শিরোনাম
ঢাকা, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস): ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহম্মাদ রেজাউল করীম বলেছেন, জুলাইতে ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছে দেশকে স্থায়ীভাবে স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে রক্ষা করা, রাষ্ট্রের পরতে-পরতে জমা হওয়া ৫৪ বছরের জঞ্জাল দূর করা, ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, সর্বত্র জবাবদহিতা নিশ্চিত করা, সকল নাগরিকের ভোটের অধিকার, সম্মান-মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য। দেশের একটি রাজনৈতিক পক্ষের বক্তব্য-বিবৃতি ও আচরণ দেখলে মনে হয়, জুলাইয়ের আন্দোলন হয়েছিলো কেবলই ক্ষমতার পালাবদলের জন্য। আদতে বিগত দিনের রাজনীতিতে এটা পরিষ্কার যে, কেবলই নির্বাচন ও ক্ষমতার পালাবদলের জন্য জুলাইয়ের অভ্যুত্থান হয় নাই। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, সংস্কার ও বিচারকে গুরুত্ব না দিয়ে নির্বাচনকে মুখ্য করে তোলা হয়েছে যা দেশকে পুরোনো অশুভ বন্দোবস্তে আবারো নিপতিত করবে বলে আমরা আশঙ্কা করি।
সোমবার দুপুরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন।
এসময় চরমোনাই পীর বলেন, আমরা যারা জুলাইতে জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করেছি, যারা বাচ্চাদের রক্ত ও জীবন উৎসর্গিত হতে দেখেছি, যারা আহতদের গোঙানি শুনছি তারা এই পরিস্থিতি মেনে নিতে পারি না। সেই তাগিদ থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে এবং আমরা জুলাইয়ের প্রত্যাশা বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট কিছু দাবি নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
নির্বাচনের পরে সংস্কার বাস্তবায়নের বিষয়ে ভিন্নমত জানিয়ে পীর সাহেব চরমোনাই বলেন, আমরা ৯০ সালেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যৌথ সংস্কার প্রতিজ্ঞা দেখেছি। নির্বাচনের আগেও বিভিন্ন দল ইশতেহার দেয়। সেগুলোতে সুন্দর সুন্দর বানী থাকে। কিন্তু তার কোনো আইনি ভিত্তি না থাকায় নির্বাচনের পরে গালভরা সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন আর হয় না। জুলাই সনদ ও সংস্কার প্রতিশ্রুতিই হয়ে থাকবে যদি না তার আইনি ভিত্তি নিশ্চিত না করা যায়। আমরা মনে করি, যেকোনো গণঅভ্যুত্থানের সার্বভৌম এখতিয়ার থাকে। সেই ক্ষমতা ও এখতিয়ার বলে জুলাই সনদকে এই আমলেই বাস্তবায়ন করতে হবে এবং তারই ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। কারণ, অতীতের অভিজ্ঞতায় নির্বাচনের পরে কেউ এসে এটা বাস্তবায়ন করবে সেই আশা করা যায় না।
অতএব, দ্রুত সাংবিধানিক আদেশ বা গণভোটের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদকে আইনসম্মত করতে হবে।
ফ্যাসিবাদের বিচার গতি ও বিস্তৃতি নিয়ে মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, আওয়ামী লীগ যে মাত্রায় ও পরিমাণে অপরাধ করেছে তা কোন পথভ্রষ্ট রাজনৈতিক দলের অপকর্ম না। বরং মাফিয়াদের মতো সুসংহত ও সংঘবদ্ধ অপরাধ। ফলে তাদের বিচারটাও সেই বিবেচনায় ও সেই মাত্রায় হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের মূলহোতারা সবাই দেশের বাইরে বসে নানা রকম চক্রান্ত করেই যাচ্ছে। জেলা ও থানা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতারা এলাকায় ফিরতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের প্রতিহিংসা ও জিঘাংসা কত নির্মম তা কল্পনাও করা যায় না। বর্তমানে বিচারের যে পরিস্থিতি তাতে অভ্যুত্থানের বিপ্লবীদের জীবন ও দেশ হুমকির মুখোমুখি। এমন বাস্তবতায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ দাবি করছে যে, ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম জেলা পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে এবং বাইরে পালিয়ে থাকা অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। পাচারকৃত টাকা