শিরোনাম
মো. আয়নাল হক
রাজশাহী, ২৬ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস): বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উন্নীত করতে এবং পানির সংকট নিরসনে ভূপৃষ্ঠের পানি সংরক্ষণ, কৃত্রিমভাবে পানি পুনঃভর্তি, দক্ষ সেচ পদ্ধতি ব্যবহার এবং ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমানো- এই কৌশলগুলো গুরুত্বপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
খরা প্রবণ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমাতে পুরাতন পুকুর ও খাল পুনঃখনন, চেক ড্যাম নির্মাণ, কম পানিতে নিবিড় সেচ কৌশল গ্রহণ এবং বিকল্প পানির উৎস অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, ‘পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা অনেক জরিপ ও তদন্ত করে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার ২৫টি উপজেলার ৪৭টি ইউনিয়নকে অত্যন্ত পানি সংকট প্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।’
তিনি উল্লেখ করেন, বরেন্দ্র অঞ্চল উল্লেখযোগ্য পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এজন্য খরা সহনশীল ফসলের ওপর গুরুত্ব দিয়ে কৃষি-পরিবেশগত পরিকল্পনা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ‘সেচের কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর মারাত্মকভাবে নিচে নেমে গেছে। প্রাকৃতিকভাবে ও মনুষ্যসৃষ্ট উভয় কারণেই বেশিরভাগ উঁচু বরেন্দ্র ভূমিতে পানির স্তর কমে যাওয়া গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছেছে।’
অধ্যাপক সারওয়ার জাহান বলেন, ‘রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলার কিছু এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর হ্রাস পাচ্ছে। এটি পানির ওপর বড় ধরনের চাপের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। কলমা, মণ্ডুমালা, দেওপাড়া ও কাকনহাট এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর বিপজ্জনকভাবে একেবারে নিচে নেমে গেছে।’ এটি গভীর উদ্বেগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
এই অঞ্চলে অত্যধিক তাপমাত্রা বিরাজ করে এবং বৃষ্টিপাতও অনিয়মিত। ফলে ফসল উৎপাদন অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। অধ্যাপক সারওয়ার জাহান জোর দিয়ে বলেন, ‘টেকসই কৃষি-পরিবেশগত পরিকল্পনায় খরা, ভূ-গর্ভস্থ পানির অপচয়, খরা ও অপ্রত্যাশিত বৃষ্টির মতো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি সামগ্রিক পদ্ধতির প্রয়োজন, যা উন্নত পানি ব্যবস্থাপনা, ফসল উৎপাদন কৌশল ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির সমন্বয় করবে।’
টেকসই কৃষি-পরিবেশগত পরিকল্পনা কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে, ফলের মতো পানি-সাশ্রয়ী ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি, ভূ-পৃষ্ঠের পানির সঠিক ব্যবহার, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং মাটি ও পানির দূষণ রোধে কৃষিতে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো।
তিনি আরো বলেন, ‘বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর উন্নীত করতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা দরকার।’
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক নিয়ামুল বারী বাসস’র সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও কৃত্রিম রিচার্জ সিস্টেমে পরিচালিত করার জন্য চেক ড্যাম নির্মাণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ ভূ-পৃষ্ঠ ও ভূ-গর্ভস্থ জলাধারের ব্যবহারকে একত্রিত করে সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার পক্ষে কথা বলেন তিনি। এতে জলাধারের ওপর নির্ভরতা হ্রাস পাবে বলেও মনে করেন অধ্যাপক নিয়ামুল।
পাইপ ফুটো হয়ে পানির অপচয় কমাতে মাটির নিচ দিয়ে পাইপ বসিয়ে সেচ ব্যবস্থা বাস্তবায়নেরও সুপারিশ করেন অধ্যাপক নিয়ামুল। তিনি ন্যায়সঙ্গত পানির ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য পানির প্রিপেইড মিটার চালুর আহ্বান জানান। এতে কৃষক সেচ পদ্ধতিতে আরো দক্ষ হবে বলেও মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘টেকসই কৃষির জন্য খরা-সহনশীল ফসলের প্রচার এবং পরিবেশগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করে এমন পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান উল্লেখ করেন, কৃষি, খাদ্য উৎপাদন ও জনস্বাস্থ্যের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে জলবায়ু পরিবর্তন।
তিনি ভূ-পৃষ্ঠের পানি সংরক্ষণ এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে পরিত্যক্ত জলাশয়- যেমন পুকুর, খাল ও জলাভূমি পুনঃখননের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, ‘কৃষি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী কৃষকদের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নিজেদের অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধা অবশ্যই সুরক্ষিত রাখতে হবে।’
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) এই অঞ্চলে ভূ-পৃষ্ঠের পানি সেচ কাজে ব্যবহারের প্রচারে কাজ করছে। তারা পুকুর পুনঃখনন এবং ভূ-পৃষ্ঠের পানির স্তুর বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
বিএমডিএ-এর নির্বাহী পরিচালক তরিকুল আলম বাসস’কে বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ কমাতে ভ-ূপৃষ্ঠের পানি সেচকাজে ব্যবহার একটি কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে প্রমাণিত। এই অঞ্চলে অনেক প্রাকৃতিক জলাশয় অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ কমাতে ২০৩০ সালের মধ্যে ভূ-পৃষ্ঠের পানি ব্যবহার করে সেচ কাজ বর্তমান ১০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে।’