শিরোনাম
//ওবাইদুর রহমান//
ঢাকা, ১৪ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারীদের সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বামপন্থী ছাত্রনেত্রী শাহিনুর সুমি। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শাহিনুর সুমি বর্তমানে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ইডেন কলেজ শাখার সভাপতি এবং ঢাকা মহানগরীর দপ্তর সম্পাদক। কুমিল্লার মেঘনা উপজেলায় তার জন্ম হলেও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা করেছেন ঢাকায়। ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজ থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছেন। রাজনীতির বাইরেও শিল্প-সাহিত্যে তার বেশ আগ্রহ রয়েছে। ছায়ানটে নৃত্যও শিখেছেন তিনি ।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা-বাসস’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে তার অংশগ্রহণ, প্রতিবন্ধকতা, আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও অভিজ্ঞতার নানা দিক তুলে ধরেছেন শাহিনুর সুমি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাসসের প্রতিবেদক ওবাইদুর রহমান ।
বাসস: কোটা সংস্কার আন্দোলনে কখন, কীভাবে জড়িত হন? আন্দোলনে অংশ নিতে কোন বিষয়টি আপনাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
শাহিনুর সুমি: আমি প্রথমে কোটা সংস্কার আন্দোলনের খবর পাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তখন থেকেই বিষয়টি নিয়ে আমার মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন সংবাদ সম্মেলন হয়, সেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম। যদিও তখন সরাসরি আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম না। তবে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম এবং বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। আমি মূলত ২ জুলাই থেকে সরাসরি আন্দোলনে যুক্ত হই। সেদিন ইডেন কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে প্রথম মাঠে নামি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারেই এই আন্দোলনের সূচনা হলেও ধীরে ধীরে তা সার্বজনীন রূপ নেয়। ৩ জুলাই আমরা নীলক্ষেত মোড়ে অবস্থান নিই। সেখান থেকেই আন্দোলনের গতি আরও বেগবান হয়। পরে সায়েন্সল্যাব মোড়ে আমরা ইডেন কলেজ ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা একত্রে মিছিল করি। আমাদের মধ্যে সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদের যে শক্তি ও ঐক্য তৈরি হয়, তা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক ছিল।
বাসস: কীভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংগঠিত করেছিলেন?
শাহিনুর সুমি: ঢাবি থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে যে সিদ্ধান্ত বা কর্মসূচি ঘোষণা করা হতো, আমরা সেগুলো পালন করতাম। ৭ জুলাই বাংলা ব্লকেড কর্মসূচিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ব্যাপক সাড়া দেয়। আমরা সেদিন দিনভর সায়েন্সল্যাব মোড়ে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করি। আমাদের স্লোগানগুলো ছিল এমন- ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’। এভাবে বেশ কয়েক দিন বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করা হয়। শিক্ষার্থীরা ন্যায্য দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে আন্দোলনে অংশ নেয়।
