বাসস
  ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১৬:০৪
আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১৬:৩৫

ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির সুনাম এখন বিশ্বজুড়ে সমাদৃত

ছবি : সংগৃহীত

।। মহিউদ্দিন সুমন।।
টাঙ্গাইল, ১৫ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ হাতে বোনা তাঁতের শাড়ি এখন বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। শতাব্দী প্রাচীন এই তাঁতের শাড়ির উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে। বিশেষ ধরনের উৎকৃষ্ট মানের সুতা দিয়ে হাতে বোনা তৈরি এ শাড়ি পড়তে যেমন আরামদায়ক, তেমনই নরম। আর তাই যে কোনো অনুষ্ঠানেই বাঙালী নারীর প্রথম পছন্দ টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতের শাড়ি। নিজের জন্য কিংবা প্রিয়জনকে উপহার দেয়ার জন্য টাঙ্গাইল শাড়ির জুরি নেই।

প্রবাদ আছে "নদী-চর, খাল-বিল, গজারির বন টাঙ্গাইল শাড়ি তার গর্বের ধন"। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি দেশ পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। বিশেষ ধরনের উৎকৃষ্ট মানের সুতা দিয়ে হাতে বুনে তৈরি করা হয় এ শাড়ি। বোনার ধরন, রঙ, নকশা সব কিছুই আলাদা। এই শাড়ি তৈরি করতেও বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হয়। 

শাড়ি ব্যবসায়ীরা জানান, মুসলমানদের দুটি ঈদ ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজায় টাঙ্গাইল শাড়ির চাহিদা বেড়ে যায়। টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ির জন্যই টাঙ্গাইলের সুনাম বা পরিচিতি দেশের সীমা ছাড়িয়ে এর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। আর সে কারণে তাঁতি শিল্পীরা তাঁত শিল্পের বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে টাঙ্গাইলের সফট সিল্ক ও কটন শাড়িতে। দৃষ্টি কারছে এই শাড়ির বৈচিত্র্য বুনন ও নতুনত্ব ডিজাইন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, টাঙ্গাইল তাঁত শিল্পের প্রসার প্রায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে। বসাক সম্প্রদায়ের লোকেরাই টাঙ্গাইলের আদি তাঁতি। মূলত সনাতন ধর্মবলম্বী তাঁতিদের মৌলিক উপাধি হলো বসাক। এরা আসলে দেশান্তরি তাঁতি। ঢাকা ও ধামরাই ছিল যাদের আদি নিবাস।

টাঙ্গাইল শাড়ির ডিজাইনে নতুনত্ব সৃষ্টিতে যাদের অবদান রয়েছে তারা হলেন, বাজিতপুরের আনন্দ মোহন বসাক, সীতানাথ বসাক, চন্ডি গ্রামের নীল কমল বসাক, মনে মন্টু; নলসুন্দা গ্রামের হরেন্দ্র বসাক, পাথরাইল গ্রামের রঘুনাথ বসাক, আনন্দ, গোবিন্দ, সুকুমার বসাক, খুশি মোহন বসাক-এর নাম উল্লেখযোগ্য।

তারা জানান, টাঙ্গাইলের শাড়ি বুননের মূল কাজ একেবারেই আলাদা। অনেক পুরোনো একটা ঐতিহ্যের ধারায় চলে আসছে এ কাজ। সেই জ্ঞান ও নিষ্ঠা ছাড়া আসল টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরি করা সম্ভব না। আসল টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরির জন্য এর তাঁতি বা কারিগরদের শিল্পী হয়ে উঠতে হয়। টাঙ্গাইলে সেই শিল্পী তাঁতি আছেন। তাই টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প ও তাঁতের শাড়ির এতো সুখ্যাতি।

প্রবাদ আছে: "চমচম, টমটম ও শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইল বাড়ি" যাদের জন্মই হয়েছে তাঁতের খটখট শব্দ শুনে, তারা জানে প্রতিটি শাড়ি বুননের মধ্যেই লেপ্টে আছে ইতিহাসের গন্ধ, তারা তো এই তাঁতশিল্প নিয়ে গর্ব করবেই! তাঁতশিল্প বাংলাদেশের অন্যতম পুরোনো কুটিরশিল্প। টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি তারই ঐতিহ্য বহন করে আসছে যুগ যুগ ধরে। টাঙ্গাইলের দক্ষ কারিগররা তাদের বংশ পরম্পরায় তৈরি করছেন এ শাড়ি। তাই জেলার নামেই এ টাঙ্গাইল শাড়ির নামকরণ করা হয়েছে। টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি বলা হয়, পাথরাইলে তৈরিকৃত তাঁতের শাড়িকেই।

