বাসস
  ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪:৩৫

টাঙ্গাইলে ৬৩ বছর ধরে একই আঙ্গিনায় মসজিদ ও মন্দির, চলছে ধর্মচর্চার সম্প্রীতির বন্ধন

জেলার নাগরপুরের চৌধুরী বাড়ির একই আঙ্গিনায় দীর্ঘ ৬৩ বছর ধরে ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা সম্প্রীতি ও ভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নিজ নিজ ধর্মচর্চা করে আসছেন । ছবি : বাসস

।। মহিউদ্দিন সুমন।।

টাঙ্গাইল, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : জেলার নাগরপুরের চৌধুরী বাড়ির একই আঙ্গিনায় কোনো সাম্প্রদায়িক হানাহানি ছাড়াই চলছে নামাজ ও দুর্গাপূজাসহ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। দুটি ধর্মের অনুসারীরা সম্প্রীতি ও ভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নিজ নিজ ধর্মচর্চা করে আসছেন দীর্ঘ ৬৩ বছর ধরে। উভয় ধর্মের অনুসারীরা একে অপরের ধর্মচর্চায় সহযোগিতার মাধ্যমে নিজ নিজ ধর্ম পালনে সারাদেশে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

জানা যায়, টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার চৌধুরী বাড়িতে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে ওঝা ঠাকুর ও হরনাথ স্মৃতি কেন্দ্রীয় দুর্গা মন্দির প্রতিষ্ঠিত করেন শ্রী পরেশ চন্দ্র ও শৈলেশ চন্দ্র দাসয়ো। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর বাড়ির আঙ্গিনার অপরপাশে (পশ্চিমাংশে) ১৯৬২ সালে নির্মাণ করা হয় নাগরপুর চৌধুরী বাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ। একই মাঠের পশ্চিমাংশে মসজিদ আর পূর্বাংশে মন্দির নিয়ে স্থানীয় জনসাধারণের মাঝে কখনও ধর্মীয় কোনো দ্বন্দ্ব বা সাম্প্রদায়িক হানাহানি হয়নি। 

সরেজমিনে নাগরপুর ওঝা ঠাকুর ও হরনাথ স্মৃতি কেন্দ্রীয় দুর্গা মন্দির পূজামণ্ডপে গিয়ে দেখা যায়, পূজা-অর্চনা, উলুধ্বনি ও ঢাকের বাজনা চলছে। দর্শনার্থীরা প্রতীমা দেখতে ভিড় করছেন। আযানের আগে মাইক্রোফোনে ঘোষণা করা হলো, আজান এবং নামাজের পর আবার পূজার কার্যক্রম শুরু হবে। ঠিক নির্ধারিত সময়ে আজান শুরু হতেই থেমে যাচ্ছে, ঢাক-ঢোল-কাঁসর, মাইক ও উচ্চশব্দের বাজনা। আজানের পর মুসল্লিরা মসজিদে এসে নামাজ আদায় করছেন। নামাজ শেষ হওয়ার বেশ কিছু সময় পর আবার বেজে ওঠে মন্দিরের ঢাক-ঢোল-কাঁসর আর উচ্চশব্দের বাজনা। ঠিক তেমনি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যখন পূজা অর্চনায় মেতে ওঠেন তখন নামাজ ব্যতীত কোন ধরনের ইসলাম ধর্মীয় চর্চা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকেন মুসল্লিরা। 

এ ছাড়াও প্রতিমা দর্শনে আগতরা বেশিরভাগ সময়ে অবস্থান নেন মসজিদের আঙ্গিনায়। এলাকার হিন্দু-মুসলিম সকলেই একে অপরের মসজিদ ও মন্দিরের সুরক্ষায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুগের পর যুগ ধরে ধর্মচর্চা করে আসছেন। কোন সহিংসতা তো দূরের কথা, কোনোদিন বাক-বিতণ্ডারও নজির নেই এখানে। উভয় ধর্মের অনুসারীরা এ সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধকে শতাব্দীর পর শতাব্দী টিকিয়ে রাখতে দৃড় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

