বাসস
  ১২ জুলাই ২০২৫, ১৬:৩৬

আমরা শহীদদের রক্তের সাথে বেইমানি করিনি : ফাহাদ

ফায়েকুজ্জামান ফাহাদ। ছবি: সংগৃহীত

// পলিয়ার ওয়াহিদ //

ঢাকা, ১২ জুলাই, ২০২৫ (বাসস): চব্বিশের জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হচ্ছেন ফায়েকুজ্জামান ফাহাদ। তার জন্ম ২০০০ সালে ঢাকার নয়াবাজারে। লেখাপড়া করছেন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিকে। কবিতা লেখার পাশাপাশি অনুবাদেও হাত পাকিয়েছেন। তিনি আপাদমস্তক একজন প্রতিবাদী ও স্বাধীন চিন্তক। ফাহাদ জুলাই আন্দোলনের একজন সম্মুখসারির যোদ্ধা। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ১৫ জুলাই থেকে সরব ছিলেন। তিনি আন্দোলনে অংশ নিয়ে ১৭ জুলাই পায়ে আঘাত পান। কিন্তু ১৯ জুলাই আবারও মাঠে নামেন। সেদিনও গায়ে স্প্লিন্টারের আঘাত পান।

ফাহাদের প্রতিবাদী যাত্রা শুরু হয় নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে। জুলাই অভ্যুত্থানে স্বত:স্ফুর্ত যোগদানের মাধ্যমে যা পূর্ণতা লাভ করে। জুলাইকে ঘিরে একাধিকবার ছাত্রলীগ-যুবলীগের হুমকি পাশ কাটিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আন্দোলনে। পুলিশের বুলেটও তাকে থামাতে পারেনি। আর সব বাংলাদেশির মতোই তিনি আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে আশাবাদী।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর বিশেষ আয়োজনে মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন পলিয়ার ওয়াহিদ।

বাসস : জুলাইয়ের কত তারিখে কোথায় প্রথম স্বশরীরে আন্দোলনে যোগ দেন। কেন আন্দোলনে নামেন?

ফাহাদ: প্রথম থেকেই এ আন্দোলনের প্রতি সংহতি ছিল। কিন্তু সরাসরি জুলাইয়ের ১৫ তারিখে আন্দোলনে যুক্ত হই। মিস্টিক ব্যাপার হলো ওইদিন আমার ভাইয়া অসুস্থ ছিল। আমি তাকে নিয়ে ঢামেকে আসি। ভাইয়াকে ওটিতে দিয়ে আমি বাইরে বের হই। আন্দোলনের খবর কি দেখার জন্য। আমি শহীদ মিনারের দিকে যাচ্ছি। দেখি আমার থেকে মাত্র ৫০ হাত দূরে একদল লোক দেশি অস্ত্র হাতে দুজন শিক্ষার্থীকে ধাওয়া দিচ্ছে। তাদের একজনকে তারা আঘাত করে। এবং সে মাটিতে পড়ে যায়। আমি তাদের একজনকে ঢামেকে নিয়ে আসি। ইমার্জেন্সিতে নিয়ে দেখি হামলাকারীরা (ছাত্রলীগ) আবার হাসপাতালে চলে এসেছে।

বাসস : তারা কি হাসপাতালেও হামলা-মারধর করেছিল?

ফাহাদ : হ্যাঁ। তারা আহতদের ওপর আরেক দফা হামলা চালায়। সেখানে আমি আমার বন্ধু হাসান ইনামকে দেখতে পাই, সেও ছাত্রলীগের হামলায় আহত হয়েছিল। তাকে অক্সিজেন দেওয়ার পর ছেড়ে দেওয়া হয়। হাসপাতালে হামলাটি ছিল অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক। আমি তখন এতটা সাহসী ছিলাম না। হামলার মাত্রা বেড়ে গেলে ধীরে ধীরে নিজেকে বাঁচানোর জন্য কৌশলে ভাইয়ের অপারেশন থিয়েটারের (ওটি) সামনে গিয়ে বসে পড়ি। ১৫ জুলাই রাতে আরো অনেক খবর পাই। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিই, আর ঘরে বসে থাকা যাবে না। ১৬ জুলাই ফার্মগেটে আন্দোলনে যোগ দেই।

বাসস : ১৬ জুলাই ফার্মগেটে আপনাদের সঙ্গে কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল?

