বাসস
  ২৫ মে ২০২৫, ১৪:২৯

আইলার ১৬ বছরেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি সাতক্ষীরা উপকূলের হাজারো পরিবার

ছবি : বাসস

আসাদুজ্জামান

সাতক্ষীরা, ২৫ মে ২০২৫(বাসস) : আজ ভয়াল ২৫ মে। ২০০৯ সালের এই দিনে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘুর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট সর্বনাশা ‘আইলা’ আঘাত হানে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জনপদে। মুহূর্তের মধ্যে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি ও খুলনা জেলার কয়রা ও দাকোপ উপজেলার উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে  ১৪-১৫ ফুট উচ্চতায় সমুদ্রের পানি এসে নিমিষেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় নারী ও শিশুসহ কয়েক হাজার মানুষ, হাজার হাজার গবাদি পশু আর ঘরবাড়ি।

ক্ষণিকের মধ্যে গৃহহীন হয়ে পড়ে কয়েক লাখ পরিবার। লক্ষ লক্ষ হেক্টর চিংড়ি আর ফসলের ক্ষেত তলিয়ে যায়। ধ্বংস হয়ে যায় উপকূল রক্ষা বাধ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় উপাসনালয়।

এদিকে সর্বগ্রাসী আইলার ১৬ বছর পেরিয়ে গেলেও আইলা কবলিত হাজার হাজার পরিবার এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কাজ করলেও উপকূলীয় জনপদে এখনও চলছে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও খাবার পানির জন্য তীব্র হাহাকার। সর্বগ্রাসী আইলা আজ ও উপকূলীয় অঞ্চল সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত হাজার, হাজার মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এলাকার বেশ কয়েকটি পয়েন্টে এখনো ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে বেড়িবাধ। তবে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে ৩৫ কিলোমিটার বেড়িবাধকে স্থায়ী বাধে রুপান্তর করা হয়েছে।

শ্যামনগর উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সর্বনাশা আইলার আঘাতে শুধু সাতক্ষীরায়ই নিহত হয় ৭৩ জন নারী, পুরুষ ও শিশু। আর আহত হয় দুই শতাধিক মানুষ। এছাড়া তাৎক্ষণিকভাবে এসব এলাকার ৫ লাখ ৯৫ হাজার ১২২ জন মানুষ নিরাশ্রয় হয়ে পড়ে। শুধু শ্যামনগরেই গৃহহীন হয় ২ লাখ ৪৩ হাজার ২৯৩ জন।

এছাড়া শ্যামনগরের ৯৬ হাজার ৯১৬টিসহ মোট ১লাখ ৪২হাজার ২৪৪টি বসতঘর বিধ্বস্ত হয়। উপজেলার ৪৮ হাজার ৪৬০ পরিবারসহ মোট ১ লাখ ১৪ হাজার পরিবার আইলার আঘাতে সরাসরি ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আইলার ধ্বংসযজ্ঞে ৩৯৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ তিন শতাধিক মসজিদ, মন্দির সম্পূর্ণ ও আংশিকভাবে ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি ১৭৯কিলোমিটার রাস্তা সম্পূর্ণ ও ৯৯কিলোমিটার আংশিক নষ্ট হয়ে যায়। ৪১টি ব্রিজ ও কালভার্টসহ ১১৭কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ নদীতে বিলীন হয়ে যায়। শুধু শ্যামনগরেই ১২৭ কিলোমিটার উপকূল রক্ষা বাঁধের ৯৭ কিলোমিটার সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সহস্রাধিক নলকূপ ও দুই হাজারেরও বেশি পুকুর জলাশয় জলমগ্ন হয়ে পড়ায় দুর্দশাগ্রস্ত লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। 

শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পদ্মপুকুর ও আশশুনির প্রতাপনগর এলাকায় মানুষের হাহাকার ১৬ বছরে এতটুকু থামেনি। দু-মুঠো ভাতের জন্য জীবনের সাথে রীতিমতো লড়াই করতে হচ্ছে তাদের। আইলার পর থেকে এসব এলাকায় সুপেয় পানি সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। খাবার পানির জন্য ছুটতে হচ্ছে মাইলের পর মাইল। আইলা কবলিত এ অঞ্চলের রাস্তাঘাট, উপকূলীয় বেড়িবাঁধএখনও ঠিকমতো সংস্কার হয়নি। ২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে আবারও লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় উপকূলীয় জনপদ। এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা। এর ফলে যে কোনো ধরনের  ঘূর্ণিঝড়-এর সতর্কবার্তা শুনলেই উপকূলীয় এলাকার লক্ষ লক্ষ মানুষ জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ ভাঙনের আতঙ্কে দিন কাটান। 

অথচ আইলার আগে সবুজ বনানীতে পরিপূর্ণ ছিল সাতক্ষীরা শ্যামনগর ও আশাশুনির উপকূলীয় অঞ্চল। শাকসবজি ও ধান-পাটসহ অন্যান্য ফসলে ভরে উঠত পুরো এলাকা।

কিন্তু আইলার পানিতে লবণাক্ততায় বিষাক্ত হয়ে উঠেছে মাটি। চারিদিকে গাছপালাহীন ঘের আর ঘের। সবুজের বালাই নেই। নেই পরিবেশগত ভারসাম্য।

এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণসহ সুপেয় পানি ও এলাকার রাস্তাঘাট সংস্কারে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী। 

উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা মাসুদুল আলম জানান, প্রলয়ংকারী আইলার ১৬ বছর পেরিয়ে গেলেও এই এলাকার মানুষ এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেননি। আজও সেখানকার মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের অভাব রয়েছে। একই সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থাও নাজুক। পানি উন্নয়ন বোর্ডের  বেড়িবাধে তার ইউনিয়নের কয়েকটি পয়েন্টে সংস্কার করা হলেও দুই তিনটি জায়গায় এখনো রয়েছে ভয়াবহ ফাটল। নদীতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেলে বেঁড়িবাধ ভাঙন আতঙ্কে দিন পার করতে হচ্ছে গোটা ইউনিয়নবাসীর।

পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাহউদ্দীন বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে প্রতি বছর সাতক্ষীরার উপকূলীয় জনপদ ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই সরকার ঘূর্ণিঝড় আইলা থেকে শিক্ষা নিয়ে টেকসই বেড়িবাঁধ ও নদী সংরক্ষণ কাজে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। ষাটের দশকে নির্মিত জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ নীচু হয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি আরও জানান, সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ মেরামত অব্যাহত রেখেছে। ইতোমধ্যে ৩৫কিলোমিটার বাঁধকে স্থায়ী বাঁধে রুপান্তর করা হচ্ছে। বাকি বাঁধগুলোকে পর্যায়ক্রমে স্থায়ী বাঁধে রুপান্তর করা হবে।