মসজিদে নামাজে আসা মুসল্লিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এ এলাকার মানুষ অত্যন্ত শান্তি প্রিয়। দুই ধর্মের লোকজনদের মাঝে ধর্ম পালন নিয়ে কোনোদিন বিরোধ সৃষ্টি হয়নি। ইসলাম ধর্মের মানুষ তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে। এটা কাউকে বলে দিতে হয়না। 

অন্যদিকে পূজামণ্ডপ পরিদর্শনে আসা ভক্তদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মন্দির প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাশাপাশি চলছে দুই ধর্মের মসজিদ-মন্দিরের কার্যক্রম। তাদের প্রত্যাশা যুগযুগ ধরে চলতে থাকবে এই সম্প্রীতি।

গতকাল (২৯ সেপ্টেম্বর) বিকেলে টাঙ্গাইল পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান নাগরপুরে শারদীয় দুর্গা পূজামণ্ডপ পরিদর্শনে আসেন। এ সময় মন্দির ও মসজিদে দুটি ধর্মের অনুসারীদের ধর্মীয় সম্প্রীতির বন্ধন দেখে মুগ্ধ হন জেলা পুলিশ সুপার।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন, নাগরপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম, উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আরাফাত মোহাম্মদ নোমান, নাগরপুর উপজেলা বিএনপি সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ ছালাম, জামায়াতের নাগরপুর শাখার আমীর মাওলানা মো.রফিকুল ইসলাম, উপজেলা পূজা উদযাপন ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক ঝুটন কুমার সাহা। 

পূজা উদযাপন ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক বলেন, এ বছর উপজেলায় ১২টি ইউনিয়নে ১২৬ টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা উদযাপন হচ্ছে। এর মধ্যে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে নাগরপুর চৌধুরী বাড়িতে ওঁঝা ঠাকুর ও হরনাথ স্মৃতি কেন্দ্রীয় দুর্গা মন্দির প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পূজা করে আসছেন। মন্দিরের আঙ্গিনার পাশেই ১৯৬৩ থেকে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও ঈদগাহ মাঠ স্থাপনের পর থেকেই একই আঙ্গিনায় মন্দির মসজিদের পাশাপাশি দুটি ধর্মের অনুসারীরা ভ্রাতৃত্বের সাথে ধর্মচর্চা করে আসছেন। যা বাংলাদেশে এক বিরল দৃষ্টান্ত। 

মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান সোহেল জানান, তিনি জন্মের পর থেকে একই বাড়ির আঙ্গিনায় মসজিদ ও মন্দির দেখছেন। পূর্বাংশের মন্দিরে সনাতন ধর্মের লোকজন পূজা-অর্চণা করেন। নামাজের আজানের সময় হলে বন্ধ হয়ে যায় পূজার কর্ম। 

উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিবুর রহমান হবি বলেন, ওঝা ঠাকুর ও হরনাথ স্মৃতি কেন্দ্রীয় দুর্গা মন্দিরে দুর্গাপূজা ছোট পরিসরে হলেও এর একটি ঐতিহ্য রয়েছে। সেটা হল দীর্ঘ ৬৩ বছর ধরে একই আঙ্গিনায় মসজিদ ও মন্দীরে হচ্ছে ধর্মচর্চা। যা একটি বিরল ঘটনা। 

পূজামণ্ডপ পরিদর্শনে এসে জেলা পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, দীর্ঘ ৬৩ বছর ধরে নাগরপুরে মসজিদ ও মন্দিরে প্রত্যেক ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্ম, সম্প্রীতি বজায় রেখে ধর্ম পালন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন। এই পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করে দেখতে পেলাম একই স্থানে নামাজ হচ্ছে, আবার পাশেই শান্তিপূর্ণভাবে পূজা চলছে। 

এই দৃষ্টান্ত প্রমাণ করে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এমন বাংলাদেশ আমরা সবাই প্রত্যাশা করি। 

তিনি আরো জানান, জেলার ১২ উপজেলায় ১২৫১ টি পূজামণ্ডপে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশের পাশাপাশি, র‌্যাব, ডিবি ও আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। সেই সাথে মোবাইল টিম ও সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছে।