বাসস
  ২৬ জুলাই ২০২৫, ২১:৩৪
আপডেট : ২৬ জুলাই ২০২৫, ২২:০৫

জুলাই স্মরণ : আন্দোলন প্রত্যাহারে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ

১৪ জুলাই বক্তব্য দেন জুলাইযোদ্ধা বেরোবি শিক্ষার্থী শাহরিয়ার সোহাগ। পাশে আবু সাঈদ। তার দুদিন পর শহীদ হন তিনি। ছবি : মো. রজব আলী

প্রতিবেদন :  মো. মামুন ইসলাম

রংপুর, ২৬ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : চব্বিশের ২৭ জুলাই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে রংপুরে কারফিউ ও গণগ্রেফতার অব্যাহত রাখে এবং আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিতে ছাত্র সমন্বয়কদের ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করে।

এর আগে ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি)’র ছাত্র আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর থেকে শিক্ষক, অভিভাবক, নারী ও সাংস্কৃতিক কর্মীসহ হাজার হাজার মানুষ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদী শাসনের শেষ ঘণ্টা বাজাতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দেন।

এদিকে বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসন, রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ছাত্র সমন্বয়কদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলে ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য দেখাতে থাকেন।

এমন পরিস্থিতিতে, তৎকালীন ফ্যাসিবাদী সরকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে দমন করার জন্য গণগ্রেফতার অব্যাহত রাখে। একই সঙ্গে গত বছর ২৭ জুলাই কারফিউয়ের অষ্টম দিনে রংপুর বিভাগে ১৫ ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়।

তৎকালীন রংপুর বিভাগীয় কমিশনার মো. জাকির হোসেন চব্বিশের ২৬ জুলাই (শুক্রবার) রাতে সাংবাদিকদের জানান, ২৭ জুলাই (শনিবার) সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত রংপুর বিভাগের আটটি জেলাতেই কারফিউ শিথিল থাকবে।

তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ২৭ জুলাই পঞ্চগড়, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও রংপুর এই আট জেলায় সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা অর্থাৎ ১৫ ঘণ্টা কারফিউ শিথিল থাকবে।

তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ‘অন্যান্য দিনের মতো শনিবার (২৭ জুলাই) বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব ও আনসার সদস্যরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে মাঠে থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন।’

তিনি জনগণ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে শিথিলতার সময়টুকু ছাড়া সকলকে ঘরে থাকার অনুরোধ জানান।

অপরদিকে তৎকালীন রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান ২৭ জুলাই স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, সেনাবাহিনী ছাড়াও বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব ও আনসার সদস্যরা জেলাজুড়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছেন।

তিনি দাবি করেন, ‘যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে পুরো জেলায় যৌথ বাহিনীর টহল জোরদার করা হয়েছে। রংপুর মহানগরীর অনেক মানুষ প্রয়োজনীয় কাজের জন্য ঘর থেকে বের হয়েছেন।’

তৎকালীন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান ওই দিন অভিযোগ করেন, ১৬, ১৮ এবং ১৯ জুলাই রংপুর শহরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অনুপ্রবেশকারী দুষ্কৃতকারীরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা ও বাণিজ্যিক ভবনে সহিংসতা চালায়।

তিনি অভিযোগ করেন, ‘এই তিন দিনে দুষ্কৃতকারীরা তাজহাট থানা, ডিবি কার্যালয়, নবাবগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ি ও পুলিশ বক্স, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের কার্যালয়, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ, পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় এবং মুক্তিযোদ্ধা ভবন পুড়িয়ে দিয়েছে।’

তিনি আরও অভিযোগ করেন, ‘তারা র‌্যাব-বিজিবি ও পুলিশের গাড়ি, ট্রাক, মোটরসাইকেলসহ অটোরিকশা পুড়িয়ে দিয়েছে এবং তাজহাট থানা থেকে মোটরসাইকেল, রিকশা, কম্পিউটার, মামলার আলামত এবং ফোর্সের ট্রাংকসহ সবকিছু লুট করেছে।’

এই সময়ে দুষ্কৃতকারীরা রংপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান গেট, সিসিটিভি ক্যামেরা, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি ভাস্কর্য, সোনালী ব্যাংক, জেলা পরিষদ কমিউনিটি মার্কেট, সেইসাথে ট্র্যাফিক পুলিশের বিভিন্ন সড়ক বিভাজক এবং শহরের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ফাঁড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট করে বলে অভিযোগ করা হয়।

তিনি আরও অভিযোগ করেন, দুষ্কৃতকারীরা কারাগার, জেলা পুলিশ লাইন্স, ট্র্যাফিক অফিস, সার্কিট হাউস এবং ডিসি-এসপি’র বাংলোতে হামলা করার চেষ্টা করে।

তিনি অভিযোগ করেন, ‘এছাড়াও সোনালী ব্যাংক বুথ এবং ‘অর্জন’ ভাস্কর্যসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর ও লুটপাটের চেষ্টা করা হয়।’

তিনি জানান, ২৬ জুলাই সকাল পর্যন্ত এসব ঘটনায় ১২টি মামলায় ১৭৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অর্থদাতা ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে এবং অনেক অপরাধীকে শনাক্ত করা হয়েছে।

এদিকে, শহীদ আবু সাঈদের হত্যার ঘটনা থেকে দৃষ্টি সরাতে প্রশাসন ২৭ জুলাই আবু সাঈদের পরিবারের সদস্যদের পরদিন ফ্যাসিবাদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ করানোর জন্য ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে নিয়ে যায়।

বেরোবি’র তৎকালীন প্রক্টর শরীফুল ইসলাম ২৭ জুলাই (শনিবার) সাংবাদিকদের বলেন, ‘আবু সাঈদের বাবা মো. মকবুল হোসেন, মা মনোয়ারা বেগম, ভাই আবু হোসেন, বোন সুমি আক্তার এবং ভাবী সাবিনা আক্তার বর্তমানে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে রয়েছেন।’

তিনি জানান, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কেবল আবু সাঈদের পরিবারের সঙ্গেই নয়, ২৮ জুলাই (রোববার) গণভবনে কোটা আন্দোলনে নিহত সকলের পরিবারের সাথে দেখা করার কথা রয়েছে।

আবু সাঈদের চাচাতো ভাই রুহুল আমিন জানান, ২৬ জুলাই জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান এবং জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা সাঈদের বাড়িতে এসে তার বাবা-মাকে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় যেতে বলেন।

তিনি বলেন, ‘২৭ জুলাই (শনিবার) সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে আবু সাঈদের পরিবারের সদস্যরা পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে অবস্থিত তাদের বাড়ি থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন।’

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শীর্ষস্থানীয় ছাত্র সমন্বয়ক এবং শহীদ আবু সাঈদের সহযোদ্ধা শামসুর রহমান সুমন বাসসকে জানান, সে সময়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য তাদের ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করেছিল।

সেই সময় ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করা প্রায় অসম্ভব ছিল। তখন গোয়েন্দা সদস্যরা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা ছাত্র সমন্বয়কদের পেছনে লেগেছিল।

ফ্যাসিবাদী সরকার, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা রংপুর শহরে বিপ্লবী শিক্ষার্থীদের গণগ্রেফতার ও গুমের হুমকি দিয়ে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল।

সুমন আরো বলেন, ‘জনসমক্ষে আন্দোলন প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে গ্রেফতারের হুমকি এড়াতে এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আমাদের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছিল।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা কোনো পরিস্থিতিতেই কোনো চাপের কাছে মাথা নত করিনি এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম যে ফ্যাসিবাদের পতন হবেই হবে।’