শিরোনাম

আবদুস সালাম আজাদ জুয়েল
চাঁদপুর, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫ (বাসস): ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর পাক হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে মুক্ত হয়েছিল। এই দিনে সদর থানার সামনে চাঁদপুরের প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর সাবেক সিনিয়র সহ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ মাস্টার সেদিন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তি সংগ্রামে জেলার মুক্তিকামী জনতা এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল চাঁদপুরে পাক হানাদার বাহিনী দুটি প্লেন থেকে সেলিংয়ের মাধ্যমে প্রথম আক্রমণের সূচনা করে। প্রথম দিনেই হামলায় শহরের বাণিজ্যিক এলাকায় পুরান বাজারের এক নারী পথচারী নিহত হন। পর দিন বিকেলে প্রায় ৫ শতাধিক পাকসেনার একটি বহর চাঁদপুরে প্রবেশ করে।
শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে চাঁদপুর সরকারি কারিগরি উচ্চ বিদ্যালয়ে অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করে পাকিস্তানি সেনারা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্ট হাউসকে পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের বিশ্রামাগার বানানো হয়। ওই স্কুলের মাঠ থেকে প্রতিদিনের মতো লতুফা বেগম নামে এক বৃদ্ধা গরু-ছাগল নিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলেন। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা রাতের আহার জোগাড় করার জন্য প্রথম অপারেশন হিসেবে ওই বৃদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করে এবং বৃদ্ধার একটি গরু ও একটি ছাগল নিয়ে যায়।
এপ্রিল থেকে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের চলে দফায় দফায় গোলাগুলি। পরে গঠন করা হয় শান্তিবাহিনী। তারপর নতুন কায়দায় শান্তি বাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্ন জায়গায় চালাতে থাকে বর্বর অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ।
৮ এপ্রিল রাতেই চাঁদপুরে অবস্থানরত ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্নভাবে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা চালায়। পাকিস্তানি হানাদাররাও এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়ে প্রতিহত করতে থাকে। তখন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মক আহত হন। ৯ এপ্রিল ভোরে পাকিস্তানি মিলিটারি শহরে ঢুকে চাঁদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ইসমাইল হোসেন (৫৫) নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে। একই সঙ্গে তারা শহরের হাসান আলী হাইস্কুলের মোড়ে আপাক ও মাখন নামে দুই যুবককে সাইকেল চালাতে দেখে গুলি করে হত্যা করে।
এর পরেই তারা শুরু করে তাদের মূল অপারেশন কার্যক্রম। এ জন্য চাঁদপুর বড় স্টেশন মোলহেড এলাকায় হানাদার বাহিনীর একটি টর্চার সেল করা হয়। এখানে চাঁদপুর রেলপথ, সড়কপথ এবং নৌ-পথে যে সব যাত্রীদের সন্দেহ হয়েছে তাদের ধরে এনে অমানবিক নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ করা হতো। পরে ওই মরদেহগুলো মেঘনা এবং পদ্মা নদীতে ফেলে দিতো। যার সাক্ষী আজও পদ্মা-মেঘনা নদী বহন করছে।
এভাবে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানের দোসররা কত লোককে হত্যা করেছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। চাঁদপুর জেলায় (তৎকালীন মহকুমা) সর্বশেষ যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল ৭ ডিসেম্বর লাকসাম ও মুদাফ্ফরগঞ্জ মুক্ত হওয়ার পর। যৌথ বাহিনী হাজীগঞ্জ দিয়ে ৬ ডিসেম্বর চাঁদপুর আসতে থাকলে মুক্তিসেনারা হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করে।
ভারতীয় গার্ডস রেজিমেন্টের নেতৃত্বে ৩১১তম মাউন্টেন ব্রিগেড ও ইস্টার্ন সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা যৌথ আক্রমণ চালায়। দিশা না পেয়ে পাকিস্তান ৩৯ অস্থায়ী ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল রহিম খানের নেতৃত্বে দুটি জাহাজে করে নৌ-পথে ঢাকার উদ্দেশে চাঁদপুর থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় মুক্তি বাহিনী এবং মিত্র বাহিনীর ট্যাংক ও প্লেনের আক্রমণে নদীতেই পাকসেনাদের চির কবর রচিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে চাঁদপুর পৌরসভা ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ২০১৩ সালে বড় স্টেশনে ‘রক্তধারা’ নামে বধ্যভূমি নির্মাণ করা হয়। এর আগে চাঁদপুরের প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কালাম, খালেক, সুশিল ও শংকরের নামে ট্রাংক রোডে নির্মাণ করা হয় ‘মুক্তি সৌধ’ এবং চাঁদপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে লেকের ওপর দৃশ্যত ভাসমান মুক্তি স্মৃতিসৌধ ‘অঙ্গীকার’ নির্মাণ করা হয়।
চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে এ জেলায় স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের নামের তালিকা সম্বলিত একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া চাঁদপুর পৌরসভার ৫ রাস্তার মোড়ে পৌরসভার অর্থায়নে নির্মাণ করা হয় ‘শপথ চত্বর’।
১৯৯২ সাল থেকে প্রতি বছর ১ ডিসেম্বর সার্বজনীনভাবে চাঁদপুর শহরের হাসান আলী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অঙ্গীকারের পাদদেশে মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদদের স্মৃতিকে স্মরণ ও নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্য এই মেলার আয়োজন হয়ে আসছিল। ২০২৩ সালে স্থান পরিবর্তন করে এই মেলার আয়োজন হয় শহরের আউটার স্টেডিয়ামে। তবে ২০২৪ সাল থেকে মেলা আয়োজন বন্ধ রয়েছে।
চাঁদপুর মুক্ত দিবসের আগের ঘটনার বর্ণনা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ মাস্টার। তিনি সদর উপজেলার দক্ষিণাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি বর্তমানে শহরের পুরান বাজারে বসবাস করেন।
আব্দুল হামিদ মাস্টার বাসসকে বলেন, ৮ ডিসেম্বর সকালে আমাদের সহযোদ্ধা শহীদুল্লাহ ভুঁইয়া, হোসেন ব্যাপারী বহরিয়া বাজারে ছিলাম। ঠিক ওই সময় পাক সেনাদের একটি জাহাজ মেঘনা নদী দিয়ে চাঁদপুরের দিকে যাচ্ছিল। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জানান দিতে আমার হাতে থাকা গ্রেনেড ছুড়ি। তখন আওয়াজ হলে পাকবাহিনী পাল্টা গুলি ছুড়ে। তখন ওয়াপদা সংলগ্ন ওই স্থানে একটি গবাদি পশু এবং এক কিশোরের মৃত্যু হয়। এরপর পাকবাহিনী তিন নদীর মোহনায় আসার পরে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এভাবেই ৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর জেলা হানাদারমুক্ত হয়।
চাঁদপুর মুক্ত দিবস উপলক্ষে চাঁদপুর জেলা প্রশাসন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এ উপলক্ষে আগামীকাল সকাল ১০টায় শহরের মুক্তিযোদ্ধা সড়কে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য ‘অঙ্গীকার’ পাদদেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। এছাড়া একই স্থানে বেলুন ও ফেস্টুন ওড়ানো হবে। সবশেষে শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করা হবে। এই কর্মসূচিতে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সংশ্লিষ্টরা অংশ নেবেন।