শিরোনাম
রোস্তম আলী মন্ডল
দিনাজপুর, ১৫ আগস্ট ২০২৫ (বাসস): ২০২১ সালের ৮ জুন আম পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে মারাত্মক আহত হন দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার যুবক রাজিউল ইসলাম (৩২)। সে সময় প্রাণে বেঁচে গেলেও কোমরের নিচের অংশ চিরতরে অচল হয়ে যায়। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছেন আর কখনো তিনি হাঁটতে পারবেন না। কিন্তু রাজিউল শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেলেও পরিস্থিতির কাছে হার মানেননি।
বৃদ্ধ বাবা-মা ও সংসারের দায়িত্ব তার মনোবলকে আরও শক্তিশালী করেছে। কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে ডিজিটাল সেবা দিয়ে নিজের ভাগ্যের চাকা পরিবর্তন করে স্বাবলম্বী হয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন রাজিউল।
বৃহস্পতিবার কথা হয় উপজেলার গোলাপগঞ্জ গ্রামের রিয়াজ উদ্দিনের ছেলে রাজিউল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, এক বছরের চিকিৎসা শেষে নতুনভাবে কিছু একটা শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। হুইল চেয়ারে বসেই শিখেছেন কম্পিউটার বিভিন্ন ধরনের কাজ। এরপর ২০২২ সালে উপজেলা পরিষদ গেট সংলগ্ন প্রতিষ্ঠা করেন ডিজিটাল কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
উপজেলা পরিষদ ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা হিসেবে চলে তার নিজস্ব কম্পিউটার সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমের ব্যবসা। তিনি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কম্পোজসহ ডিজিটাল সেবা গ্রাহকদের চাহিদা মতো দক্ষতার সঙ্গে দেন। এ কাজে ব্যাপক সুনামও অর্জন করেছেন এরই মধ্যে।
এছাড়া কম্পিউটার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার সার্ভিসসহ কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেন নিজ হাতে।
রাজিউল বলেন, দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় সুস্থ থাকাকালীন সংসারের হাল ধরতে বাবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রোজগারের পথে অগ্রসর হয়েছিলাম। এইচএসসি পাসের পর স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ২০১৪ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পে টেকনিশিয়ান হিসেবে যোগ দেই নবাবগঞ্জ উপজেলা পরিষদে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও জীবিকার চাকা থামে থাকেনি, শুরু হয়েছিল নতুন কর্মসংস্থানের সন্ধান।
এর মধ্যে দুর্ঘটনায় দুই পা একেবারেই অকেজো হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। কিন্তু নিজেকে অসহায় মনে করিনি। কম্পিউটার নিয়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পাশাপাশি সার্ভিস সেন্টার ও গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী ডিজিটাল সেবা দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছি।
রাজিউলের ডিজিটাল সেবা কেন্দ্রে এখন ৪/৫ জন কর্মচারী কাজ করেন। তার সাফল্য দেখে অনেক প্রতিবন্ধী ও শিক্ষিত বেকার যুবক পাচ্ছেন অনুপ্রেরণা ও সাহস।
রাজিউলের প্রতিষ্ঠানের কর্মী আজিজুল হক বলেন, আমরা সুস্থ মানুষ হয়েও অনেকে কাজ করি না। অথচ রাজিউল ভাই পঙ্গু হয়েও আমাদের মতো ৫ জনকে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছেন। তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।
শফিউল আলম বলেন, প্রতিবন্ধী হওয়ায় কোথাও কাজ পাওয়া সম্ভব হয়নি। রাজিউল ভাইয়ের সাফল্য আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। এখন আমি তার প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি।
শিক্ষার্থী উর্মিলা রায় বলেন, প্রতিবন্ধী হয়েও তিনি নিজেই আমাদের কম্পিউটারে ডিজিটাল বিভিন্ন ধরনের কাজ শিখাছেন। তার আন্তরিকতা ও পরিশ্রমে আমি মুগ্ধ। এমন একজন মানুষের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিতে পেরে গর্বিত মনে করছি।
রাজিউল ইসলাম বলেন, আমার মতো অনেক প্রতিবন্ধী আছে যারা অবহেলিত। তাদের পাশে দাঁড়ানোর মানুষ খুব কম। তাই আমার লক্ষ্য প্রতিবন্ধীদের অধিকার, সম্মান ও কর্মে অনুপ্রেরণা দিয়ে যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা। আমি বিশ্বাস করি, প্রতিবন্ধকতা কোনো বাধা নয়। এর জন্য প্রয়োজন মনের বল।
নবাবগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা শুভ্র প্রকাশ চক্রবর্তী বলেন, দুর্ঘটনায় কোমরের নিচের অংশ অচল হলেও রাজিউল থামে থাকেননি। দৃঢ় মনোবল ও পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি আজ সফল উদ্যোক্তা। তাকে এখন অনেকেই অনুপ্রেরণা হিসেবে নিচ্ছেন। সমাজসেবা অফিস থেকে তাকে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দেওয়া হয়েছে যা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।