উদ্ধারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচার ও জাপা নিষিদ্ধের বিষয়ে চরমোনাই পীর বলেন, পতিত ফ্যাসিবাদের দোসরদের অপতৎপরতায় জাতি বিষিয়ে ছিল বিগত পনেরো বছর। এই লজ্জাহীনরা ফ্যাসিবাদের সকল অপকর্মের পক্ষ নিয়েছে এবং ফ্যাসিবাদকে বেপরোয়া হতে সহায়তা করেছে। এর মধ্যে জাতীয় পার্টির ব্যাপারে সবাই অবগত। তারা ফ্যাসিবাদের মন্ত্রিসভায় ছিল। জালিয়াতিপূর্ণ প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে তারা অংশ নিয়ে অবৈধ নির্বাচনগুলোকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেছে। এই জাতীয় পার্টি অভ্যুত্থানের পরে আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এখন তারা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার পাঁয়তারা করছে। দেশের একটি রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান জানিয়েছে। আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই যে, জাতীয় পার্টিসহ ফ্যাসিবাদের সকল দোসরদের বিচারের আওতায় আনতে হবে এবং বিচার চলাকালীন তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। কারণ, তারা কোনো স্বাধীন রাজনৈতিক দল নয় বরং তারা ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির প্রকাশ্য এজেন্ট।
পিআরের পক্ষে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে দলের আমির বলেন, আমরা বারংবার বলছি যে, বিগত ৫৪ বছরে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়েছে সেই পদ্ধতি দেশকে ক্রমান্বয়ে পেছনের দিকে নিয়ে গেছে। দেশের বর্তমান যা কিছু উন্নয়ন তা ব্যক্তিখাতের প্রচেষ্টা ও উদ্যোগের ফল। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রাষ্ট্রের ভিত্তি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা নষ্ট করা এবং দুর্নীতি-দুঃশাসনের মাত্রায় প্রতিটি নির্বাচনই দেশকে আগের চেয়ে খারাপ অবস্থায় ফেলেছে। এমন তিক্ত অতীতের বাস্তবতায় পুরোনো বন্দোবস্তে নির্বাচন করার কোনো অর্থ হয় না। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তাই উভয়কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজনের জন্য দাবি জানিয়ে আসছে। পিআরের সুবিধা কি তা আমরা বারংবার আলোচনা করেছি। আমরা পিআর পদ্ধতিতে আগামী নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।
যুগপৎ আন্দোলন কোনো দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নয় জানিয়ে পীর সাহেব চরমোনাই স্পষ্ট করে বলেন, এই পরিস্থিতিতে দেশের ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রতিনিধিত্বশীল কিছু রাজনৈতিক সংগঠন একত্রিত হয়ে আলাপ আলোচনা করেছি। আমরা সর্বদিক চিন্তা করে এবং জুলাইয়ের রক্তের প্রতি দায়বোধ থেকে সুনির্দিষ্ট এই দাবিগুলো নিয়ে রাজনৈতিকভাবে মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা একই দাবি নিয়ে জোটবদ্ধ কর্মসূচি পালন করবো। যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তুলবো। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করবো এবং ক্রমান্বয়ে কর্মসূচি কঠোর থেকে কঠোরতর হবে।
তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে- জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে; নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে হতে হবে; সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে; গণহত্যার বিচার দৃশ্যমান হতে হবে; বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ভারতীয় তাঁবেদার ও ফ্যাসিবাদের দোসর জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলের বিচার করতে হবে এবং বিচার চলাকালীন তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। এই দাবি আদায়ের জন্য আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। ১৯ সেপ্টেম্বর বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ,২৬ সেপ্টেম্বর সারাদেশে জেলা/উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে।