বাসস
  ২৯ মে ২০২৫, ১৪:০৯

আয়োডিনের অভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় গর্ভবতী মা ও শিশু 

ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা, ২৯ মে, ২০২৫ (বাসস): আয়োডিনের অভাবে গর্ভবতী মা ও শিশুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য আয়োডিন একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। এছাড়া মানবদেহের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক বৃদ্ধি, মানসিক পরিপূর্ণতা, মস্তিষ্কের গঠন ও বিকাশের জন্য অায়োডিন অপরিহার্য। 

মায়েদের গর্ভপাত রোধ, মৃত শিশুর জন্মরোধ এবং স্বাভাবিক শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার জন্য আয়োডিনের অবদান অনস্বীকার্য। তাই গর্ভবতী মায়েদের তো বটেই। এমনকি প্রতিটি মানুষের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় আয়োডিনযুক্ত খাবার থাকা বাঞ্ছনীয়।

আয়োডিনের অভাবে শিশুদের অপূর্ণ মানসিক বিকাশ বা প্রতিবন্ধিতা, কথা বলায় অসুবিধা, তোতলামি, বোবা, কানে খাটো বা বধির, বামন বা বেটে, হাঁটার সমস্যা ইত্যাদি হতে পারে।  

এছাড়া আয়োডিনের অভাবে গলগণ্ড বা ঘ্যাগ রোগ হয়ে থাকে। যা পরবর্তীতে ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। গলগণ্ড মানুষের স্বাভাবিক সৌন্দর্যও বিনষ্ট করে। এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের গলার সম্মুখ ভাগে অবস্থিত থাইরয়েড গ্রন্থিগুলো ফুলে আকারে বড় হয়ে যায় এবং বাইরে থেকে সহজেই নজরে পড়ে। সাধারণত ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। তাদের এ রোগ হলে বিয়ে দিতে সমস্যা হয়। মেয়েরা গলগণ্ড রোগে আক্রান্ত হলে পারিবারিক কলহের সৃষ্টি হতে পারে এবং কখনো কখনো তা বিবাহ বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়ায়।

আমাদের দেশে গলগণ্ড বা ঘ্যাগ রোগ একটি সামাজিক সমস্যা। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা যায়, এদেশে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ গলগণ্ড রোগে আক্রান্ত। এদের মধ্যে দেড় কোটি মানুষের গলগণ্ড দৃশ্যমান। বাকি চার কোটি লোকের গলগণ্ড আছে কিন্তু সেটা নজরে পড়ে না। দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১০ দশমিক ১৫ ভাগ লোকের গলগণ্ড দেখা যায় এবং এরমধ্যে শতকরা ৩৬ ভাগ আয়োডিন সমস্যায় ভুগছে। বাংলাদেশে প্রায় সব জেলাতেই কমবেশি গলগণ্ড রোগী রয়েছে। তবে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে গলগণ্ড রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। শুধু আয়োডিনের অভাবে মানুষের গলগণ্ড রোগ হয় তা সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। শারীরিক অন্যান্য সমস্যা থেকেও গলগণ্ড হতে পারে।  

আয়োডিনের অভাবে যেকোনো বয়সের মানুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটতে পারে। এর ঘাটতিতে গর্ভবতী মা ও শিশুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে আয়োডিনের অভাব অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ। 

আয়োডিনের অভাবে গর্ভবতী মায়ের গর্ভপাত, মৃত কিংবা বিকলাঙ্গ সন্তান প্রসবের ঝুঁকি থাকে। এছাড়া গর্ভবতী মায়ের দেহে আয়োডিনের অভাব হলে তার গর্ভের সন্তানও গুরুতর সমস্যার সম্মুখী হতে পারে। কেননা মস্তিষ্কের গঠন ও বৃদ্ধির জন্য আয়োডিন অপরিহার্য। শিশুর মস্তিষ্কের গঠন দু’বছর বয়সের মধ্যেই প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে যায়। তাই গর্ভে থাকাকালে এবং জন্মের পর আয়োডিনের অভাব হলে শিশুর মস্তিষ্কের অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে। আয়োডিনের স্বল্পতার কারণে শিশুরা তুলনায় কম বুদ্ধি সম্পন্ন হয়।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যেসব শিশু আয়োডিনের ঘাটতিতে ভোগে তাদের মেধা ও বুদ্ধি, যেসব শিশু আয়োডিনের ঘাটটিতে ভোগে না তাদের মেধা ও বুদ্ধির চেয়ে গড়ে দশ পয়েন্ট কম থাকে। 

