শিরোনাম
ঢাকা, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : আজ থেকে দুই, তিন কিংবা চার দশক আগে শহরে যারা ‘টোকাই’ হিসেবে পরিচিত ছিল তারাই আজকের দিনের পথ শিশু। মূলত এদের পরিবার পরিজন কিংবা বাবা- মা না থাকায় এরা ঠিকানা বিহীন। এদের নেই কোন ধরাবাঁধা জীবন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত শহরগুলোতে এ সকল পথ শিশু নিজেরাই নিজেদের মত করে থাকতে ভালবাসে। তবে নিজেদের মত থাকতে গিয়ে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক এরা জড়িয়ে যাচ্ছে মাদকের সাথে।
স্বেচ্ছায় যদিও কেউ কি আর পথ শিশু হতে চায়? চায় না। পারিপার্শিক অবস্থা তথা পরিবারের অস্বচ্ছলতার কারণেই ছোট ছোট শিশুরা পথ শিশুতে পরিণত হচ্ছে। এরা সকলেই সমাজের সবচেয়ে নিচু স্তরের কাজে লিপ্ত। যেমন ঢাকা শহরে বিভিন্ন ট্রাফিক সিগনালে অনেক সময়ই দেখা যায় কেউ ফুল বিক্রি করছে, কেউবা গাড়ী পরিষ্কারসহ বিভিন্ন কাজ করছে। কেউ ময়লার ভাগাড়ে (ডাস্টবিন) পলিথিন সংগ্রহ করছে, পিঠে বস্তা নিয়ে কাগজ সংগ্রহ করছে, কেউবা প্লাস্টিকের বোতল। অর্থাৎ কি না একেক শিশু একেক কাজ করছে। কিন্তু এ কাজ করে অর্জিত অর্থ দিয়ে এ সকল শিশু কি করে সে খবর হয়তোবা অনেকেই জানে না। এভাবে পাওয়া অর্থ বলতে গেলে তাদের সকলেই খরচ করছে মাদকের পেছনে। বিভিন্ন প্রকার মাদক গ্রহণ করে ঘুমানোই যেন তাদের কাছে স্বর্গ সুখ।
সম্প্রতি রাজধানীর গ্রীন রোড-পান্থপথ চৌরাস্তা এলাকার একটি গলিতে বিকেল বেলা দেখা গেল ১০-১২ বছর বয়সী এক পথ শিশু তার চেয়ে বয়সে কিছুটা বড় এক বন্ধুর সাথে বসে গাঁজা খাচ্ছে। বন্ধুটি গভীর মনযোগে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েই তা দেখছিলাম আমরা। কিন্তু কোন ভ্রুক্ষেপই করছে না দুই গাঁজা সেবনকারী পথ শিশু।
কিছুক্ষণ পর কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম তোমরা কি করছো? তখন বাচ্চা ছেলেটির ঝটপট উত্তর, দেখছ না কি করছি? উত্তর শুনে বেশ বিস্মিত হলেও তাদের পাশেই বসে গেলাম কথা বলতে।
পথ শিশুটি জানাল তার নাম সোহাগ। আর তার বন্ধুর নাম মোহন। এক জনেরও বাবা-মা নেই। রাতে তারা ফুটপাতে কিংবা কখনো কখনো কমফোর্ট হাসপাতালের গেইটের কাছে গিয়ে ঘুমায়।
দিনের বেলা তারা ডাস্টবিনের ময়লা হতে প্রয়োজনীয় জিনিস কুড়ায়। আর তা বিক্রি করে কাঁঠালবাগানের কয়েকটি দোকানে। মানিক জোড়ের মত সারাক্ষণ দু’জন এক সাথেই কাটায়। দিন শেষে যা উপার্জন করে তা তাদের এক বড় ভাইয়ের কাছে জমা রাখে। ঐ বড় ভাইয়ের কাছ থেকেই তারা মাদক যেমন গাঁজা অথবা ড্যান্ডি (জুতার আঠা) ক্রয় করে।
মাদক গ্রহণের কারণ জানতে চাইলে সোহাগ বলে, আমার বাবা-মা নেই। আমার জন্মের দুই বছরের মাথায় বাবা মারা যায়। মা দ্বিতীয়বার বিয়ে করে এক রিকশাওয়ালাকে। সে আমাকে নিতে চায় না। মা চলে গেল। আমি শুধু কাঁদলাম। এমন অবস্থায় খিদের যন্ত্রণায় একদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করি। কয়েক দিন ভিক্ষে করেই কাটাই। কেননা আমার কিছুই করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু কিছু দিন পর দেখলাম এভাবে দিন চলছে না। এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম