শিরোনাম

মো. তানিউল করিম জীম
ময়মনসিংহ (বাকৃবি), ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ (বাসস): ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় পাক হানাদার বাহিনী মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে বাকৃবির পাশ দিয়ে প্রবাহিত পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী ৩০ লাখ শহীদের গৌরবময় তালিকায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) বেশ কয়েকজন সূর্যসন্তানের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তাঁদের আত্মত্যাগকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে অম্লান করে রাখতেই বাকৃবি প্রাঙ্গণে নির্মিত হয়েছে মরণ সাগর, বিজয়-৭১ এবং বধ্যভূমি।
এছাড়া ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪ এর যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ছয় দফা আন্দোলন, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা এবং ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় বাকৃবি ছিল বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের এক বলিষ্ঠ কেন্দ্র। এসব স্মৃতিস্তম্ভের নকশায় ফুটে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আত্মত্যাগের গভীর প্রতীকী ভাষা। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে স্মরণ করিয়ে দেয় বারবার।
১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তান ভেটেরিনারি কলেজ থেকে পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই এর নাম ঘোষণা করা হয়, স্বাধীন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) নামে পরিচিতি লাভ করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায়, একাত্তরের ২৬ মার্চ সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবন প্রাঙ্গণে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. কিউ. এম. ফজলুর রহিম দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা দেন যে ‘আজ থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হবে স্বাধীন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।’ এই ঘোষণার পর বিপুলসংখ্যক ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী সরাসরি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগিতায় বাকৃবির শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ সব শ্রেণির মানুষকে হত্যা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে শিক্ষকদের মধ্যে শহীদ হন সহকারী অধ্যাপক এ.বি.এম আশরাফুল ইসলাম ভূঁইয়া। কর্মচারীদের মধ্যে শহীদ হন মো. আক্কাছ আলী, মধুসূদন বর্মন, মো. নুরুল হক, মো. গাজী ওয়াহিদুজ্জামান, মো. হাসান আলী ও গিয়াস উদ্দিন।
এছাড়াও শিক্ষার্থীদের মধ্যে শহীদ হয়েছেন, মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের মো. জামাল হোসেন, আব্দুল মতিন খন্দকার (টিপু) ও মনিরুল ইসলাম আকন্দ; কৃষি প্রকৌশল অনুষদের নাজির আখতার কাশেম ও আ.ন.ম নাজমুল আহসান; কৃষি অনুষদের হাবিবুর রহমান ও খুরশীদ আলম (শিবলী); ভেটেরিনারি অনুষদের আবুল কাশেম, কাজী মো. মঞ্জুর হোসেন ও ইব্রাহীম মোস্তফা কামাল এবং কৃষি অর্থনীতি অনুষদের মো. শামসুল হক তালুকদার ও মো. তহসীন আলী।
বাকৃবিতে শহীদ শিক্ষার্থীদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে তিনটি আবাসিক হল। শহীদ শিক্ষার্থী মো. জামাল হোসেনের নামে ১৯৮৮ সালের ১৩ অক্টোবর নির্মিত হয় শহীদ জামাল হোসেন হল। আ.ন.ম নাজমুল আহসানের স্মরণে ১৯৭৩ সালের ২৪ নভেম্বর নির্মিত হয় শহীদ নাজমুল আহসান হল। আর ১৯৭২ সালের ১৯ জুলাই সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে পূর্বের কায়েদে আযম হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় শহীদ শামসুল হক হল।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী ৩০ লাখ শহীদের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) বহু জানা-অজানা ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংরক্ষিত ডায়েরিতে একজন শিক্ষকসহ ১৮ জন শহীদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডায়েরিতে ৮৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম উল্লেখ রয়েছে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—তৎকালীন শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর শামসুল ইসলাম, সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. রফিকুল হক, প্রফেসর আতিয়ার রহমান মোল্লা, প্রফেসর ড. সাখাওয়াত হোসেন, প্রফেসর ড. শেখ জিনাত আলী, প্রফেসর ড. নূর মো. তালুকদার এবং তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাবেক রেজিস্ট্রার মো. নজিবুর রহমানসহ আরও অনেকে।
মরণ সাগর