বাসস: আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে শেখ হাসিনার কটুক্তির প্রতিবাদে ১৪ জুলাই রাতে ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা গেট ভেঙে হল থেকে বেরিয়ে আসেন। সেই দিনের ঘটনা সম্পর্কে কিছু বলুন।
শাহিনুর সুমি: ১৪ জুলাই বিকেলে কোটা ইস্যুতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘চাকরি মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?’ এই বক্তব্যটি দেশের হাজারো শিক্ষার্থীর মনে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে তখনই একটি প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়ে ‘বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ, আমরা কি সবাই রাজাকারের বংশধর?’ এই প্রশ্ন থেকেই জন্ম নেয় ক্ষোভ, যেটা এক রকম আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষাঙ্গনে। শিক্ষার্থীদের মনে স্পষ্ট হয়, এই মন্তব্য তাদের আত্মপরিচয়, সম্মান ও অধিকারকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। তারা বুঝতে পারে , এখন নীরব থাকা মানে এই অপমান মেনে নেওয়া। ইডেন কলেজের প্রতিটি হলের শিক্ষার্থীরা তখন নিজেদের হলের গ্রুপে আলোচনায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। একাধিক হলে একযোগে আলোচনা হয় এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানাতে হবে। পরে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের বাধা উপেক্ষা করে রাতেই হল থেকে বের হয়ে আসেন। তারা নিজেরাই হলের গেট ভেঙে রাস্তায় নেমে আসেন এবং প্রতিবাদের ঝড় তোলেন। মিছিল, স্লোগান ও প্রতিবাদে রাতের মধ্যেই শিক্ষার্থীরা নীলক্ষেত থেকে আজিমপুর পর্যন্ত মিছিল করে। স্লোগানে স্লোগানে তারা প্রতিবাদ জানায় ‘তুমি কে ? আমি কে? রাজাকার রাজাকার/ কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার স্বৈরাচার’। সেদিন শিক্ষার্থীরা জানিয়ে দেয়, আমরা রাজাকারের নাতি না, আমরা এই দেশের নাগরিক। আমাদের ন্যায্য অধিকার চাই। এটি ছিল একটি স্বতঃস্ফূর্ত, সংগঠিত এবং শক্তিশালী প্রতিবাদ।
বাসস: ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার দিন ইডেনেও হামলা হয়েছিল। সেদিনের ঘটনা জানতে চাই?
শাহিনুর সুমি: ১৫ জুলাই প্রথম হামলাটা হয় মূলত ইডেন কলেজে। সেদিন রাজুতে প্রোগ্রামে যোগ দিতে সকালে ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন থেকেই পরিস্থিতি অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। ক্যাম্পাসের চারপাশে শিক্ষকদের আনাগোনা বাড়ে। তারা বারবার শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘তোমরা কোথায় যাচ্ছো?’, ‘কেন হলে ফিরছো না?’ কলেজ চত্বরে তখন পুলিশ না থাকলেও বাহিরে তাদের অবস্থান ছিল। সকাল ১১টায় কলেজের পুকুরপাড় থেকে বঙ্গমাতা হল পর্যন্ত আমরা একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করি। আমরা শুধু চেয়েছিলাম অন্য শিক্ষার্থীদের জানাতে যে, ‘আজ রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশ আছে, আমাদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সবাই এগিয়ে আসতে হবে।’ আমাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে বাধা দিতে ছাত্রলীগের ইডেন শাখার সভাপতি ও সম্পাদকের নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন নেতা-কর্মী আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। মিছিল শেষ করে শিক্ষার্থীরা আবার পুকুরপাড়ে দাঁড়ালে ছাত্রলীগের ওরা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিতে দিতে আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। তারা পাঁচ-ছয়জন ছাত্রীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মোবাইল ফোন দিয়ে ঘাড়ে, মাথায় ও পিঠে মারতে থাকে। কিল ঘুষি, পেটে লাথিসহ নৃশংসভাবে হামলা করে। শিক্ষকরা পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু তারা থামানোর চেষ্টা করেননি। তারা শুধু আমাদের বলতে থাকেন, ‘তোমরা বের হয়ে যাও, না হলে বড় কিছু হয়ে যাবে।’ কিন্তু তারা কেউ একজনও এগিয়ে এসে হামলাকারীদের থামাননি। পরে আহত, রক্তাক্ত ও ভীত হয়ে ছাত্রীরা বেরিয়ে আসে। তাদের এই অবস্থা জানতে পেরে আজিমপুর ও আশপাশের মেসে থাকা ছাত্ররা ছুটে আসে।
তারপর ২০-২৫ জনের একটা গ্রুপ হয়ে কলেজের প্রথম ও দ্বিতীয় গেট ভেঙে আন্দোলনে যেতে আগ্রহী ছাত্রীদের বের করে আনে। এভাবে ৪০০-৫০০ জন ছাত্রী একত্রিত হয়ে রাজু ভাস্কর্যে যায়। আমি সেই সময় অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমাকে প্রথমে ঢাবির মেডিকেল সেন্টার ও পরে ঢাকা মেডিকেলের ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় ৪৫ মিনিট অজ্ঞান থাকার পর জ্ঞান ফিরলে হাসপাতালে শুনতে পাই ঢাবিতে ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। পরে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে ইমারজেন্সি ওয়ার্ডেও হামলা চালায় তারা। সে সময় ডাক্তার ও নার্সরা বলতে থাকেন, ‘আমরা কখনও এমন জঘন্য ঘটনা দেখিনি।’ হাসপাতালে নিরাপত্তা না থাকায় পরে বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে চানখারপুল-বঙ্গমার্কেট-বঙ্গবাজার হয়ে সেগুনবাগিচায় মেসে ফিরে আসি। সেদিন আমি নারী হয়েও পালাতে হয়েছিল। কারণ হাসপাতাল তখন আর নিরাপদ ছিল না। সেদিন নারীদেরও রেহাই মেলেনি। অনেকে ভাবেন নারী শিক্ষার্থীরা হয়তো একটু ‘কম’ আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা বলছে উল্টো কথা। সেই হামলায় নারীদের মাথা ফেটেছিল, মুখ থেঁতলে গেছে, বুক ও পিঠে লাঠির আঘাত ছিল। সেদিন পুরুষ বা নারী নয়, টার্গেট ছিল ‘প্রতিবাদী শিক্ষার্থী’।
বাসস: আপনি একাধারে আন্দোলনকারী ও একটি ছাত্র সংগঠনের নেত্রী ছিলেন। এটা নিয়ে কোন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন কি না?
শাহিনুর সুমি: আমি একই সাথে আন্দোলনকারী ও ছাত্রফ্রন্ট ইডেন শাখার নেত্রী ছিলাম। সংগঠনের নেত্রী হওয়ায় বহু হয়রানির শিকার হতে হয়েছিল। ছাত্রলীগ এটা নিয়ে সবসময়ই ট্রিট করেছিল। কারণ ছাত্রলীগ জানে, ছাত্রফ্রন্ট যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। পুলিশ আমার এলাকায় খোঁজ নিয়েছিল, এমনকি গ্রামে পরিবারকে নানা প্রশ্ন করা হতো। ১৫ই জুলাই কলেজে হামলা হয়, সেখানে ছাত্রফ্রন্টেরই আমরা প্রায় চারজন ছিলাম। যার কারণে আক্রমণটা আমাদেরই ইন্ডিকেট করে করা হয়েছিল।
আমরা কিন্তু শুরু থেকেই মিছিলের ব্যাপারে এগিয়ে এসেছিলাম। আন্দোলন চলাকালে সক্রিয় নারীকর্মীরা টার্গেটে ছিল। পুলিশ একাধিক বাসায় তল্লাশি চালাতে থাকে।
আমাদের কিছু নারী সহযোদ্ধার পরিবারকেও হুমকি দেওয়া হয়। তাদের সন্তানদের আন্দোলন থেকে সরিয়ে আনার জন্য বলা হয়। অনেকের পরিবারকে ফোন দিয়ে ভয় দেখানো হয়েছে. আপনার সন্তান কী করে, কার সাথে মিশে, সাবধান করুন। কেউ কেউ নিয়মিত নজরদারির মধ্যেও ছিল।
বাসস: ১৬ জুলাই সারাদেশে বিভিন্ন স্থানে নারকীয় হামলা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সেদিন আপনাদের ক্যাম্পাসের কী অবস্থা ছিল?
শাহিনুর সুমি: ১৫ জুলাই ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে আমরা ক্যাম্পাস থেকে মিছিল নিয়ে নীলক্ষেত-সায়েন্স ল্যাব হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। আগের দিন আমি আহত হওয়া সত্ত্বেও মিছিলে যোগ দিই। সেদিনও হলের মধ্যে ছাত্রলীগ ভয়ভীতি দেখায়। রাতেও ইডেন কলেজ উত্তপ্ত ছিল। পরের দিন দুপুরের দিকে আমাদের সংগঠনের এক সদস্যের মাধ্যমে খবর পাই, রংপুরে আবু সাঈদ নামে এক শিক্ষার্থী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। এ হত্যার ঘটনায় অনেক বেশি উত্তেজনা তৈরি হয়। কোটা সংস্কারের মতো একটি যৌক্তিক আন্দোলনে মানুষকে এভাবে গুলি করে মেরে ফেলতে পারে, তা কল্পনার বাইরে ছিল। ইডেনের পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে রাতেই ছাত্রলীগের সভাপতি রিভা ও সেক্রেটারি রাজিয়া জীবনের ঝুঁকি বিবেচনায় বোরকা পরে হল ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু পরের দিন শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে ইডেন ছাত্রলীগের অন্যান্য নেত্রীরাও বেড়িয়ে যায়। ছাত্রলীগ হলগুলোতে সিট বাণিজ্য এবং মেয়েদেরকে যে পরিমাণ টর্চার করেছিল, সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনেকদিন থেকেই ক্ষুব্ধ ছিল। নেত্রীরা বেরিয়ে যাওয়ার পরই তাদের রুমে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র পায়। রুমগুলোতে রড, চাপাতি, হকিস্টিক পাওয়া য়ায়। যে কয়েকজন নেত্রী ধরা পড়েছিল, তাদেরকে প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেদিনই পুরা ক্যাম্পাস ছাত্রলীগমুক্ত হয়েছিল।
বাসস: ইডেন কলেজ ছাত্রীনিবাস খালি এবং ছাত্রলীগমুক্ত হওয়ার ঘটনা জানতে চাই।
শাহিনুর সুমি: দীর্ঘদিন ধরে ইডেন কলেজেন ছাত্রী নিবাসগুলোতে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ছিল, ছাত্রলীগের নেত্রীরা রুম দখল করে রাখতেন, মেয়েদের ওপরে প্রভাব বিস্তার করতেন, কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে ভয়ভীতি দেখানো হতো। এই অবস্থার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা একটি স্বতঃস্ফূর্ত ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নামে। ঘটনার সূত্রপাত হয় রাজিয়া হলের একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে। এক নারী শিক্ষার্থীর ছাত্রত্ব ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। তিনি ছাত্রলীগ নেত্রীর রুমে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করছিলেন। পরে তাকে কান ধরে ওঠবস করানো হয় এবং তার সমস্ত কাগজপত্র জব্দ করে প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এমন সময়েই আসে ১৬ জুলাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা। ১৭ জুলাই প্রশাসন জানিয়ে দেয়, কেউ ক্যাম্পাসে থাকতে পারবে না। সাধারণ শিক্ষার্থীরা আশঙ্কায় পড়ে যায়, হল খালি হওয়ার পর আন্দোলন টিকবে কীভাবে? তখন শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে এক সিদ্ধান্ত নেয়, হল খালি করা যাবে না। এরই মধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরোক্ষ হুমকি আসতে থাকে। ‘তোমরা যদি না বের হও, তাহলে আমরা তৃতীয় গেট খুলে দিব, ছাত্রলীগ বা যুবলীগ ঢুকে গেলে আমরা নিরাপত্তা দিতে পারবো না।’ পরে অনেকেই হলে ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। অনেক মেয়ের হাতে তখন ট্রেন বা বাসের টিকিট ছিল না। তারা কোথায় যাবে, কীভাবে বাড়ি ফিরবে, তা নিয়ে প্রশাসনের কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ছিল না। সেদিন মূলত একদিনের নোটিশে আমাদের বের করে দেওয়া হয়। কেউ ভাবল না, আমরা কোথায় যাব, কীভাবে থাকব। এই সময়েও কিছু সাহসী শিক্ষার্থী হলেই থেকে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছায়, অবশেষে তাদেরও হল ছাড়তে হয়।
বাসস: হল বন্ধ হওয়ার পর কোথায় থেকে কীভাবে আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে গেছেন?
শাহিনুর সুমি: ক্যাম্পাস বন্ধ হওয়ার পরও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা আসে। ১৮ জুলাই সকালে পুলিশ শাহবাগ ঘিরে রাখে। পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা আটকে রাখে। কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছিল না। তবুও আন্দোলন থেমে যায়নি। তখন শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নেয়, যেখানে আছি, সেখান থেকেই আন্দোলন চালিয়ে যাব। আমরা ইডেন কলেজ, ঢাকা কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজ, মিরপুর ও আশপাশের মেসে থাকা শিক্ষার্থীদের একত্র করে প্রেসক্লাবের সামনে নতুন করে আন্দোলন গড়ে তুলি। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আন্দোলন চলতে থাকে। আমাদের সমর্থনে সাধারণ মানুষ, রিকশাচালক ও অভিভাবকরা এগিয়ে আসেন। অনেকে খাবার, পানি পৌঁছে দেয়। অনেকেই মাইক এনে দেন। কেউ কেউ সংহতি জানান। এই সহানুভূতিই আন্দোলনকারীদের মনোবল বাড়িয়ে দেয়। যা ৫ আগস্ট পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরের ওই সময়টা ছিল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অপ্রত্যাশিত জাগরণ। ক্যাম্পাসে শূন্যতা তৈরি হওয়ার পর এটা পূরণ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। যাদের সম্পর্কে আগে ভাবা হতো ‘আত্মকেন্দ্রিক’, তারাই হয়ে উঠলো সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া মুখ। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আন্দোলনে নতুন গতি আনে, যা ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের মধ্যে দিয়ে একটা সফল আন্দোলনে পরিণত হয়।
বাসস: লাল বিপ্লব নিয়ে জানতে চাই।
শাহিনুর সুমি: ৩০ তারিখ লাল প্রতিরোধ ছিল এক ঐতিহাসিক স্মৃতি। সরকারিভাবে সেদিন ‘কালো দিবস’ পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। সরকার সেদিন কালো ব্যাচ ধারনের কথা বলে। কিন্তু আমরা যারা মাঠে ছিলাম, যারা রক্ত ঝরতে দেখেছি, যারা আমাদের ভাই-বোনদের জীবন দিতে দেখেছি, তারা প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আমরা কেন কালো ব্যাচ পরে শোক জানাবো? আমরা তো হারিনি। আমাদের ভাই-বোনেরা যে রক্ত দিয়েছে, সেটাই তো আমাদের সাহস, আমাদের শক্তি। সেই রক্তের রঙ তো লাল, যা প্রতিরোধের ও বিপ্লবের। আমরা সিদ্ধান্ত নিই, আমরা লাল ব্যাচ পরবো। মুখে লাল কাপড় পরবো, ফেসবুক প্রোফাইল লাল করবো। এটা ছিল সরকারের নির্ধারণ করা শোকের রাজনীতির বিপরীতে জনগণের দ্রোহের রঙ। আপনারা জানেন, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতিটি প্রোফাইল, প্রতিটি মুখ হয়ে উঠেছিল লাল। এটা নিছক একটা কাপড় নয়, এটা ছিল একটা রায় এবং জনগণ কার পক্ষে, তা জানানোর এক সংগঠিত অভিব্যক্তি। এই কাজটি করা সহজ ছিল না। প্রোফাইল লাল বা মুখে লাল কাপড় বাঁধার আগে আমাদের অনেক সহযোদ্ধা, অনেক বন্ধু ব্যক্তিগতভাবে হুমকি, পারিবারিক হয়রানি, এমনকি গ্রামে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখিও হয়েছিলেন।
বাসস: মার্চ ফর জাস্টিস নিয়ে জানতে চাই।
