শিরোনাম
তানভীর হায়াত খান
নেত্রকোণা, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : মালচিং পদ্ধতিতে উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড সুগার কুইন জাতের তরমুজ চাষে নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার চাষিরা সফলতা পেয়েছেন। এই জাতের তরমুজ সারা বছরই ফলন দিয়ে থাকে।
সাধারণত দেশে গ্রীষ্মকালে তরমুজের চাষ হয় ফলে সারাবছর এ ফল পাওয়া যায় না। তাই এ পদ্ধতিতে চাষ হওয়ার ফলে সারাবছরই বাজারে যোগান দিতে সক্ষম হওয়ায় কৃষকেরা বেশ আগ্রহ নিয়ে তা আবাদ করছেন। সুগার কুইন তরমুজ সুস্বাদু ও মিষ্টি হওয়ায় বাজারে চাহিদা বেশি। সেই সঙ্গে লাভও বেশি। সুগার কুইন জাতের প্রতিটি তরমুজের ওজন হয়ে থাকে ৩-৫ কেজি। আর প্রতি বিঘায় দেড় থেকে ২ হাজার তরমুজ পাওয়া যায়।
আগে যেসব জমি গ্রীষ্মকালে বেশিরভাগ সময় পতিত থাকতো, কিছু গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষ হতো, সেসব জমিতে বর্ষা মৌসুমে এখন সুগার কুইন জাতের তরমুজ চাষ করেছেন কৃষকেরা। উচ্চ ফলনশীল মার্সেলো জাতের এ তরমুজ উচ্চমাত্রায় ভাইরাস সহনশীল। লম্বাটে ডিম্বাকৃতির এ তরমুজের ভিতরের অংশ গাঢ় লাল রঙের।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এই জাতের তরমুজ ৬৫ থেকে ৭০ দিনে পরিপক্ক হয়। উৎপাদনকাল স্বল্প হওয়ায় দ্রুত বাজারজাত করা যায় এবং বাজারে ভালো চাহিদা থাকায় কৃষকেরা লাভবান হচ্ছেন।
বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের আওতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তরুণ ও বেকারদের প্রশিক্ষণের আওতায় এনে মাঠ পর্যায়ে চাষিদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের মাঝে কৃষি কাজের আগ্রহ বাড়ছে তার প্রমাণ এই মালচিং পদ্ধতি।
কেন্দুয়া উপজেলার গড়াডোবা ইউনিয়নের পাথারিয়া গ্রামের তরুণ সারোয়ার আহমেদ সায়েম। তিনি কেন্দুয়া সরকারি কলেজে ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত একজন শিক্ষার্থী। পড়াশোনার পাশাপাশি ইউটিউব থেকে আধুনিক কৃষির ভিডিও দেখে কৃষি কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। ইউটিউবে মালচিং পদ্ধতিতে তরমুজ চাষের ভিডিও দেখে তিনি প্রথমে উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করেন। কৃষি অফিস তার জমির প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে দেখে পাথারিয়া এলাকার জমি বেলে দোআঁশ মাটি, যা তরমুজ চাষের জন্য খুবই উপযোগী।
পরবর্তীতে কৃষি বিভাগের পরামর্শে সায়েম তাঁর বাবাকে সঙ্গে নিয়ে এবং কৃষি অফিস থেকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রথম বছর ৪০ শতাংশ জমিতে ৫০ হাজার টাকা খরচ করে ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেন। প্রথম বছরের অভাবনীয় সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সায়েম চলতি বছর ৫ একর জমিতে তরমুজের চাষ করেছেন। জমিতে ফলনও বেশ ভালো হয়েছে। সায়েম এ বছর বেশ লাভবান হবেন বলে আশাবাদী।
তরমুজ চাষে এ সায়েমের সফলতা দেখে এলাকার অন্যান্য কৃষকরা আগ্রহী হচ্ছেন গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষে। বিশেষ করে যুবকদের এমন আগ্রহ কৃষি খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশাবাদী কৃষি বিভাগ।
সায়েম জানান, পড়াশোনা শেষ করে অনেকেই দেখেছি বেকার বসে থাকতে। তাই আমার মাথায় চিন্তা আসলো কিভাবে নিজ এলাকায় থেকে কৃষিতে ভালো কিছু করতে পারি। ইউটিউবে মালচিং পদ্ধতিতে তরমুজ চাষ করা দেখে বেশ আগ্রহ জন্মায়।