টাঙ্গাইলের বিখ্যাত তাঁত পল্লী পাথরাইল, চন্ডি, বাজিতপুর ও পুটিয়াজানি গ্রামেই এখন ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি তৈরি হয়। এ সব গ্রাম থেকেই সুতি জামদানী, সফ্ট সিল্ক, ধানসিঁড়ি, বালুচুরি, গ্যাসসিল্ক, স্বর্নকাতান, দোতারি, চোষা ও রেশম শাড়ির মত বাহারি ডিজাইনের শাড়ি তৈরি করে সরবরাহ করা হচ্ছে সারাদেশে।

সরেজমিনে জেলার দেলদুয়ার পাথরাইলে তাঁত শিল্প এলাকায় ঢুকতেই তাঁতের খটখটি শব্দ কানে ভেসে এল। এখানে দিন রাত চলে কাপড় বোনার প্রাতিযোগিতা। কত দ্রুত এবং কত বেশি মানসম্মত শাড়ি তৈরি করা সেই চেষ্টায় ব্যস্ত থাকেন তাঁত শিল্পীরা। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। 

এ জেলার প্রায় ১০ হাজার তাঁতি কাপড় বুননের কাজে সম্পৃক্ত রয়েছেন বলে জানান.শাড়ি ব্যবসায়ীরা।

টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির পুরো কাজ হয় দেশীয় পদ্ধতিতে। নিজেদের বাড়িতে তাঁত বসিয়ে কাজ করেন অনেক কারিগর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ৫টি করে তাঁত বসানো হয়েছে। কোথাও ৬ টি, কোথাও আবার ১০টিও আছে। প্রত্যেকের জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা জায়গা। 

তারা বলেন, প্রথমে সুতা তৈরি করা হয়, এরপর তা দিয়ে বোনা হয় তাঁত। প্রতিদিন সকাল ৮ টা থেকে শুরু হয়ে তাঁতিদের কাজ চলে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। সপ্তাহে তারা দুটি শাড়ি তৈরি করেন। মানভেদে একজন কারিগর একটি শাড়ি তৈরি করতে সময় নেয় ২ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত। তবে সময়ের সাথে কমেছে কাজ, কমেছে মজুরি। আগে যেখানে একজন মজুরি পেত ৭০০-৮০০ টাকা, তা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৬০০-৭০০ টাকায়। এ কারণে অনেকেই পেশা পরিবর্তন করছেন। 

জানাযায়, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির জন্য করটিয়া হাটের সুনাম রয়েছে। করটিয়া সাপ্তাহিক মঙ্গলবার হাটে তাঁতজাত পণ্য ক্রয়ের জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা ভিড় জমান। করটিয়া হাটে অনেক রকমের বিভিন্ন ডিজাইনের কাপড় সরাসরি তাঁতীদের কাছ থেকে সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়। এ হাট থেকে পাইকারি দরে কাপড় কিনে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা।

শাড়ি তৈরির কারিগরা জানান, টাঙ্গাইলের শাড়ির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পাড় বা কিনারের কারুকাজ। জরি অথবা রেশমের সুতা দিয়ে তৈরি হয় এই শাড়ির পাড়। একেকটি শাড়ি তৈরিতে সময় লাগে ৭দিন থেকে ১ মাস পর্যন্ত।

তাঁত শ্রমিক আনোয়ার হোসেন বলেন, আগে সপ্তাহে তিনটি শাড়ি তৈরি করতে পারতাম। কিন্তু এখন সপ্তাহে চারটি শাড়ি তৈরি করছি। মজুরি কম থাকায়, নতুন করে কেউ এ কাজে আসতে চায় না। ধান কাটতে একদিনে মজুরি পাওয়া যায় ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। তবুও ধান কাটার শ্রমিকের সমান মজুরি পাওয়া যায় না। আমাদের মজুরি বাড়ানো হলে পরিবার নিয়ে একটু ভালোভাবে চলতে পারতাম।

তাঁত শ্রমিক নারায়ন চন্দ্র বলেন, ২৩ বছর ধরে এ পেশায় জড়িত আছি। প্রতি পিস শাড়িতে ৬০০ টাকা মজুরি দেওয়া হয়। সপ্তাহে ৫টি শাড়ি তৈরি করছি। এতে আমাদের পোষায় না। কম মজুরি দিয়ে সংসার চালানো দুরূহ হয়ে উঠেছে। আগের মতো জমজমাট নেই তাঁতপল্লী। তবুও বাপ-দাদার পেশা ধরে রেখেছি আমরা।