কাগজ টোকাবো। শুধু কাগজ টুকিয়েও পেটের ভাত যোগাড় করতে পারছিলাম না। এরপর কাগজের সাথে ডাস্টবিন থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী টোকাতে শুরু করলাম। সারাদিন ময়লা ঘেটে প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করে যা পাই তা ওই বড় ভাইয়ের হাতে তুলে দিই। সে-ই আমাকে খাবার আর গাঁজা কিনে দেয়। এভাবেই চলছে আমাদের দিন। পড়াশুনা করতে ইচ্ছে হয় না? জানতে চাইলে বলে, সেটা কিভাবে সম্ভব? আরেক পথ শিশু মোহন বলে, ওসব আমাদের দ্বারা হবে না। আমাদের কেবলমাত্র খেতে আর ঘুমাতে পারলেই হলো।
আরেক শিশু রাজন জানায়, এই এলাকায় শুধু আমরা নই। আমাদের মত অনেকেই গাঁজা, চাক্কি (ঘুমানোর ঔষুধ), ড্যান্ডি (জুতার আঠা) সেবন করে। আবার কেউ কেউ ইনজেকশন নেয়। এরপর দুজনেই বলতে থাকে এসব ছাড়াও আরও বেশ কিছু মাদক যেমন নকটিন (এক ধরনের পিল), গুল পাওয়া যায়। এখানকার প্রায় সব ছেলেই সেসব সেবন করে। কিন্তু আমরা শুধু গাঁজা আর ড্যান্ডি সেবন করি।
এরপর আরেক গলিতে গিয়ে দেখা গেল আরো কয়েকজন পথ শিশু খোলা রাস্তাতে দাঁড়িয়েই মাদক নিচ্ছে।
ড্যান্ডি বর্তমানে অধিকাংশ পথশিশুদের কাছে খুব জনপ্রিয় একটি মাদক। কারণ অল্প খরচে এবং খুব সহজে এটি পাওয়া যায়। এক বোতল ড্যান্ডি’র মূল্য ১৭০ থেকে ২০০টাকা।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে বর্তমানে প্রায় দশ লক্ষ পথশিশু রয়েছে, যার অর্ধেকের বয়স ১০-এর নিচে। আর এসব পথশিশুর মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশ মাদক সেবন করে।
মাদক বিরোধী সংগঠন ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ম্যানেজার সৈয়দা অনন্যা রহমান বলেন, সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। মাদকের ছোবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকার। এই শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম। পথশিশুরা খুব সহজেই মাদক জোগাড় করতে পারে। তাই আমাদের উচিত এ সংক্রান্ত আইনকে কাজে লাগানো। তবে মাদকের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করতে হবে সবার আগে।
তিনি বলেন, এসব পথ শিশুকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের পুনর্বাসনে সরকারসহ সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
মানবাধিকার কর্মী নুর খান বলেন, কেউ ইচ্ছে করে পথ শিশু হয় না। কেউ যাতে পথ শিশু না হয় সেদিকে আমাদের সবার আগে নজর দিতে হবে। এ জন্যে দরকার সমাজের পরিবর্তন। এটা কেবল সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সমাজের সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। কেবলমাত্র আইন করে পথ শিশুদের মাদক সেবন বন্ধ করা যাবে না। তাদের জন্য যথাযথ কাজ ঠিক করতে হবে। তারা যাতে সৎ পথে আয়ের মাধ্যমে জীবন চালাতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সচেতনতা, প্রচারণা।
পথ শিশুদের মাদক থেকে দূরে রাখতে সরকারি, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসহ সমাজের সর্বস্তরের সকলকেই আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হতে হবে।