শিরোনাম
।। মো. আব্দুল কাইয়ুম।।
ময়মনসিংহ, ৩ আগস্ট ২০২৫ (বাসস) : গত বছরের ৩ আগস্ট দুপুর গড়িয়ে যখন রাজপথে উত্তাপ ছড়াচ্ছিল, তখন ময়মনসিংহ শহর যেন রূপ নিয়েছিল এক উত্তাল প্রতিরোধের অঙ্গনে। কোটা সংস্কার আন্দোলন, বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্রদের জাগরণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনরোষ-সবকিছু মিলে গড়ে উঠেছিল এক বহুমাত্রিক গণআন্দোলন।
তবে এই দিনটি শুধুই ছাত্রদের বিক্ষোভ নয়; এ দিনটি পরিণত হয়েছিল বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লাখো মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদের দিনে।
সকাল থেকেই শহরের বাতাসে অস্বাভাবিক চাপা উত্তেজনা ছিল। সকাল ১০টায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ গেটে শিক্ষার্থীরা হাতে হাতে ফেস্টুন নিয়ে দাঁড়ায়, তখন তাদের কণ্ঠে স্লোগান আর চোখে গভীর শোকের ছায়া ছিল। তাঁরা এসেছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে শহীদ হওয়া ডা. সজিবের হত্যাকারীদের বিচার ও ছাত্র সমাজের ৯ দফা দাবি নিয়ে। বিদ্রোহী কবিতা ও গণসঙ্গীতের মধ্য দিয়ে তাঁরা প্রতিবাদের সুরে বলেছিলেন, “আর রক্ত নয়, আর সহ্য নয়। বিচার চাই, সংলাপ চাই, গণতন্ত্র চাই।” মেডিকেলের শিক্ষার্থী ময়ূরাক্ষীর কান্নাভেজা কণ্ঠে ভেসে এসেছিল হৃদয়বিদারক আহ্বান-“আমার ভাইয়ের রক্ত দেখে আর ঘুমানো যায় না, দয়া করে আর রক্ত ঝরাবেন না।”
অন্যদিকে, শহরের কেন্দ্রস্থলে টাউন হল মোড়ে বেলা ১১টা থেকেই জড়ো হতে থাকেন বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এবার তারা একা ছিল না। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মী, নাট্যজন, শ্রমিক নেতা, অভিভাবক, চিকিৎসক, সাংবাদিক ও বেসরকারি শিক্ষকসহ সর্বস্তরের মানুষ। এই অভাবনীয় সংহতি মিছিলটি একটি নিছক ছাত্র বিক্ষোভ থেকে রূপ নেয় গণআন্দোলনে। নগরীর টাউন হল মোড় থেকে শুরু হয়ে গাঙ্গিনাপাড়, দুর্গাবাড়ি, কাছারি সড়ক ও নতুন বাজার ঘুরে আবারও টাউন হল মোড়ে ফিরে আসে এই বিশাল বিক্ষোভ মিছিল। সব পথেই ছিল মানুষের ঢল, আর স্লোগানে স্লোগানে কেঁপে উঠেছিল শহরের দেয়াল।
বিক্ষোভ মিছিলের আগে আয়োজিত সমাবেশে আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র আশিকুর রহমান, আরিফুল হক ও আব্দুল্লাহ আল নাকিব ঘোষণা দেন-দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে এবং যে সরকার ছাত্রদের ওপর গুলি চালায়, তার ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার নেই। তারা বলেন, “এই আন্দোলন এখন ছাত্রদের সীমা ছাড়িয়ে জনগণের আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। আমাদের পেছনে দেশের বিবেকবানরা দাঁড়িয়ে আছেন।”
সেদিন শহরের অলিগলি যেন থমকে দাঁড়িয়েছিল আন্দোলনের গর্জনে। যানবাহন চলাচল একপ্রকার বন্ধ ছিল। বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ, সীমিতভাবে খোলা ছিল কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এই দিনেই সকালে নগরীর চরপাড়া মোড়ে কওমি আলেম সমাজ ও তৌহিদি জনতা আয়োজিত মানববন্ধনে মাদ্রাসা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ঢল নেমেছিল। গুলি করে ছাত্রদের হত্যার প্রতিবাদে তাঁরা উচ্চারণ করেন আগুনঝরা ভাষণ।
খানকায়ে হুসাইয়িনা মাদানির মুহতামিম মুফতি মাহবুবুল্লাহ কাসেমি বলেছিলেন, “এই দেশে যারা নিরপরাধ ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করেছে, তারা দেশের শত্রু। তাদের জানাজা, দাফন, কাফন-সবকিছুই বর্জন করা হবে।” এই মানববন্ধনে আন্দোলনকারীদের মুক্তি, গণহত্যার বিচার এবং আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে ৫ দফা প্রস্তাব তোলা হয়।
জুলাই রেভ্যুলেশনারী অ্যালায়েন্স ময়মনসিংহ জেলার আহ্বায়ক আল নূর মোহাম্মদ আয়াশ বলেন, ৩ আগস্টের এই দিনটি ছাত্রদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে উঠে এসেছিল একটি আদর্শিক লড়াইয়ের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে। এটি কেবল একটি শহরের নয়, একটি প্রজন্মের প্রতিরোধের দলিল হয়ে থাকবে। মানবতা ও ন্যায়ের পক্ষের এক ঐতিহাসিক উচ্চারণ ছিল সেদিনের আন্দোলন। কোনো রাজনৈতিক ব্যানার ছাড়াই এক বিশাল জনতার রাস্তায় নেমে আসা ছিল এ দেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। সেই দিন রাষ্ট্রের সমস্ত অবদমন, হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে শহরটি হয়েছিলো এক অঘোষিত গণজাগরণের রাজধানী।