সায়েমকে দেখে গ্রামের আরো অনেক কৃষক মালচিং পদ্ধতিতে গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। ইতিমধ্যে এ বছর সায়েমের প্রতিবেশী সুমন মিয়া নামে এক কৃষক গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষ করেছেন।
সুমন মিয়া প্রতি বছর উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শে নতুন নতুন ফসল চাষ করে থাকেন। তারই ধারাবাহিকতায় এবার কৃষি অফিসের সার্বিক সহযোগিতায় ৫০ শতক জমিতে তিনি সুগার কুইন জাতের রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার ছাড়াই বিষমুক্ত তরমুজ চাষ করেছেন। বর্তমান বাজারে প্রতি কেজি তরমুজ বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকায়। কম পরিশ্রম ও ভালো দাম পেয়ে খুশি তিনি।
উপজেলা উপসহকারী কৃষি অফিসের পরামর্শে সুমন তরমুজ চাষে আগ্রহী হন। বীজও সংগ্রহ করেন কৃষি অফিস থেকে। রোপণ থেকে ফলন আসা পর্যন্ত সার্বক্ষণিক পাশে ছিলেন কৃষি বিভাগ।
বাঁশ ও প্লাস্টিকের সুতায় তৈরি করা হয় মাচা, সেই মাচার ওপরে জায়গা করে নেয় তরমুজের সবুজ পাতা। মাচার নিচে ঝুলে আছে খেতে ভীষন মিষ্টি এ তরমুজ। গাছ থেকে ছিঁড়ে না পড়ে, তার জন্য প্রতিটি তরমুজের জন্যে বাঁশের খুঁটিতে দেওয়া হয়েছে জালি। প্রতিটি জালিতে বড় হয় একেকটি তরমুজ।
তরমুজ ক্ষেতের এই অসাধারণ সফলতা ও বাস্তব চিত্র দেখতে জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে পাথারিয়া গ্রামে প্রতিদিনই ভীড় জমান কৃষিপ্রেমীরা। কে কেউ নগদ টাকায় কিনে ক্ষেতে বসে তাজা তরমু খেয়ে তৃপ্তি নেন। আবার পরিবারের জন্যেও কিনে নিয়ে যান। আগত অনেক দর্শানার্থী, উদ্যোক্তা ও চাষিরা কিভাবে এ পদ্ধতিতে চাষ করে লাভবান হওয়া যার তার বুদ্ধি, পরামর্শ নিয়ে যাচ্ছেন বেশ আগ্রহের সাথে।
কেন্দুয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হুমায়ুন দিলদার বলেন, ‘রাসায়নিক সার ও বিষমুক্ত তরমুজ চাষ করতে মালচিং পদ্ধতিতে উচ্চ ফলনশীল সুগার কুইন জাতের তরমুজ চাষ করা হয়েছে উপজেলার ২ একর জমিতে। গাঢ় লাল রঙের আর স্বাদ খুব ভালো হওয়ায় কম খরচের পাশাপাশি বর্ষাকালে এই তরমুজ চাষ হওয়ায় কৃষকরা বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তাই কৃষকরা ১২ মাসি তরমুজ চাষের দিকে ঝুঁকছেন। কৃষকরা যাতে আরো উৎসাহ পায় সেদিকে আমরা কাজ করছি, আমরা নিয়মিত এখানে পরিদর্শন করছি, আর তাদের সার্বিক সহযোগিতা করছে কৃষি বিভাগ।’
তরুণ প্রজন্মের মাঝে কৃষিকাজে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রসঙ্গে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আরো বলেন, "যুবকদের এমন আগ্রহ কৃষি খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষি আরও লাভজনক পেশায় পরিণত হচ্ছে। আমাদের একটা নির্দেশনা থাকে, আমরা যেন শিক্ষিত লোকদের বেশি প্রশিক্ষণের আওতায় আনি। শিক্ষিত তরুণরা খুব সহজে এবং দ্রুত আমাদের প্রযুক্তি গ্রহণ করেছে, যার প্রমাণ আমরা পাথারিয়া গ্রামে পেয়েছি। তিনি বলেন, এখানে প্রথম প্রথমে এক বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ হয়, সফলতা পেয়ে ২ একর জমিতে এখন তরমুজ চাষ করা হচ্ছে। শিক্ষিত তরুণ সমাজকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ইতিবাচক ফলাফল আমরা পেয়েছি, তারা কৃষিকাজে আগ্রহের সাথে এগিয়ে এসেছে, তাদের এ আগ্রহ এবং কৃষিকাজে সম্পৃক্ততার জন্যে আমাদের বেকারত্বের সমস্যা কমবে এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বাড়বে"।