শাহিনুর সুমি: সেই সময়টাতে গণগ্রেফতার চলছিল। ছাত্র দেখলেই পুলিশ ধরছে, উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই কর্মসূচির পেছনে আমাদের ভাবনা ছিল, এই আন্দোলন যেন কেবল শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। আমরা চেয়েছিলাম, সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ। আইনজীবীরা ছিলেন আমাদের আন্দোলনের প্রকৃত সহযোদ্ধা। তারা সেদিন শুধু সহানুভূতি নয়, বরং সরাসরি আমাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন। আমরা হাইকোর্ট চত্বরে মার্চ ফর জাস্টিস পালন করি। সেদিন শহরের গলিগুলো যেন আন্দোলনকারীদের জন্য আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল। আমরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সবাইকে একত্রিত করতে সেগুনবাগিচা থেকে পল্টনের দিকে এগোচ্ছিলাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল আইনজীবীদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে একটি ন্যায়ের মিছিল করা। আমরা বিশ্বাস করতাম ন্যায়বিচার শুধু রাস্তায় নয়, আদালতের চত্বরে গিয়েও আমাদের দাবি তুলতে হবে। পুলিশ চারদিকে ঘিরে রাখায় সকাল থেকে চেষ্টা করেও আমরা হাইকোর্টে ঢুকতে পারছিলাম না। এমন সময় তিন দিক থেকে একযোগে তিনটি মিছিল এসে হাজির হলো। সচিবালয় সংলগ্ন এলাকা থেকে একটি মিছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হলের দিক থেকে একটি মিছিল এবং হাইকোর্টের ভিতর থেকেই আইনজীবীরা একটি মিছিল নিয়ে বের হয়ে এলে পুলিশ সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আইনজীবীদের মধ্যে অ্যাডভোকেট অরূপ দাস শ্যাম, রুবি আপা, মতিন ভাই সকলেই ছিলেন নেতৃত্বে।
বাসস: এই আন্দোলনে আপনাদের সংগঠনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কোন সংগঠনের ভূমিকা ছিল কি না?
শাহিনুর সুমি: এই আন্দোলনে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ভূমিকা অনেক বেশি ছিল। আন্দোলনে সাংস্কৃতিককর্মীরা কেবল গান গাননি, তারা ছিলেন মানসিক শক্তি জোগানোর সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম। গানের মিছিল, কবিতা আবৃত্তি, থিয়েটার স্টাইল স্ট্রিট-ড্রামা (মঞ্চায়ন) ও প্রতিবাদী শিল্প প্রদর্শনী করে তারা আমাদের প্রেরণা দিয়েছেন। এই আন্দোলনে আমাদের সংগঠনের পাশাপাশি আমাদের লাল্টু ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন সংগঠন চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক চর্চাকেন্দ্র এবং বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তারা কারফিউ উপেক্ষা করে দ্রোহযাত্রা, মার্চ ফর জাস্টিসসহ নানা কর্মসূচিতে যুক্ত ছিলেন। দেশের বিভিন্ন প্রগতিশীল নারী সংগঠন এবং বামপন্থী রাজনৈতিক দলের নারী শাখার আয়োজনে ২৫ জুলাই পল্টনে ‘নারী সমাবেশ’ ছিল অন্যতম। এটি ছিল আন্দোলনের এক নতুন পর্ব এবং নারীর অধিকার, রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারীদের অবস্থান। এখানে ইডেন কলেজ, ঢাবি ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নারী শিক্ষার্থীরা যুক্ত হয়। এই সমাবেশে শহীদ মীর মুগ্ধের নানি অংশ নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার নাতির রক্ত যেন বিফলে না যায়। তোমরা থেমো না।’
বাসস: এক দফা ঘোষণার পর কী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল? কীভাবে বিজয় এসেছিল?
