শিরোনাম
।। মুহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ ।।
গাজীপুর, ২৬ জুলাই ২০২৫ (বাসস) : ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ২৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে গাজীপুরের সর্বত্র থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিলো। ঢাকা, গাজীপুর, নরসিংদি ও নারায়নগঞ্জসহ চার জেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ চলছিলো। শ্রমিকরা আন্দোলনে যোগ দিতে পারে এই আশংকায় পোশাক কারখানাগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
২৬ জুলাই শুক্রবার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা গাজীপুরে কারফিউ ভেঙ্গে বিক্ষোভ মিছিল ও মহাসড়ক অবরোধ করে। জেলা সদর ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে থাকলেও শিক্ষার্থীরা মহানগরীর টঙ্গী কলেজ গেট, গাজীপুরা, বড়বাড়ি, চান্দনা চৌরাস্তা ও শিববাড়ি মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। এসময় দফায় দফায় পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া এবং টিয়ার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
এদিকে আন্দোলন দমানোর লক্ষ্যে গাজীপুর মেট্রোপলিটনের আটটি থানায় ২৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছিলো। এসব মামলায় প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে আসামি করা হয়।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের তৎকালীন কমিশনার মাহবুব আলম সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ২৬ জুলাই সকালে মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে পুলিশ ৩১৮ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের অধিকাংশ ছিলো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসা ছাত্রসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সমর্থক।
টঙ্গীর তামীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার ছাত্র রায়হান (২৩) কোটা সংস্কার আন্দোলনে ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সক্রিয় ছিল বলে জানান। উত্তরা ও টঙ্গীতে দুইবার তিনি পুলিশের ছররা গুলিতে আহত হন।
রায়হান বাসসকে বলেন, জুলাইয়ের প্রথম থেকে বিছিন্নভাবে কয়েকটি স্থানে ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল করলেও গাজীপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের উত্তাপ ছড়ায় ১৮ জুলাই থেকে। তবে সেই আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয় ১৯ জুলাই শুক্রবার দুপুরের পর। ওইদিন টঙ্গী সরকারি কলেজ ও তামীরুল মিল্লাত মাদ্রাসার ছাত্ররা উত্তরার বিএনএস সেন্টার, আজমপুর ও রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্সের সামনে আন্দোলনে যোগ দেয়। কোটা সংস্কারের দাবীতে ও সারাদেশে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে উত্তরার বিভিন্ন পয়েন্টে ছাত্ররা বিক্ষোভ করে।
দুপুরের পর যুব লীগ ও ছাত্রলীগের লাঠিয়াল বাহিনী সঙ্গে নিয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম উত্তরায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালান । এসময় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তিনি উত্তরার হাউস বিল্ডিং এলাকায় মুখোমুখী হয়ে সরাসরি গুলি করার নির্দেশ দেন। এসময় জাহাঙ্গীরের বডিগার্ড ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ৫ রাউন্ড গুলি চালায়। এতে ৩ জন শিক্ষার্থী ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এ সময় আন্দোলনকারীরা তাকে বেদম লাঠিপেটা করে।
গণপিটুনিতে আহত হয়ে জাহাঙ্গীর আলম তার বডিগার্ডসহ ৭ নং সেক্টরের একটি বাসায় আশ্রয় নিলে ছাত্ররা সেখানে গিয়ে হামলা চালায়। সেখানে আন্দোলনকারীদের গণপিটুনিতে জাহাঙ্গীরের বডিগার্ড জুয়েল ঘটনাস্থলে নিহত হন। পরে পুলিশ জাহাঙ্গীরকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
১৯ জুলাই উত্তরায় ছাত্র হত্যার জের ধরে ২০ জুলাই শনিবার সমগ্র গাজীপুরে আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। গাজীপুর সদর থানাধীন শিববাড়ী, কেয়ামত সড়ক, বাসন থানাধীন ভোগরা, চান্দনা চৌরাস্তা, তেলিপাড়া, গাছা থানাধীন কুনিয়া, বোর্ড বাজার, বড়বাড়ী, কোনাবাড়ী থানাধীন কোনাবাড়ী বাসস্ট্যান্ড, ফ্লাইওভারের পূর্ব ও পশ্চিম পাড় এলাকায় পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এইদিন ছাত্রদের পাশাপাশি বিক্ষুব্ধ পোশাক শ্রমিক ও সাধারণ মানুষও মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। এসময় বেশ কিছু যানবাহন ও কারখানায় হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সকাল থেকে টঙ্গী পশ্চিম থানা রোড (খাঁ-পাড়া) গাজীপুরা, সাতাইস, আউচপাড়া এলাকা পুলিশ ও ছাত্র-জনতার মধ্যে দফায় দফায় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও পুলিশের গুলি বর্ষণে গোটা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিলো। পুলিশের গুলিতে খাঁ-পাড়া রোডের মাথায় ওসমান পাটোয়ারী ও গাজীপুরা দারুল ইসলাম ট্রাস্টের গেটে নাসির ইসলাম সহ দুইজন শাহাদাত বরণ করেন। একইদিন পূর্ব থানার রেল স্টেশন, আরিচপুর ও সেটশন রোড এলাকায়ও দফায় দফায় পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ২০ জুলাই এইসব এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হেলিকপ্টার থেকে নির্বিচারে গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করা হয়।
১৮ জুলাই থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত ঘটনায় ২৮টি মামলায় অন্তত: ১৫ হাজার লোককে আসামী করে মামলা করা হয়। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রতিদিন আসামি গ্রেপ্তার করা হচ্ছিলো। গ্রেপ্তার এড়াতে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) ও টঙ্গীর তামীরুল মিল্লাত মাদ্রাসার আবাসিক ছাত্ররা হল ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। এছাড়া বিএনপি, জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও রাতে নিজ বাসাবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান।