শিরোনাম
\ দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ \
কুমিল্লা, ২৩ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : দেশের পোশাক শিল্পে ঐতিহ্য সংযোগকারী অন্যতম শিল্প কুমিল্লার বাটিক। জেলার গ্রামীণ জীবনে দীর্ঘদিন ধরে বিকশিত হয়েছে এই বাটিক কাপড়। একসময় কুমিল্লার খাদি বা খদ্দরের কদর অনেক বেশি ছিল। তার পাশাপাশি অবস্থান করে নেয় বাটিক শিল্প। কালক্রমে বাটিক কুমিল্লার খাদির সমান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সময়ের আবর্তে কুমিল্লার খাদি অস্তিত্ব সংকটে পড়লেও বাটিক আজও দৃঢ়ভাবে টিকে আছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রায় অর্ধশত বছরের ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প ছোট পরিসরে বা ব্যক্তি মালাকানায় পরিচালিত হলেও দেশ ও দেশের বাইরে এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করেছে। দিন দিন বাড়ছে এর জনপ্রিয়তা। সম্পূর্ণ হাতে তৈরি কুমিল্লার বাটিক শিল্প উপযুক্ত সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করবে।
সদর দক্ষিণ উপজেলার কমলপুর, সদর উপজেলার গলিয়ারা, বরুড়া ও চৌদ্দগ্রামের কিছু অংশে ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে রঙিন বাটিক কাপড়। শাড়ি, থ্রি-পিস, ওড়না, লুঙ্গি, বিছানার চাদর থেকে শুরু করে আধুনিক পোশাক। বিভিন্ন আঙ্গিকে নতুন নতুন নকশার ছোঁয়া পাচ্ছে এ শিল্প।
স্বাধীনতার আগে সীমিত আকারে থাকলেও স্বাধীনতার পর দেশীয় শিল্পের প্রসারের ফলে এটি নতুনভাবে জেগে ওঠে। সেই ধারাবাহিকতায় আজও কুমিল্লার গ্রামাঞ্চলে কাঠের ব্লকে খোদাই করে মোম দিয়ে ডিজাইন তোলার মাধ্যমে বাটিক তৈরির ধারা বহমান। বিশেষ করে কমলপুর ও গলিয়ারা গ্রামকে বলা হয় ‘কুমিল্লার বাটিকের আঁতুড়ঘর’। এখানকার নারীরা ঘরে বসেই পুরুষদের সহায়তায় বাটিক তৈরি করেন।
কুমিল্লার বাটিক এখনো সম্পূর্ণ হাতের তৈরি। প্রথমে কাঠের ডাইসে বিশেষভাবে নকশা খোদাই করা হয়। এরপর গলিত মোম কাপড়ে মুদ্রণ করা হয়। পরে বিভিন্ন রঙে ডুবিয়ে নকশাকে দৃশ্যমান করা হয়। প্রতিটি ধাপই সময়সাপেক্ষ ও শ্রমনির্ভর।
সরেজমিনে কমলপুরের মাঠে গিয়ে দেখা যায়, বাঁশের খুঁটিতে ঝুলছে রঙিন বাটিক কাপড়। বাড়ির আঙিনায় কিংবা ছোট ছোট কারখানায় নারী-পুরুষ মিলেই ব্যস্ত সময় পার করছেন।
বাটিক ব্যবসায়ীরা জানান, প্রথমে নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ থেকে সাদা কাপড় আনা হয়। এরপর দক্ষ কারিগরেরা রং, মোম ও নকশার সমন্বয়ে শিল্পসত্তা ফুটিয়ে তোলেন। একটি বাটিক কাপড় তৈরিতে রং করা, নকশা আঁকা, ধোয়া ও শুকানোসহ প্রতিটি প্রক্রিয়ায় সময় লাগে তিন থেকে চার দিন।
স্থানীয় উদ্যোক্তারা জানান, একটি কারখানায় তিন থেকে চার দিনে ৫০০ থেকে ৬০০ পিস কাপড় উৎপাদন সম্ভব। বর্তমানে পাইকারি দরে একটি বাটিক শাড়ি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ১১০০ টাকায়, থ্রি-পিস ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায়, বিছানার চাদর ৭০০ থেকে ১২০০ টাকায় এবং লুঙ্গি ২০০ থেকে ৪০০ টাকায়।
দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারি ক্রেতারা নিয়মিত কুমিল্লায় আসেন বাটিক কিনতে। পাশাপাশি অনলাইন অর্ডারের মাধ্যমে সারা দেশেই পাঠানো হচ্ছে এসব পোশাক।
বর্তমানে বাটিক কাপড়ের চাহিদা বহুগুণ বেড়েছে। কুমিল্লা শহরসহ রাজধানী ঢাকার ফ্যাশন হাউসগুলোতে নিয়মিত সরবরাহ করা হচ্ছে এসব পণ্য। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে কুমিল্লার বাটিক শাড়ি, লুঙ্গি, ওড়না ও বিছানার চাদর। বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশিরা এগুলো বেশি পছন্দ করছেন। এতে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে, তেমনি কর্মসংস্থানও বাড়ছে।
বাটিক কারিগর আবদুল জলিল বাসসের সাথে আলাপকালে বলেন, বাটিক কেবল কাপড় নয়, এটি এক ধরনের শিল্প। প্রতিটি ডিজাইনে জড়িয়ে থাকে শ্রম ও সৃজনশীলতা।
স্থানীয় ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলাম বলেন, আমরা এখন সীমিত পরিসরে উৎপাদন করি। কিন্তু সরকারি সহযোগিতা পেলে বড় আকারে কারখানা গড়ে তোলা সম্ভব। এতে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
বর্তমানে কুমিল্লার বিভিন্ন গ্রামে প্রায় ১৫টি বাটিক কারখানা রয়েছে। প্রতিটি কারখানায় ১০ থেকে ১৫ জন কারিগর কাজ করেন। পাশাপাশি অনেক পরিবার ঘরে বসেও উৎপাদনে যুক্ত। নারীদের অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য। এতে একদিকে স্থানীয় আয়ের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার হচ্ছে।
কমলপুর বাটিক পল্লির একটি কারখানার মালিক মো. রাশেদুল ইসলাম জানান, প্রায় পাঁচ দশক আগে তার চাচা লাল মিয়া মেম্বারের হাত ধরে এ গ্রামে বাটিক শিল্পের সূচনা হয়। কলকাতা ও ভারতের ত্রিপুরায় গিয়ে তিনি কাপড়ে মোম ও রঙের কৌশল শিখে দেশে ফিরে আসেন। ধীরে ধীরে এ শিল্পের পরিসর বাড়তে থাকে এবং বর্তমানে কমলপুরের বাটিক দেশবিদেশে সুনাম কুড়িয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের গ্রামের বাটিক মান ও নকশার দিক থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য বহন করে। এগুলো যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনি পরতেও আরামদায়ক।
নগরীর কান্দিরপাড়ের খাদি ও বাটিক ব্যবসায়ী জোসনা স্টোরের মালিক তপন পাল বলেন, কুমিল্লার বাটিক কাপড়ে স্থানীয় নকশার পাশাপাশি আধুনিক ফ্যাশনের ছোঁয়া আছে। এগুলো যদি ব্র্যান্ডিং করা যায়, তবে বৈশ্বিক বাজারেও জায়গা করে নিতে পারবে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) দীর্ঘদিন ধরে কুমিল্লায় কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি বাটিক শিল্পের উন্নয়নে প্রশিক্ষণ, ঋণ সুবিধা ও বাজারজাতকরণে সহায়তা দিচ্ছে।
কুমিল্লা বিসিকের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. মুনতাসির মামুন বাসসকে বলেন, ‘কুমিল্লার বাটিক শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও পরিচিতি পাচ্ছে। বিসিক সব ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে। ব্যবসায়ীরা যদি বড় আকারে কারখানা গড়তে চান, আমরা প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে প্রস্তুত।’