শাহিনুর সুমি: ৩ আগস্ট ছিল এক দফা ঘোষণার দিন। এই দিনে প্রথমবারের মতো স্পষ্টভাবে শেখ হাসিনার পদত্যাগের একদফা দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয়। এতে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে ইডেন কলেজ, ঢাকা কলেজ, মিরপুর, রাজশাহী ও চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। দুপুরের দিকে শহীদ মিনারে এক সমাবেশে নাহিদ ভাই একদফা দাবি ঘোষণা করেন। যেখানে ‘৬ জুলাই গণভবন অভিমুখে মার্চ’-এর ঘোষণা দেওয়া হয়। শারীরিক অসুস্থতা থাকা সত্ত্বেও আমি মেয়েদের দল নিয়ে সকালেই শহীদ মিনারে উপস্থিত হয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিই। একদফা ঘোষণা পর্যন্ত শহীদ মিনারে মূল সমন্বয়কের জায়গায় অবস্থান করি । পরে সন্ধ্যায় মিছিল শহীদ মিনার থেকে শাহবাগে যাই। ৪ জুলাই অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এদিন ৫টা থেকে কারফিউ দেওয়া হয়। এদিনও সকাল থেকেই শাহবাগে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। সন্ধ্যা নাগাদ পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় হতাহতের ঘটনা ঘটে। শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানো হয়। চানখারপুল, ঢাকা মেডিকেল ও শাহবাগ এলাকায় সংঘর্ষ হয়। আমিসহ আমার সহযোদ্ধারা সেদিন আমাদের পল্টনের দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান করি। আন্দোলনের পরিস্থিতি বোঝার জন্য ‘অনুশীলন’ নামের অনলাইন মিডিয়ার আইডি কার্ড ব্যবহার করে আমরা কয়েকজন ঢাকা মেডিকেলসহ আশপাশে এলাকায় তদারকি করি। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ভিডিও বার্তায় সমন্বয়ক (বর্তমানে উপদেষ্টা) আসিফ মাহমুদ ৬ তারিখের পরিবর্তে ৫ তারিখ ‘মার্চ ফর ঢাকা’ ঘোষণা করে । রাত থেকেই মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুরসহ আশেপাশের জেলা থেকে ট্রাক, অ্যাম্বুলেন্স, বাইক ও পায়ে হেঁটে ছাত্র-জনতা ঢাকায় আসতে থাকে। আমরা সকাল ৯টা থেকেই পল্টনে আমাদের পার্টি অফিসে অবস্থান করি। কন্টিনিউয়াসলি সবার সাথে যোগাযোগ করছিলাম কে কোথায় আছে এবং কীভাবে আমরা বের হব। অনুশীলনের কার্ড ব্যবহার করে আমিসহ কয়েকজন পরিস্থিতি বোঝার জন্য ঢাকা মেডিকেলের দিকে যাই। সেদিন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রামপুরা-মালিবাগ হয়ে শাহবাগে আসতে থাকে। তখন অলরেডি শাহবাগে অনেক আন্দোলনকারী ঢুকে পড়ে। যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকেও একটা বিশাল মিছিল শাহবাগে আসতে থাকে। শহীদ মিনার থেকেও একটা অংশ শাহবাগে ঢুকতে থাকে। দুপুর ১টার দিকে খবর পাই, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে। সেই ঘটনাটা শোনার পরপরই আমরা অফিস থেকে বের হয়ে পল্টন থেকে রিকশা নিয়ে শাহাবাগ চলে আসি। পথে জনগণ ‘শেখ হাসিনা পালাইছে’ স্লোগানে উল্লাসে ফেটে পড়েন। আমরা তখন শাহবাগে সেনাবাহিনীকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানাই। এরপর আমরা শাহবাগ থেকে রিকশা নিয়ে গণভবনের দিকে যাত্রা করি।