীরেন্দ্ররাম সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
এই মরমী কবি হাসন রাজার গানে ফুটে উঠেছে সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার, গোঁড়ামি ও কৃত্রিমতার কথা। তার গানে ফুটে উঠেছে মানবতার জয়গান: মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা এবং আধ্যাত্মিকতার কথা। অনেক গানে স্বাধীনচেতা মনোভাব: প্রচলিত সামাজিক নিয়মকানুনের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে নিজের সত্তাকে খুঁজে বের করার প্রেরণা জুগিয়েছে তার গানে। তিনি যেই ছনের ঘরে বসে গান লিখতেন ও নিজে সুর করে গাইতেন সেই ঘরটি এখনও আছে। ঘরটিকে সংস্কার করা হয়েছে। যে পুকুরে হাসন রাজা গোসল করতেন সে পুকুর ঘাটটি রয়েছে অরক্ষিত অবস্থায়।
সুরমা নদীর তীর ঘেঁষে বাড়িটির অবস্থান। উত্তরে তাকালে চোখে পড়ে সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়। সুনামগঞ্জ জেলার নতুন বাসস্ট্যান্ড থেকে মোটরসাইকেলে চড়ে ১৫ মিনিট সময় লাগে হাসন রাজার বাড়িতে পৌঁছতে। বাড়িতে একটি তিনতলা, একটি দোতলা ভবনসহ পুরোনো আমলের কাঠ ও টিনের চালার সাতটি ঘর রয়েছে। তিনতলা ভবনটির নিচতলার চারটি ঘর নিয়ে ‘হাসন রাজা মিউজিয়াম’। আর হাসনরাজার এ জাদুঘর দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন।
হাসন রাজার প্রপৌত্র হাসন রাজা জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ও তত্ত্বাবধায়ক সামারীন দেওয়ান এ জাদুঘরটিতে হাসন রাজার পোশাক-পরিচ্ছদ, তাঁর বংশপরিচয়, নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী, গানের পাণ্ডুলিপি ও সংগীতচর্চায় ব্যবহারকৃত ঢোলসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র এবং নানা দুর্লভ উপকরণ সাজিয়ে রেখেছেন।
অভ্যর্থনাকক্ষে ফ্রেমে বাঁধানো হাসন রাজার বংশপরিচয়ে চোখ বুলিয়ে অনেকেই তাঁর অনেক অজানা বিষয় জানতে পারছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সামারীন দেওয়ান বলেন, হাসন রাজার বাবা দেওয়ান আলী রাজা প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন। সেই সূত্রে বাবার কাছ থেকে অঢেল ধনসম্পত্তি পেয়েছিলেন তিনি। তাঁদের জমিদারির অধীনে ছিল পাঁচ লাখ একর জমি। তাই যৌবনে তুমুল শৌখিন হয়ে ওঠেন তিনি। ১৮৭১ সালে বাবা ও ভাইদের মৃত্যু, তারপর ১৮৯৭ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পে অনেক মানুষের মৃত্যুতে ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকেন তিনি।
জাদুঘরের একটি শোকেসে রাখা হাসন রাজার মখমলের একটি আলখাল্লা, সাদা দুটি গেঞ্জি রয়েছে। জানা যায়, তিনি বেশিরভাগ সময় সাদাসিধে পোশাক পরতেন। সাদা ধুতি পরতেন এবং গায়ে থাকত সাদা গেঞ্জি। পায়ে কাঠের খড়ম। উৎসব-অনুষ্ঠানে গেলে পরতেন জরির কারুকাজ খচিত আলখাল্লা।
জাদুঘরের এক প্রান্তে হাসন রাজার চেয়ার-টেবিল রয়েছে। এসবে বসেই তিনি গান ও কবিতা লিখতেন।
জাদুঘরের কক্ষে থাকা বজরায় (বড় নৌকা) চড়ে নৌবিহারে যেতেন এই খেয়ালি সুরসাধক।