একটি সম্পূর্ণ প্রস্ফুটিত শাপলা ফুলের (মরণ সাগর) মধ্য থেকে উঠে এসেছে দুটি দৃঢ় হাত। এক হাতে উঁচু করে ধরা রাইফেলের অগ্রভাগে বাঁধা বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। এ প্রতীক যেন জানিয়ে দেয় যে, সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়েই অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া বাকৃবির ১৯ জন শহীদের নাম মরণ সাগরের দেয়ালে খোদাই করে লেখা রয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভের লাল রঙের সিঁড়ি ও মেঝে স্মরণ করিয়ে দেয় এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার কথা।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নির্মিত এই স্মৃতিস্তম্ভটি পরবর্তীতে আরও নান্দনিক ও তাৎপর্যময় করে গড়ে তোলা হয়। তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আলী আকবরের (২০১৫-২০১৯) পৃষ্ঠপোষকতায় এবং মুক্তিযুদ্ধ স্থাপনা সংস্কার সম্পর্কিত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় সংস্কার ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে মরণ সাগর বর্তমান অবয়বে রূপ নেয়।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই দেশসেরা কৃষি বিদ্যাপীঠে আগত হাজারো মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও শহীদদের আত্মত্যাগের গল্প তুলে ধরবে মরণ সাগর। নীরব অথচ গভীর কণ্ঠে যেন স্মৃতিস্তম্ভটি উচ্চারণ করে মরণ সাগর পারে, তোমরা অমর—তোমাদের স্মরি।
বধ্যভূমি
পাক হানাদার বাহিনীর পাশবিকতার হাত থেকে রেহাই পায়নি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিজয়ের পতাকা হাতে নিয়ে অসংখ্য মানুষ প্রিয়জনের সন্ধানে ছুটে আসে গণকবরের পাশে। এসব বীর শহীদের আত্মাহুতিকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে বাকৃবির ফাস্টগেট এলাকায় একটি বধ্যভূমি স্থাপন করা হয়।
স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন সেখানে কোনো দৃশ্যমান স্মৃতিস্তম্ভ না থাকলেও স্থানটি বধ্যভূমি হিসেবে ঘোষিত ছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশে একযোগে বিভিন্ন জেলায় বধ্যভূমি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলে বাকৃবিতেও বধ্যভূমি নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ গণপূর্ত অধিদপ্তর (পিডব্লিউডি)-এর অর্থায়ন ও পরিকল্পনায় বাকৃবিতে নির্মিত বধ্যভূমির নির্মাণকাজ শুরু হয়। এরপর ১৯৯৩ সালের ১৪ নভেম্বর তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর ড. শাহ মো. ফারুক আনুষ্ঠানিকভাবে বাকৃবির বধ্যভূমি উন্মোচন করেন।
‘বিজয় ’৭১’
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনের সামনে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘বিজয় ’৭১’। এটি শুধু একটি ভাস্কর্য নয়—এটি বাঙালির দীর্ঘ লড়াই, আত্মত্যাগ ও চূড়ান্ত বিজয়ের প্রতিচ্ছবি।
জানা যায়, তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেনের নেতৃত্বে প্রখ্যাত ভাস্কর্যশিল্পী শ্যামল চৌধুরী ‘বিজয় ’৭১’-এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন। ১৯৯৮ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয়ে ২০০০ সালের জুন মাসে এর কাজ শেষ হয়। ভাস্কর্যটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ২৪ লাখ টাকা।
বিজয় -৭১ সম্পর্কে অনুভূতি প্রকাশ করে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লিখন ইসলাম বলেন, আমরা নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু ভাস্কর্যের দিকে তাকালেই মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের কথা মনে পড়ে। ‘বিজয় -৭১ এর সামনে দাঁড়িয়ে যখন তেজোদীপ্ত ছাত্রকে রাইফেল হাতে দেখি, তখন মনে হয় যে আমি তরুণ, আমি ছাত্র, দেশের সেবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করাই আমার দায়িত্ব। নারী স্তম্ভ আমাদের একসঙ্গে পথ চলার অনুপ্রেরণা দেয়। পতাকা হাতে কৃষক জানান দেন, যে আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। পৃথিবীর খুব কম দেশই আছে, যারা আমাদের মতো এত ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বাসসকে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতি তথা বাংলাদেশের জনগণের অস্তিত্ব, মর্যাদা ও আত্মপরিচয়ের চূড়ান্ত ভিত্তি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার সূতিকাগারই নয়, বরং স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বাঙালি তথা বাংলাদেশের জনগণের স্বাধিকার আন্দোলনের এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের ধারক।
তিনি বলেন, মরণ সাগর, বধ্যভূমি ও ‘বিজয় ’৭১’ এই স্মৃতিস্তম্ভগুলো আমাদের কাছে নিছক স্থাপনা নয়। এগুলো শহীদদের রক্তে রচিত ইতিহাস, ত্যাগের ভাষ্য এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জীবন্ত দলিল।
আজকের এই দিনে শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছি যে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের আদর্শ সমুন্নত রেখে বাংলাদেশ গঠনে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সবসময় সন্মুখযোদ্ধা হিসাবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।