শিরোনাম

\ মো.তানভীর হায়াত খান \
নেত্রকোণা, ১৮ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : রোপা আমন ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন নেত্রকোণা জেলার কৃষকেরা। ফলন ভালো হওয়ার পাশাপাশি এ বছর ধানের ভালো বাজার থাকায় কৃষকেরা খুশি।
এবছর ১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে রোপা আমন ধানের চাষ করা হয়েছে।
জেলার হাওরবেষ্টিত তিন উপজেলা যথাক্রমে মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুড়ির বেশিরভাগ ফসলি জমি পানির নিচে ডুবন্ত থাকায় জেলার বাকি সাতটি উপজেলার রোপা আমন চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
এবছর কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলেও ভাইরাস ও পোকার আক্রমণে ফসলের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। রোপা আমন ধান চাষে খরচের পরিমান কম, বৃষ্টির পানিতে সেচের কাজ হয়ে যায় বলে তাতে খরচও কম।
জেলার দুই পাহাড়ি উপজেলা দুর্গাপুর ও কলমাকান্দায় রোপা আমনের চারা আগেভাগেই রোপণ করা হয় বিধায় ফসল কাটাও শুরু হয় সবার আগে।
সরেজমিনে দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলায় গিয়ে দেখা যায়, কৃষকেরা পাহাড়ের পাদদেশে রোপা আমন ধান কাটতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সীমান্তবর্তী বাড়িগুলোতে নবান্ন উৎসবের আয়োজনে প্রস্তুতি নিচ্ছেন কিষানিরা। কৃষকেরা ধান কেটে বাড়ি নিয়ে আসছেন বাঁশের তৈরি ভারে করে, কোথাও ধান সিদ্ধ হচ্ছে দেশীয় পদ্ধতিতে, আবার কোথাও শুকানো হচ্ছে খড়। আর সীমান্ত সংলগ্ন সড়কে সূর্যের আলোয় সিদ্ধ ধান শুকিয়ে নিচ্ছেন কিষানিরা।
জেলায় রোপা আমন এবং বোরোধান কাটার সময় প্রতিটি কৃষকের বাড়িতে উৎসবর আমেজ তৈরি হয়। এসময় কৃষকদের পাশাপাশি কিষানিরাও সমানতালে নতুন ধান সিদ্ধ করা, রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নেন। এ কৃষি উৎসবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সদর উপজেলার উলুয়াটি গ্রামের কিষানি রেহানা পারভীন জানান, নিজেদের জমিতে উৎপাদিত সোনালি ধান কাটার পর শুরু হয়ে যায় তাদের কাজ, যেমন ধান শুকানোর জায়গা (উঠান,মাঠ) প্রস্তুত, ধান মাড়াই, সিদ্ধ করা এবং তা রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা। এসব কাজ তারা সকলে মিলে আনন্দের সাথে করে থাকেন, তবে তা বেশ পরিশ্রমের কাজ। নতুন ধান ঘরে এলে কৃষকের মুখে ফুটে হাসি, ঘরে ঘরে শুরু হয় নতুন ধানের চাল দিয়ে পিঠা, পুলি, পায়েশ বানানোর তোরজোর।
সীমান্তবর্তী কালিকাপুর গ্রামের কৃষক আমিরুল ইসলাম জানান, এবছর আমনের ভালো ফলন হয়েছে। ২০ কাঠা জমিতে রোপা আমনের চাষাবাদ করেছেন। কাঠাপ্রতি ৪ মণ করে ধান পেয়েছেন। তিনি জানান, বাতাসে ধানের গাছ মাটিতে পরে যাওয়ায় ফসলের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে।
একই গ্রামের কৃষক নূরুল ইসলাম ৩২ কাঠা জমিতে রোপা আমনের চাষাবাদ করেছেন। তিনি জানান, এ মৌসুমে সেচের খরচ না থাকায় কৃষকেরা ধান চাষে লাভবান হয়েছেন এবং খরচ বাদে মুনাফাও থাকবে।
