শিরোনাম
মো. মামুন ইসলাম
রংপুর, ২৪ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : লালমনিরহাটের ছোট্ট এক গ্রামের কৃষক পরিবারে জন্ম উম্মে কুলসুম পপির। গ্রামের সবুজ-শ্যামল কৃষি প্রকৃতির মাঝে কেটেছে তার শৈশব ও কৈশোর। এ সময় তিনি গ্রামের মাটি ও মানুষের সাথে মিশে কৃষিক্ষেত্রকে নিবিড়ভাবে জানার চেষ্টা করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য শহরমুখী হলেও বারবার ছুটে গেছেন সেই শেকড়ের কাছে।
এক পর্যায়ে কৃষি উন্নয়নে ছোট ও তথ্যবহুল ভিডিও বানাতে শুরু করেন পপি। এতে তিনি নানা ধরনের ফুল ও ফলের চাষ নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি কৃষিজ নানা কৌশল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে থাকেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই ভিডিওগুলো প্রচার করে তিনি বদলে দিয়েছেন কৃষি নিয়ে জানা, শেখা ও ভাবনার পদ্ধতি। অনলাইনে তার ভিডিওগুলো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে উম্মে কুলসুম পপি হয়ে উঠেন দেশের একজন সফল ও জনপ্রিয় নারী অ্যাগ্রো-ইনফ্লুয়েন্সার।
ফেসবুকে তার ২৯ লাখের বেশি ফলোয়ার রয়েছে। তার ইউটিউব চ্যানেলে ৫ লাখ ১৮ হাজারের বেশি সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। এসব প্ল্যাটফর্মে তিনি সহজ ভাষায় প্রচার করছেন আধুনিক কৃষি, জৈব চাষ, পশুপালন ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের নানা পদ্ধতি। তার ভিডিওগুলো একদিকে যেমন অপ্রাতিষ্ঠানিক কৃষিশিক্ষার পাঠশালা, তেমনি তা তুলে ধরছে কৃষি খাতে নারীদের অপার সম্ভাবনা।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা-বাসস’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পপি বলেন, ‘ আমরা নিরাপদ ফল রপ্তানি করতে চাই এবং এমন একটি কৃষিভিত্তিক পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই, যেখানে মানুষ প্রকৃতি ও খাদ্যের সঙ্গে আবারও গভীরভাবে সংযুক্ত হতে পারবে।
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান নিয়ে পড়ালেখা করেন উম্মে কুলসুম পপি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সময় পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্র ও সৃষ্টিশীল চিন্তাধারার জন্য পরিচিত আবু সাঈদ আল সাগরের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। কয়েক বন্ধু মিলে ‘ক্রিয়েটিভ সোসাইটি’ নামে একটা সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন সাগর। উপস্থাপনা শেখার পাশাপাশি সেখানে গ্রাফিক ডিজাইন এবং ভিডিও এডিটিংয়ের কাজ শিখতেন তারা। পপিও সেখানে যোগ দেন ।
এই প্ল্যাটফর্মই পরে ২০১৬ সালে ‘বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট লিমিটেড’ নামে একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগে রূপ বদল করে।
এই সামাজিক উদ্যোগটি পড়ালেখা থেকে ঝরেপড়া তরুণদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ইলেকট্রনিকস মেরামতের কাজ শেখায় এবং ফেসবুকের মাধ্যমে তাদের গ্রাহকের সঙ্গে যুক্ত করে। এই কাজের জন্য তারা ব্যবসায়িক পুরস্কার পান এবং মুম্বাইয়ে আমন্ত্রণও পান। যদিও পারিবারিক কারণে পপি যেতে পারেননি, তবে সেখানে দলটির প্রতিনিধিত্ব করেন সাগর।
২০২০ সালের কোভিড মহামারিতে বড় ধাক্কা খায় বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট লিমিটেড। তবে সেই সংকটেই দেখা মেলে নতুন সম্ভাবনার। রংপুর অঞ্চলের বাগানে আম পচে যাচ্ছিল। সরবরাহ ব্যবস্থায় ভেঙে পড়ায় বাজারজাত করা যাচ্ছিল না। এই সুযোগটিই কাজে লাগান পপি ও সাগর। তারা চালু করেন ‘প্রিমিয়াম ফ্রুটস’ নামে একটি অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যা উত্তরাঞ্চলের বাগান থেকে নিরাপদ ও বিষমুক্ত আম সারাদেশে পৌঁছে দিচ্ছে । শুরুর দিকে জনপ্রিয় হাঁড়িভাঙ্গা আম দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার ও কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করে ব্যবসা বাড়তে থাকে।
ব্যবসাটি দ্রুত সফলতা পেতে থাকে। ২০২২ সালে ‘প্রিমিয়াম ফ্রুটস লিমিটেড’ নামে প্রতিষ্ঠানটি আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত হয়। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন পপি এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন সাগর।
পপি বলেন, আমরা সরাসরি কৃষক ও বাগান মালিকদের সঙ্গে কাজ করি। এক বছর আগে থেকে বাগান লিজ নিয়ে ফলের প্রতিটি পর্যায় তদারকি করি, যাতে ক্ষতিকর কেমিক্যাল ছাড়াই ভালো ফল পাওয়া যায়।
প্রিমিয়াম ফ্রুটস লিমিটেড রংপুর, রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সাতক্ষীরা থেকে আমসহ নানা ফল সংগ্রহ করে সারাদেশে সরবরাহ করে থাকে। এর বাইরে তারা খাগড়াছড়ির পেঁপে, বান্দরবানের বনকলা ও রাঙামাটির লেবুও সরবরাহ করে।
২০২২ সালে তিস্তার চরাঞ্চলে কুমড়ো চাষিদের নিয়ে প্রথম ভিডিও কন্টেন্ট বানান পপি। এরপর নিমপাতা দিয়ে জৈব কীটনাশক তৈরির ভিডিওসহ তার নানা কনটেন্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামাঞ্চল, যুবসমাজ ও কৃষিখাতে যুক্ত হতে আগ্রহী নারীদের কাছে তার সহজ, বাস্তবমুখী ভিডিওগুলো হয়ে উঠে দারুণ জনপ্রিয়।
এখন তারা নিরাপদ সবজি, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও কৃষিভিত্তিক পর্যটন নিয়ে কাজ করছেন। রংপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে তাদের ফলের বাগান, মাছ চাষের জন্য পুকুর ও গাভীর খামার প্রকল্প রয়েছে। সেখানে দর্শনার্থীরা ফল, সবজি, মাছ, গরুর দুধ উপভোগসহ গ্রামীণ জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবেন।
উম্মে কুলসুম পপি বলেন, আমরা চাই মানুষ যেন শুধু ভোক্তা নয়, কৃষি কাজেও অংশ নেয়। তবেই কৃষি নিয়ে সচেতনতা ও ভালোবাসা তৈরি হবে।
উদ্ভাবন, দৃঢ়তা ও গ্রামীণ উন্নয়নের প্রতি অটল প্রতিশ্রুতি নিয়ে উম্মে কুলসুম পপি প্রমাণ করছেন, একুশ শতকের কৃষক মানে কেবল জমি নয়, প্রযুক্তিও জড়িত। এই কৃষি হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই এবং সমাজের শেকড়ে গভীরভাবে প্রোথিত।