রম্য লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেন, প্রতিবছর বিশেষ করে বর্ষাকালে নাচ-গানের ব্যবস্থাসহ বজরা নিয়ে বেরিয়ে পরতেন হাসন রাজা। বজরায় বসে প্রচুর গান রচনা করেছেন। সেখানেই নৃত্য, বাদ্যযন্ত্রসহ সেগুলো গাওয়া হতো। জাদুঘরের অপর একটি শোকেসে হাসন রাজার হাতে বাজানো দুটি ঢোল এবং একটি দোতারা রাখা আছে।
সামারীন দেওয়ান আরো জানান, হাসন রাজা কখনো কখনো গান গাইতে গাইতে নিজের কোলের কাছে ঢোল টেনে নিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে যেতেন। মাঝে মাঝে ঘোড়া ও হাতিতে চড়ে শিকারে যেতেন। জাদুঘরে রাখা হাতে আঁকা একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, তিনি হাতিতে চড়ে শিকারে যাচ্ছেন। জাদুঘরে তাঁর ব্যবহৃত দুধের পাত্র ও পানদানির দেখা মিলে। একটি আলমারিতে হাসন রাজার হাতের লেখা গানের পাণ্ডুলিপি। তিনি বলেন, অনেকের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী হাসন রাজার রচিত মোট গানের সংখ্যা হাজারের বেশি। তবে এ পর্যন্ত ৭০০ গানের সন্ধান পাওয়া গেছে।
তিনি আরো জানান, হাসন রাজা একজন মরমী সাধক। যা অনেক ২১শে পদক প্রাপ্তরা স্বীকৃতি দিয়েছেন।
কিন্তু, আমরা সুনামগঞ্জবাসী তার যথাযথ মর্যাদা দিতে পারছি না। কালের আবর্তে যাতে হাসন রাজা নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে হারিয়ে না যায় সে জন্য ‘ফোক সেন্টার’ করা অতীব জরুরি।
হাসন রাজার একটি জনপ্রিয় গান তার বাড়ির ফটকে ‘লোকে বলে বলেরে ঘর বাড়ি ভালা না আমার/ আমি না লইলাম আল্লাজ্বির নাম রে...’। জানা গেল, দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা হাসন রাজার বাড়ি ও জাদুঘরে আসেন। প্রতিদিন ২৫০-৩০০ দর্শনার্থীর ভিড় হয়।
হাসন রাজা তাঁর ৬৮ বছরের জীবনকালে মাত্র একটি ছবি তুলেছিলেন। সেটা ১৯১৪ সালে কলকাতায়, যা মারা যাওয়ার আট বছর আগে।
ছবির বিষয়ে সামারীন বলেন, এই ছবিতে ষাটোর্ধ্ব হাসন রাজার দিকে তাকালে ৮০ বছরের বুড়োর মতো মনে হবে। আসলে হাসন রাজা আধ্যাত্মিক চিন্তাচেতনায় এবং জীবন-জগৎ নিয়ে এতটাই মগ্ন ছিলেন যে তাঁকে বয়সে ভারাক্রান্ত মনে হয়েছে। তিনি ১৯২২ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
দর্শনার্থী ইশতেহাক বলেন, আমি এই প্রথম হাসন রাজার বাড়িতে এসেছি। খুবই ভালো লাগছে। তবে, হাসন রাজাকে নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করতে হলে জাদুঘরকে আরো সুন্দর ও সমৃদ্ধ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবি জানাই জাদুঘরকে আরো সুন্দর করে গড়ে তোলার।
বিটিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী (অব.) শেরগুল আহমেদ বলেন, হাসন রাজা দেশের একজন গর্বের ধন তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নতুন প্রজন্মকে মরমী কবি হাসন রাজার ইতিহাস জানাতে উদ্যোগ নিতে হবে।
জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন- মরমী কবি হাসন রাজা হাওর জনপদের রত্ন। আমরা তার ইতিহাস ঐতিহ্যকে লালন এবং আগামী প্রজন্মকে জানিয়ে দিতে ব্যবস্থা নিতে হবে। ইতোমধ্যে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে হাসন রাজার মাজার সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।