বাসস
  ২৩ আগস্ট ২০২৫, ১৯:০২
আপডেট : ২৩ আগস্ট ২০২৫, ১৯:০৯

সারাদেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হলেই ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব: বক্তারা 

উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আজ ঢাকার মতিঝিলে ডিসিসিআই মিলনায়তনে আয়োজিত ফোকাস গ্রুপ আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন। ছবি: পিআইডি

ঢাকা, ২৩ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : আজ এক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নদী দখল ও দূষণ, পরিবেশ দূষণ, পলিথিনের উচ্চ ব্যবহার এবং অসহনীয় যানজটের কারণে রাজধানী ঢাকায় বসবাস ক্রমাগতভাবে অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।

তাদের মতে, এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিতকল্পে সারাদেশের টেকসই উন্নয়ন জরুরি। 

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘রাজধানী ঢাকার টেকসই উন্নয়নে বিকেন্দ্রীকরণ ও পরিবেশ সুরক্ষা’ শীর্ষক ফোকাস গ্রুপ আলোচনা সভায় বক্তারা আজ এসব কথা বলেন।

পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগদান করেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, দেশের জলবায়ু পরিবর্তন ঢাকার বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে আরো প্রকট করছে। সারাদেশের টেকসই উন্নয়ন করতে হলে, তা সমাজ থেকে আসতে হবে, যেটা আমাদের মধ্যে বেশ অভাব রয়েছে।

উপদেষ্টা বলেন, ঢাকায় জনসংখ্যা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ রাখা বেশ কষ্টসাধ্য। বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করতে ঢাকার আশেপাশের শহরগুলোকে স্যাটেলাইট শহর হিসেবে গড়ে তোলা জরুরি।

তিনি বলেন, পলিথিন ব্যবহার কমাতে গত এক বছরে অনেক ঝুঁকি মোকাবেলা করে বেশকিছু কাজ করেছি। এখন সরকারি অনেক সংস্থাও এগিয়ে আসছে এবং আশা করছি ভবিষ্যতে ভালো ফল পাওয়া যাবে। পরিবেশ দূষণমুক্ত চাইলে দূষণকারী শিল্পকারখানা বন্ধ করতে শিল্প-উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

সভার স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, দেশের জিডিপিতে ঢাকা শহরের অবদান ৪৫ শতাংশ।  যদিও ২০২২ সালে বুয়েট পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার প্রতিদিন যানজটের জন্য ১৪০ কোটি টাকার কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।

তিনি বলেন, ঢাকার উপর চাপ হ্রাস ও বিকেন্দ্রীকরণের জন্য প্রশাসনিক এবং বাণিজ্যিক কাজে ঢাকার আশেপাশের শহরগুলোকে সেকেন্ডারি শহর হিসেবে তৈরি করতে হবে। 

ঢাকাকে বাসযোগ্য ও টেকসই মহানগর হিসেবে গড়ে  তুলতে সরকারি বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগের কোন বিকল্প নেই বলে মত প্রকাশ করেন ডিসিসিআই সভাপতি।

রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, টেকসই ঢাকা তৈরি করতে হলে পুরো বাংলাদেশকেই টেকসই করতে হবে, যা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ কর্মসংস্থানের অন্যতম উৎস হিসেবে রাজধানী শহরের কোন বিকল্প উৎস নেই, এর উপর চাপ প্রতিনিয়ত বাড়ছে এবং ভবিষ্যতেও এটা কমার সম্ভাবনা প্রতিফলিত হচ্ছে না। ঢাকার সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য সমন্বিত পরিকল্পনার কোন বিকল্প নেই।

সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, বাংলাদেশের নগর জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ রাজধানীতে বসবাস করলেও ঢাকার সবুজায়নের অভাব এবং উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে এখানকার জীবনযাপন বর্তমানে হুমকির মুখে পড়েছে।

তিনি বলেন, অতিকেন্দ্রিকতার কারণে ঢাকায় বন্যা, জলাবদ্ধতা বৃদ্ধি, বর্জ্য অব্যবস্থাপনার সংকট, নগর দূষণ এবং জনস্বাস্থ্য সংকট প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিশেষ করে দেশের নদীগুলোর সুরক্ষার জন্য তিনি নদী কমিশনের সক্ষমতা ও আইনি ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন।

ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণে সুষম নগরায়ণ ও শহরের বিকেন্দ্রীকরণ ও গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের উপর তিনি জোরারোপ করেন। এছাড়াও ঢাকার প্রস্তাবিত রিং-রোডগুলোকে যোগাযোগের করিডোর বিবেচনা করে প্রাধিকার ভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা জরুরি বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) সভাপতি ড. আদিল মোহাম্মদ খান, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ভূগোলবিদ ও নগর পরিকল্পনাবিদ দিলবাহার আহমেদ, রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)-এর সিনিয়র সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া, ডিসিসিআইর সাবেক সহ-সভাপতি এম. আবু হোরায়রা, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক, রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম, স্থাপত্য অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাসির, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. জিয়াউল হক এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের  (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।

বিআইপি সভাপতি ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ঢাকার উন্নয়নকে মহানগরের বাইরে নিয়ে যেতে হবে। এর জন্য দেশের প্রান্তিক এলাকাগুলোর অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য যথাযথ উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কার্যকর বাস্তবায়ন করতে হবে।

রিহ্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, ঢাকার রাস্তায় যান্ত্রিক ও অ-যান্ত্রিক যানবাহন চলার কারণে অসহনীয় যানজট হয়ে থাকে, এর দ্রুত প্রতিকার প্রয়োজন। তিনি রাজধানীর বাইরে সকল নাগরিক সুবিধা সম্বলিত স্যাটেলাইট শহর তৈরির উপর জোরারোপ করেন এবং এ জন্য বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে বলে মত প্রকাশ করেন।

ডিসিসিআইয়ের সাবেক  সহ-সভাপতি এম আবু হোরায়রা বলেন, জীবিকাসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ঢাকা আসার কারণে শহরটি প্রতিনিয়ত ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে, তাই বিকেন্দ্রীকরণের কোন বিকল্প নেই।

বুয়েটের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক বলেন, গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন না করে আমরা মেগা পরিকল্পনার উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। ফলে সামগ্রিকভাবে আমাদের ব্যয় বেড়েছে, যদিও তা জনগণের কাজে আসছে না। 

দেশের সমন্বিত উন্নয়নের জন্য সুষম পরিকল্পনার কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

দিলবাহার আহমেদ জানান, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ইতোমধ্যে ১২৫ কিলোমিটার খাল উদ্ধার করেছে ও বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। সেই সাথে রিজিওন্যাল ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান বাস্তবায়ন ও ঢাকার বাইরে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ  মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ৩টি রিং রোডের মাধ্যমে ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণের প্রস্তাব হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ঢাকার চাপ কমাতে সাভার ও গাজীপুরকে স্যাটেলাইট শহর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের উপর আহ্বান জানান তিনি।

সাবেক প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ কাজী গোলাম নাসির বলেন, ১ হাজার ৫২৮ বর্গ কিলোমিটারের ঢাকা শহরের পরিকল্পনার জন্য দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের উপর জোর দিতে হবে। খণ্ডিত পরিকল্পনার কোন সুযোগ নেই, তাই সার্বিকভাবে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন একান্ত অপরিহার্য।

ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার কারণ চিহ্নিত রয়েছে, তবে এর বাস্তব সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পলিথিন ব্যবহারের উচ্চ হার ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ এবং পলিথিনের ব্যবহার হ্রাসকরণে জনগণকে নাগরিক দায়িত্ববোধ নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি রাজিব এইচ চৌধুরী, পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এবং সংশ্লিষ্ট খাতের স্টেকহোল্ডারবৃন্দ এসময় উপস্থিত ছিলেন।