এ বছর ধানের ফলন ভালো হওয়ার পাশাপাশি ভালো বাজার রয়েছে বলে মনে করছেন ধানের ব্যবসায়ীরা।
প্রান্তিক কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে তা প্রক্রিয়াজাত করে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠিয়ে থাকেন তারা।
প্রান্তিক কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে তা বাজারে বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করেন, ধান ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম।
তার সাথে কথা হলে তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, এবছর ধানের ভালো দাম পাবে কৃষকেরা। ইতোমধ্যে কাঁচা ধান প্রতি মণ ১০০০ থেকে ১১০০ টাকায় উঠানামা করছে। ধান শুকানোর পর এ ধানের দাম আরো বাড়বে বলে মনে করছেন তিনি।
স্থানীয় কৃষকদের সাথে কথা বলে জানাযায়, ধানের বাজার ভালো থাকলেও রয়েছে ধানকাটা শ্রমিকের তীব্র সঙ্কট। এখন আর আগেরকার সময়ের মতো ধান কাটতে শ্রমিক পাওয়া যায় না। আগে যারা ধান কাটায় শ্রম দিতেন, তারা এখন শহরমুখী হয়ে যাচ্ছেন। কাজের সুবাদে রাজধানী ঢাকার দিকে ধাবিত হচ্ছেন বেশিরভাগ ধানকাটাসহ বিভিন্ন পেশার শ্রমিকেরা।
শ্রমিক পাওয়া গেলেও কৃষকের প্রত্যাশিত মজুরি অনুযায়ী কাজ করতে চায় না এসব ধানকাটা শ্রমিকেরা। ফলে বাধ্য হয়ে কৃষকেরা ঝুঁকছেন হারভেস্টার মেশিন মালিকদের কাছে। কাঠাপ্রতি ৫০০ টাকায় এসব মেশিনের মাধ্যমে কৃষকের ধান কেটে দিচ্ছেন তারা।
কৃষিতে এ আধুনিক যান্ত্রিক সেবায় স্বস্তিও পাচ্ছেন কৃষকেরা, আবার কম সময় হারভেস্টার মেশিনে অধিক জমির ফসল কাটা যায়। ফলে কৃষকের কষ্ট লাঘব হচ্ছে এবং সময়ও বেঁচে যাচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আমিরুল ইসলাম বাসসকে জানান,‘নেত্রকোণা একটি হাওরবেষ্টিত জেলা। এ জেলার প্রধান ফসল হচ্ছে ধান। জেলায় এবছর রোপা আমনের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার ৯০০ হেক্টর। সেই লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এবছর জেলায় ১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে রোপা আমনের আবাদ হয়েছে। ইতোমধ্যে ধান কাটা শুরু হয়েছে। আজকে পর্যন্ত মোট ২৩ হাজার ৯৩ হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে, যা মোট জমির ১৬ ভাগ।
তিনি বলেন, এবছর এ জেলায় বি-ধান ৪৯, ব্রি ধান-৭১,ব্রি ধান-৭৫ ব্রি ধান-৮৭, ব্রি-ধান ১০৩, ধানী গোল্ড জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এছাড়াও আমাদের বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটে উদ্ভাবিত বিনা ধান ৭ ও বিনা ধান ১৭ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। কৃষক ভাইয়েরা তাদের আশানুরূপ ফলন পেয়েছেন।
তিনি আরো জানান, ইতোমধ্যে হাওরের ডুবন্ত জমিগুলো জেগে উঠতে শুরু করছে এবং তারা জমির পরিচর্যা করতে শুরু করেছেন, কৃষকরা যেন এসব জমিতে রবি শস্য উৎপাদন করতে পারেন, সেজন্যে তাদেরকে কারিগরি সহযোগিতা প্রধান করা হবে।’