আয়োডিনের ঘাটতি সম্পন্ন শিশুদের দেখতে স্বাভাবিক দেখালেও কম বুদ্ধিমত্তার কারণে তারা স্কুলে ভালো ফলাফল করতে পারে না। শিশু ও গর্ভবতী মায়ের এসব গুরুতর সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে দেহের চাহিদা অনুযায়ী আয়োডিনযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করা। আয়োডিনের চাহিদা বয়স অনুযায়ী হয়ে থাকে। শিশুর ক্ষেত্রে দৈনিক ৬০ থেকে ১০০ মাইক্রোগ্রাম, একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের দৈনিক ১০০ থেকে ১৪০ মাইক্রোগ্রাম, গর্ভবতী মহিলাদের ১২৫ মাইক্রোগ্রাম এবং স্তন্যদাত্রী মায়েদের জন্য দৈনিক ১৫০ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিনের প্রয়োজন হয়।

আমাদের দেশে বিভিন্ন উৎস থেকে আয়োডিনের চাহিদা পূরণ করা যায়। পানি ও মাটি আয়োডিনের মূল উৎস। সমুদ্রের পানিতে সবচেয়ে বেশি আয়োডিন থাকে। এছাড়া সামুদ্রিক মাছ, কডলিভার তেল, শাক-সবজি, খাবার পানি ও দুধেও আয়োডিন থাকে। কিন্তু আমাদের চাহিদা অনুযায়ী এ আয়োডিন একেবারেই নগণ্য। 

অপরদিকে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর মাটিতে আয়োডিনের পরিমাণ কম থাকায় এসব এলাকার শাক-সবজি, খাবার পানি এবং অন্যান্য খাদ্যে আয়োডিনের পরিমাণ খুব কম মাত্রায় থাকে। বস্তুত বাংলাদেশের মাটি ও পানিতে পর্যাপ্ত আয়োডিন নেই অথবা ঘাটতি আছে, এ কারণে মাটি থেকে যে খাদ্যদ্রব্য উৎপন্ন হয় তাতে খুব স্বাভাবিকভাবেই আয়োডিনের পরিমাণ কম থাকে। এজন্য অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মতো খাদ্যের মাধ্যমে আয়োডিনের চাহিদা পূরণের সুযোগ কম। তাই বিকল্প হিসেবে প্রতিদিন আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করে দেহে আয়োডিনের ঘাটতি পূরণ করা যায়। এছাড়া সামুদ্রিক মাছে প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন থাকে। যদি সপ্তাহে অন্তত একদিন খাদ্য তালিকায় সামুদ্রিক মাছ রাখা যায়, তাহলে আমাদের দেহে অনেকটা আয়োডিনের অভাব পূরণ করা সম্ভব।

আয়োডিন ঘাটতি পূরণের উপায় হিসেবে সারা বিশ্বে আয়োডিনযুক্ত লবণের ব্যবহার স্বীকৃত ও বহুল প্রচলিত। এই লবণের জন্য খুব একটা বাড়তি খরচও করতে হয় না। সাধারণ লবণের মতই এই লবণ ব্যবহার করা যায়।

গর্ভবতী স্তন্যদাত্রী মাকে নিয়মিত আয়োডিনযুক্ত লবণ ও আয়োডিন সম্পন্ন খাবার-দাবার গ্রহণ করতে হবে। এতে গর্ভবতী মায়ের শরীরের আয়োডিনের অভাব দূর হবে, গর্ভস্থ শিশুর মস্তিষ্কের স্বাভাবিক গঠনও বৃদ্ধি পাবে। শিশু হবে বুদ্ধিমান। নিয়মিত ও পর্যাপ্ত আয়োডিন গ্রহণের ফলে গলগণ্ড বা ঘ্যাগ রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তাই পরিবারের রান্নাবান্না ও অন্যান্য খাবারে সব সময় আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করা উচিত।

সর্বোপরি আয়োডিনের অভাবজনিত রোগবালাই থেকে মুক্ত হয়ে সুস্থ ও সবল জাতি গড়ে তোলার জন্য গর্ভবতী মা ও শিশুসহ পরিবারের সকলকেই সাধারণ লবণের পরিবর্তে নিয়মিত আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়ার জন্য ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।