শাড়ি বিক্রেতারা জানান, আগে যে শাড়ি তৈরিতে ৫০০ টাকা খরচ হতো, তা এখন ৬০০ টাকার বেশি খরচ হয়ে যাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে ব্যবসার অবস্থা বেশি খারাপ যাচ্ছে। তার কারণ, কাঁচামালের দাম যেভাবে বাড়ছে, সে হারে শাড়ির দাম বাড়ে নি।

অন্যদিকে ক্রেতারাও বলছেন, মানে ভালো এবং দামে কম থাকায় টাঙ্গাইলের শাড়ি তাদের পছন্দ। তবে নানা কারণে আগের থেকে দাম বেড়ে যাওয়ায় কমেছে শাড়ি কেনার পরিমাণ। আমরা যখন টিনেজ ছিলাম, তখন আমরা ২০০ টাকা দিয়েও শাড়ি কিনেছি। আর এখন সে শাড়িগুলোর দাম বেড়ে গেছে। এ কারণে নববর্ষ ও ঈদ ছাড়া তেমন শাড়ি কেনা হয় না।

শাড়ি ব্যবসায়ীদের সাথে কথা হলে তারা জানান, সবনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে শাড়ি বিক্রি করা হয়। পাওয়ার লুমের কারণে হ্যান্ডলুমের তৈরি শাড়ি কম চলে। হ্যান্ডলুমের শাড়ির দামও বেশি। ঈদ, দুর্গা পূজা ও পহেলা বৈশাখের সময় ভালো শাড়ি বিক্রি হয়। 

শাড়ি ডিজাইনার ও বিশিষ্ট শাড়ি ব্যবসায়ী নীল কমল বসাক বলেন, নানা প্রতিকূলতার মাঝেও ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ির মান ধরে রাখতে টাঙ্গাইল শাড়িতে আনা হয়েছে বাহারি ডিজাইন আর নতুনত্ব। দেশে শাড়ির চাহিদা কমে যাওয়ায় শাড়ি উৎপাদন ও বিক্রি কমে গেছে। তবে ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, সৌদি আরব, ভারতের বিভিন্ন রাজ্য টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। 

তিনি বলেন, সরকারি সহায়তা পেলে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এ শাড়ি রপ্তানি করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকার অর্জন করতে পারে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। তবে দেশে শাড়ির ব্যবসা এভাবে খারাপ চলতে থাকলে এ শিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। 

টাঙ্গাইল জেলা শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাকের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, নববর্ষ, ঈদ ও পূজার সময় প্রতি বছর বিভিন্ন ডিজাইনের তাঁতের শাড়ি তৈরি করা হয়। এর মধ্যে সিল্ক, বিখ্যাত জামদানি, সফ্ট সিল্ক, দোতারি, রেশম ও তশর অন্যতম। সিল্ক শাড়ি সাড়ে ৩ হাজার টাকা থেকে ১৪ হাজার, নেট জুট সাড়ে ১০ হাজার, বাহার শাড়ি সাড়ে ১৬ হাজার, কটন জুট আড়াই হাজার এবং টিস্যু সিল্ক সাড়ে ৪ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়।

তিনি আরো জানান, স্বাভাবিক সময়ে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয় টাঙ্গাইলের শাড়ির। নানা কারণে গত কয়েক বছর ধরে বিশেষ করে করোনা মহামারীর সময় থেকে শাড়ির ব্যবসা কমে গেছে। মূলধন, প্রয়োজনীয় উপকরণের সমস্যা, নকশা ও প্রযুক্তিগত সমস্যা, দক্ষতার অভাব, বিপণনসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তাঁতি সম্প্রদায়।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শরীফা হক বাসসকে জানান, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি। এ পণ্যটি প্রচার ও প্রসারে জেলা প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে টাঙ্গাইল জেলা কারাগারে তাঁত বুনন যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে কয়েদিদের প্রশিক্ষণের জন্য। যেন তারা জেলখানা থেকে বের হয়ে তাঁত ভিত্তিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে নিতে পারে। আমাদের প্রত্যাশা ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ হাতে বোনা টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি বিশ্ব বাজারে স্থান করে নিবে এবং সম্মানের সাথে টিকে থাকবে।