শিরোনাম

মুহাম্মদ নুরুজ্জামান
খুলনা, ২৩ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস): হালকা শীতের আভাস ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। এখনো পুরোদমে শীতের পোশাক কেউ না পরলেও, শীতের পিঠার সুঘ্রাণে ম ম করছে অলিগলি। শীতের আগমনের সাথে সাথে খুলনা মহানগরী ও এর আশপাশের এলাকায় জমজমাট হয়ে উঠেছে পিঠার আসর। ঐতিহ্যবাহী শীতকালীন পিঠার পসরা সাজিয়ে বসেছেন পিঠা ব্যবসায়ীরা। শীত শুরু হতে না হতেই পিঠার অস্থায়ী দোকানে ভরে উঠেছে শহর ও শহরতলির ফুটপাত, মোড় ও জনবহুল এলাকা।
একসময় শীত আসলেই ঘরে ঘরে তৈরি হতো শীতের পিঠা। কিন্তু এখন অনেকেই বিশেষ করে নাগরিক জীবনে শীতের পিঠা বানিয়ে খাওয়ার সময় নেই মানুষের। তারা নির্ভর করে থাকেন পিঠা ব্যবসায়ীদের ওপর। তাই শীত আসলেই পিঠা প্রেমীদের ভিড় জমে এসব পিঠার দোকানে।
সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর পাড়ায় পাড়ায় প্রতিদিন বিকেল নামতেই ভিড় করছে নানা বয়সি মানুষ। গভীর রাত পর্যন্ত থাকছে ভোজনপ্রিয় মানুষের ভিড়। নগরীর বিভিন্ন জনবহুল এলাকা, রাস্তার মোড়, ফুটপাত এবং স্থানীয় বাজারে অস্থায়ী স্টলগুলোতে ভাপা, চিতই, পাটিশাপটা, নকশি, দুধপুলি এবং অন্যান্য জনপ্রিয় পিঠার মতো বিভিন্ন ধরনের শীতকালীন সুস্বাদু খাবার বিক্রি হচ্ছে। বিশেষ করে সন্ধ্যায় সদ্য প্রস্তুতকৃত গরম পিঠার স্বাদ উপভোগ করতে জড়ো হয় মানুষ। নতুন চাল এবং ভাপা পিঠার সুবাস সব বয়সের মানুষকে আকর্ষণ করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলিও পিঠা উৎসবের আয়োজন করছে। যা ঋতুগত পরিবেশকে আরও সমৃদ্ধ করছে।
বাংলাদেশে শীতকালীন পিঠার একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। যার মধ্যে পাটিশাপটা, ভাপা, কুলি, চিতই এবং তেলের পিঠা সবচেয়ে জনপ্রিয়।
নগরীর রূপসা ঘাট, পিটিআই মোড়, দোলখোলা মোড়, শিশু হাসপাতাল রোড, শান্তিধাম মোড়, জাতিসংঘ পার্কের পশ্চিম প্রান্তে, ইসলামপুর রোড, গল্লামারী, পিকচার প্যালেস মোড়, ক্লে রোড, স্টেশন রোড, কদমতলা রোড, খানজাহান আলী রোড, সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড, নিউ মার্কেট, খালিশপুর, দৌলতপুর এবং রেল স্টেশন এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ১০০টিরও বেশি অস্থায়ী পিঠার স্টল স্থাপন করা হয়েছে। সন্ধ্যা জুড়ে বিক্রেতারা আগ্রহী ক্রেতাদের গরম পিঠা পরিবেশন করেন। অনেক সময় পিঠা প্রস্তুতকারকদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। সিরিয়াল দিয়ে অপেক্ষাও করতে হয় ক্রেতাদের।
নগরীর শান্তিধাম এলাকায় চার বছর ধরে পিঠা বিক্রি করে আসা মৌসুমি পিঠা বিক্রেতা মঞ্জুর রহমান জানান, তিনি গত ১৫-২০ দিন ধরে চিতই পিঠা তৈরি করছেন। প্রতিবছরই শীতকালে তিনি পিঠা বিক্রি করেন এবং অন্যান্য মৌসুমে ফলের ব্যবসা করেন। প্রতিটি চিতই পিঠা ৫ টাকায় বিক্রি হয় এবং বিক্রিও ভালো হয়।
তিনি বলেন, ‘শীতকাল পুরোপুরি শুরু না হলেও প্রতিদিন ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা আয় হয়। চাল, গুড়, সরিষা এবং জ্বালানির দাম বাড়ায় লাভ কম হচ্ছে। তবে শীতকালে বিক্রি সাধারণত দ্বিগুণ হয়।’
পিঠার ক্রেতা শহীদুল ইসলাম বলেন, আমি প্রতি বছর মঞ্জুরের কাছ থেকে পিঠা কিনি। কারণ পিঠাগুলো সুস্বাদু হয়। সন্ধ্যায় এই স্টলে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ ভিড় জমান।
পিঠা বিক্রেতা মো. রুহুল আমিন তিনটি চুলায় পিঠা বানান। তার দোকানে দুইজন কর্মচারী পিঠা তৈরি করেন একজন গ্রাহকদের পরিবেশন করেন। শীতকালে ভালো আয় হয় বলে জানান রুহুল আমিন।
নগরীর সোনাডাঙ্গা মোড়ের পিঠা বিক্রেতা মর্জিনা বেগম বলেন, আমি আর আমার স্বামী একসাথে পিঠার ব্যবসা করি। অনেকেই আমার তৈরি পাটিসাপটা, কুলি, চিতই এবং ভাপা পিঠা খেতে আসেন। প্রতিদিন ২৫০-৩০০ পিঠা বিক্রি হয়। খরচের পর আমাদের প্রতিদিন প্রায় ৮০০ টাকা আয় হয়। মর্জিনা এবং মফিজ মিয়া দম্পতি পরিবারের ভরণপোষণের জন্য মৌসুমি আয়ের উপর নির্ভরশীল।
চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে মঞ্জুর, রুহুল এবং মর্জিনার মতো অনেকেই মৌসুমি ব্যবসা হিসেবে পিঠা তৈরির দিকে ঝুঁকেছেন। এই ব্যবসা খুলনায় শীতকালে অনেক নিম্ন আয়ের পরিবারকে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করেছে।
পিঠা বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শীতের শুরু থেকে কয়েক মাস ধরে এই পিঠা বিক্রি হয়। এসময় ভালো আয় ও হয়। ব্যবসা শুরু করার জন্য খুব কম মূলধনের প্রয়োজন হয় এবং অনেকে খরচ কমাতে জ্বালানি হিসেবে কাঠ বা শুকনো ডাল ব্যবহার করেন। আবার কেউ কেউ গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করেন।
অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বাসসকে বলেন, শীতকাল নিম্ন আয়ের পরিবারগুলির জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করে। কেউ পিঠা বিক্রি করে, কেউ মাঠে কাজ করে। শীতের আয়ে অনেক পরিবারেরই কয়েক মাসের ভরণপোষণ হয়। এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারের সহায়ক ভূমিকা প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, গ্রামীণ পরিবারগুলো ঐতিহ্যগতভাবে বাড়িতে শীতকালীন পিঠা তৈরি করে। কিন্তু ব্যস্ত শহুরে জীবনে এই ধরনের কার্যকলাপের জন্য খুব কম সময় থাকে। তাই তারা পিঠার দোকান থেকে পিঠা কিনে খেতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।