বাসস
  ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ১৫:৫৫

নগরায়ন ও বন উজাড়ে প্রজাপতি কমছে জাহাঙ্গীরনগরে

ছবি : বাসস

মাহ আলম

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ১৬ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস): একসময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ক্যাম্পাসজুড়ে উড়ে বেড়াত রঙিন প্রজাপতির দল। মুহুর্তেই ছন্দ ফিরে পেত প্রাণ-প্রকৃতি আর শিক্ষার্থীরা। এখন সেই দৃশ্য অনেকটাই ম্লান। কারণ প্রজাপতির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। 

পরিবেশবিদরা বলছেন, নগরায়ণ ও বনভূমি ধ্বংসের কারণে প্রজাপতির আবাস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সে কারণেই কমছে সংখ্যা।

এ বিষয়ক ‘চেকলিস্ট অব বাটারফ্লাই লার্ভাল হোস্ট প্ল্যান্টস অ্যান্ড দেয়ার স্পেশিয়াল ডিস্ট্রিবিউশন অন দ্য ক্যাম্পাস অব জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাটি গত এপ্রিলে এশিয়ান-অস্ট্রালেশিয়ান জার্নাল অব বায়োসায়েন্স অ্যান্ড বায়োটেকনোলজিতে প্রকাশিত হয়।

গবেষণায় উঠে আসে, একসময় জাবি ক্যাম্পাসে ১০০টিরও বেশি প্রজাতির প্রজাপতি ছিল। এখন সেই সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র ৭২-এ। প্রজাপতির লার্ভা বেড়ে ওঠার জন্য অপরিহার্য গাছ কেটে ফেলাই এই সংকটের মূল কারণ।

জাবি’র প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে গবেষণাটি করেছেন শ্রাবণী দাস, মুনতাহেনা রুহি ও মোহাম্মদ সোহেল আবেদিন। তারা প্রজাপতির জীবনচক্রে গুরুত্বপূর্ণ ৩৭টি পরিবারের ১০৭টি উদ্ভিদ প্রজাতি শনাক্ত করেছেন।

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রজাপতির লার্ভার জন্য গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ মাত্র ১২টি। এর মধ্যে রয়েছে—ক্যাপারিস জেইলানিকা, সিট্রাস অরান্টিফোলিয়া, বুটিয়া মনোস্পার্মা, ওরাইজা সাটিভা, ক্যাসিয়া ফিস্টুলা ও গ্লাইকোসমিস পেন্টাফাই।

প্রধান গবেষক মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রজাপতির সংখ্যা কমে যাওয়া শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ক্ষতি নয়, এটি মারাত্মক পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতারও ইঙ্গিত দেয়। প্রজাপতি পরাগায়ণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায়  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই তাদের প্রজননস্থল ধ্বংস হলে পুরো জীবনচক্রই হুমকির মুখে পড়বে।’

গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে, প্রজাপতির জন্য ১২টি গুরুত্বপূর্ণ গাছের মধ্যে ৮টি প্রজাতি ক্যাম্পাসের সব জায়গায় কমবেশি রয়েছে। তবে, ওরাইজা সাটিভা ও ক্যাপারিস জেইলানিকা চোখে পড়েবে সীমিত।

গাছগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় প্রজাপতি সহজে নিজেদের জন্য উপযুক্ত আবাস খুঁজে পায় না। ফলে ঠিকমতো বংশবৃদ্ধি করতে পারছে না। এ কারণেই সংখ্যায় দিন দিন কমে যাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০টি স্থানে এ গবেষণায় পরিচালনা করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, প্রজাপতিরা মূলত সিজালপিনিয়াসি, পোয়াসি, রুটাসি, ফ্যাবাসি ও অ্যাপোসিনিয়াসি পরিবারের গাছের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু নগর উন্নয়নের কারণে এসব গাছের সংখ্যাও উদ্বেগজনক হারে কমে গেছে।

অধ্যাপক মনোয়ার সতর্ক করে বলেন, ‘নির্বিচারে গাছ কাটা, ঝোপঝাড় পরিষ্কার, আর বনভূমি পোড়ানোর কারণে পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনও প্রভাব ফেলছে। এ বছর অতিবৃষ্টির কারণে অনেক প্রজাপতির পাখা ভেঙে গেছে। তাদের শক্তির জন্য সূর্যালোক প্রয়োজন। কিন্তু টানা বৃষ্টিতে প্রজাপতিরা তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতেও তাদের সংখ্যা কমছে।’

এমন পরিস্থিতিতে অধ্যাপক মনোয়ার প্রজাপতির আবাসস্থল রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকায় দ্রুত নগরায়নের ফলে প্রজাপতির জীবনধারনে অপরিহার্য গাছগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।

মনোয়ার হোসেন সতর্ক করে বলেন, ‘প্রজাপতির সংখ্যা কমে যাওয়া এড়িয়ে যাওয়ার মত বিষয় নয়। এটা পুরো পরিবেশের জন্য অশনি সংকেত। এই সংকট মোকাবেলায় এখনই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে পরিকল্পিতভাবে পরিবেশগত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।

গবেষকরা সুপারিশ করেছেন, সিট্রাস অরান্টিফোলিয়া, বুটিয়া মনোস্পার্মা ও ক্যাসিয়া ফিস্টুলার মতো গাছ রোপন ও সংরক্ষণের মাধ্যমে প্রজাপতির আবাস পুনরুদ্ধার করতে হবে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রজাপতির সংখ্যা বাড়াতে শুধু গাছ লাগালেই হবে না। পুনরুদ্ধার কার্যক্রম নিয়মিত তদারকি করতে হবে। আবার সময়ের সঙ্গে প্রজাপতির সংখ্যা বাড়ছে কি না, সেটাও পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

গবেষকরা বলেছেন, এই কাজ সফল করতে হলে প্রশাসনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে এবং সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে।

প্রজাপতি পরাগায়ণ ও উদ্ভিদের বৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই এদের সংখ্যা কমলে বন ধ্বংস, দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের মত বিপর্যয়ের ঝুঁকি তৈরি হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় প্রজাপতি রক্ষায় সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে বলেও মত দেন গবেষকরা।