শিরোনাম
॥ আল-আমিন শাহরিয়ার ॥
ভোলা, ২২ জুন, ২০২৫ (বাসস) : উপকুলীয় জেলা ভোলায় দুগ্ধ শিল্পে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। দেশে প্রথমবারের মতো নৌযানে কুলিং ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে দুর্গম চরাঞ্চল থেকে দুধ সংগ্রহ শুরু হয়েছে। যা এ অঞ্চলের খামারিদের দীর্ঘদিনের লোকসান ও হতাশার বৃত্ত ভাঙার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। ফলে খামারিরা এখন খুশি, কারণ দুগ্ধ পরিবহন এখন সহজ ও নিরাপদ।
সরকারের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)-এর আর্থিক ও কৌশলগত সহযোগিতায় ‘রুরাল মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্ট (আরএমটিপি)’র আওতাধীন ভোলার সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থা এই যুগান্তকারী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে।
তথ্যমতে,দীর্ঘযুগ যাবৎ জেলার বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের খামারিদের জন্য উৎপাদিত দুধ বাজারজাতকরণ একটি বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল। দীর্ঘ উত্তাল নদীপথ, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং সময়সাপেক্ষ পরিবহন ব্যবস্থার কারণে, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে, দুধ নষ্ট হয়ে যাওয়া ছিল নিয়মিত সমস্যা।
জেলা সদরের মাঝের চরের দুধ বিক্রেতা মো. নিজাম বলেন, ‘আগে দুধ শহরে আনতে দিনের অর্ধেক সময় চলে যেত। গ্রীষ্মে অনেক দুধ নদী পথেই ফেটে যেত বা ছড়া হতো, লোকসান ছাড়া উপায় ছিল না।’ একই এলাকার খামারি মো. শরিফ বলেন, “ন্যায্য দাম তো দূরের কথা, দুধ ঠিকঠাক বিক্রি করতে পারলেই বাঁচতাম। এখন কুলিং ট্যাঙ্কারের কারণে আমরা চিন্তামুক্ত। দুধ পরিবহন নিয়ে আর কোনো ভাবনা বা ঝামেলা হবেনা। কারণ এখন থেকে চরাঞ্চল হতে গরু-মহিষের দুধ জেলায় আনতে কুলিং ট্যাঙ্কার সম্বলিত নৌযান এই সমস্যার একটি কার্যকর সমাধান।
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত এবং স্বাস্থ্যসম্মত স্টেইনলেস স্টিল ও শোলার দ্বারা বিশেষভাবে তৈরি প্রতিটি ট্যাঙ্কার একসঙ্গে ৭০০ লিটার দুধ বহন করতে পারে এবং গুণগত মান অক্ষুণ্ন রেখে প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রে পৌঁছে দেয়। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গ্রামীন জন উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোক্তা অলিউর রহমান বাসস'কে জানান,কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের আওতায় বর্তমানে জেলা সদরের ৪-৫টি চর থেকে প্রায় শতাধিক খামারির কাছ থেকে নিয়মিত দুধ সংগ্রহ করছেন,যা এই উদ্যোগের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে। এধরণের সিষ্টেম জেলার প্রতিটি গবাদিপশু সমৃদ্ধ চরাঞ্চলের খামারীদের জন্য চালুর উদ্যোগ সরকারের প্রকল্পে রয়েছ। পিকেএসএফ দেশের সব প্রান্তের বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলে এধরণের উদ্যোগ নেবেন বলেও জানান তিনি।
সরকারের সহযোগী এই সংস্থার উপ-পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান জানান, ‘আমাদের লক্ষ্য শুধু দুধ সংগ্রহ নয়, বরং খামারিদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করে তাদের জীবনমানে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা। এই নৌ-ট্যাঙ্কার চরাঞ্চলের ভঙ্গুর সরবরাহ শৃঙ্খলকে একটি শক্তিশালী ও আধুনিক কাঠামো এনে দেবে।’
এদিকে এই পরিবর্তনের প্রভাব জেলার স্থানীয় বাজারেও পড়েছে। শহরের দুধ ব্যবসায়ী মো. অলিউর রহমান বলেন, ‘আগে চরের দুধের মান নিয়ে সংশয় ছিল। এখন খামার থেকে সরাসরি ঠান্ডা ও বিশুদ্ধ দুধ পাচ্ছি, যা আমাদের ব্যবসার ঝুঁকি কমিয়েছে এবং ভোক্তাদের আস্থা বাড়িয়েছে।’
অপর খামারী ও দধি উদ্যোক্তা আব্দুল হাই জানান,ভোলার দধিকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃিত দেয়ার পর আমরা মহিষের দুধের মান নিয়ে শঙ্কিত থাকতাম। মানসম্পন্ন দুধের অভাবে পূষ্টি সম্পন্ন দধি তৈরী করা যেতনা। কুলিং ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে এখন থেকে দুধ পরিবহন সিষ্টেম চালু হওয়ায় আমাদের এখন দধির পূষ্টি নিশ্চিত করতে আর সমস্যা হবেনা।
জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. রফিকুল ইসলাম খান বলেন,এই উদ্যোগটি জেলার ডেইরি শিল্পের জন্য একটি মাইলফলক হিসেবে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলো।। তিনি বলেন,‘এটি খামারিদের দুধ উৎপাদনে উৎসাহিত করার পাশাপাশি জেলায় নিরাপদ ও মানসম্মত দুধের সরবরাহ বৃদ্ধিতে সরাসরি ভূমিকা রাখবে। সরকারের প্রাণীসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যের সঙ্গে এই উদ্যোগ অত্যন্ত সঙ্গতিপূর্ণ বলেও মনে করেন এ কর্মকর্তা।