ফাহাদ : আপনারা জানেন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাধারণত একটু দেরিতেই আন্দোলনে নামে। ১৫ জুলাই আমি ফেসবুকে পাবলিকলি পোস্ট করি যে, আমরা ফার্মগেটে আন্দোলনে নামবো। যারা যোগ দিতে চাও চলে আসো। আমার সঙ্গে ধানমন্ডির ড্যাফোডিল, পান্থপথের সোনারগাঁও এবং এশিয়া প্যাসিফিকের শিক্ষার্থীরা মাঠে নামে। তেজগাঁও বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষার্থীরাও যুক্ত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কোনোভাবে আর যোগ দিতে পারেনি। আমরা ফার্মগেটে ওভারব্রিজের নিচে অবস্থান নিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারিনি। তখন আমরা প্রায় ৫০ জন শিক্ষার্থী ছিলাম। ফার্মগেটে দাঁড়াতে না পেরে আনন্দ সিনেমা হল পার হয়ে ক্যাম্পাসের সামনে আসি। সঙ্গে সঙ্গে ১০-১২ জন ছাত্রলীগ কর্মী আমাদের ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এরপরও আমাদের কেউ কেউ পান্থপথ ও মানিক মিয়া দিয়ে ধানমন্ডি ২৭-এ অবস্থান করে। পরে পান্থপথ সিগন্যালে দুপুর আড়াইটার দিকে আমাদের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১০০ জনে। এরপর আমরা ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে যাই এবং একটি গ্রুপ তৈরি করি।

বাসস : ছাত্রলীগের কাছ থেকে কোন হুমকি পেয়েছিলেন? আন্দোলনে তারা বাধা দিয়েছিল?

ফাহাদ : আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রলীগের কমিটি ছিল। ছাত্রলীগের এক সিনিয়র ভাই আমার ফেসবুক পোস্ট দেখে ফোন দেন। তিনি সরাসরি হুমকি দেননি, বরং বলেন, ‘তুই আমার ছোট ভাই। তোর যদি কিছু হয়ে যায়, তোকে বাঁচাতে পারবো না। আপাতত মাঠে নামিস না।’ উত্তরে তাকে বলেছিলাম, ‘দেখেন ভাই, আমার গলিতে আটটা কুকুর আছে। একটাকে ঘেউ ঘেউ করতে দেখলে বাকি সাতটাও ঘেউ ঘেউ করে। এর জন্য কি আমি বাসা থেকে বের হবো না?’

বাসস : ১৭ জুলাই তো আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তখন আপনি কোথায় ছিলেন?

ফাহাদ : ১৭ তারিখের গল্পটা একটু আলাদা। সেদিন বুধবার ছিল, মহররমের ছুটি। আমার বাসা শনির আখড়ায়। আমি যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনে অংশ নেই। ফার্মগেটে যাওয়ার পরিস্থিতি ছিল না। সেদিন আমার গায়ে ও মাথায় স্প্লিন্টার লাগে। আমি আহত হই, তাই ঢাবির গায়েবানা জানাজায় অংশ নিতে পারিনি। মজার বিষয় হলো, ওই দিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে টোলপ্লাজায় আগুন লেগে যায়।

বাসস : টোলপ্লাজায় আগুন কারা দিয়েছে? আপনি কি সেখানে ছিলেন?

ফাহাদ : এ নিয়ে অনেক গল্প আছে। কেউ বলেন, ব্রাইট স্কুলের এক ছাত্রকে তার বাবা কোচিং থেকে নিয়ে আসছিলেন অথবা নিয়ে যাচ্ছিলেন। ছেলেটি ক্লাস এইটে পড়ত। তাদের ওপর পুলিশ টিয়ারগ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা টোলপ্লাজায় আগুন লাগিয়ে দেয়। তবে এগুলো শোনা কথা।

বাসস : আন্দোলনটা কবে গণআন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয় বলে আপনি মনে করেন?

ফাহাদ : ১৭ জুলাই রাত ৯টার দিকে আমি অনুভব করি যে এটি গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে। সেদিন সন্ধ্যায় আমি আহত হই এবং বন্ধুরা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরি। সন্ধ্যা ৭টার দিকে বন্ধুরা ফোন করে জানায়, ক্ষুব্ধ জনতা টোলপ্লাজায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এক বন্ধু আমার বাসায় আসে, আমি তার কাঁধে ভর দিয়ে বের হই। গিয়ে দেখি, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সড়কে বসে আছে। ‘গণ’ বলতে কি আমরা শুধু এলিটদের বুঝি? না, তারা আমাদের মতোই বাংলাদেশের নাগরিক। তাদেরও অধিকার আছে। তারা সড়কে বসেছিল বলেই আমরা সফল হয়েছি। শহীদদের হিসাব করে দেখুন, কতজন এলিট আর কতজন সাধারণ মানুষ প্রাণ দিয়েছে? আমি এটিকে ‘গণঅভ্যুত্থান’ বলতেই গর্ব বোধ করি।

বাসস : আহত হওয়ার পরও পরদিন রাজপথে নামলেন?

ফাহাদ : হ্যাঁ। বরং আহত হওয়ার পর অস্বাভাবিক এক শক্তি অনুভব করছিলাম। মূল আন্দোলনের স্পট ছিল কাজলা থেকে যাত্রাবাড়ী মাছের আড়ৎ পর্যন্ত। ১৮ তারিখ আমি আন্দোলনের ফ্রন্টে চলে যাই। পুলিশ গুলি করছিল। আমার সামনেই এক তরুণ গুলি খেয়ে পড়ে যায়। তাকে ধরে রিকশায় উঠিয়ে দিয়েছি। অন্যরা হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে আমি আবার ফ্রন্টে ফিরে যাই। তখন বন্ধুরা মিলে ভাবছিলাম বাঁশ দিয়ে কোনো প্রতিরোধমূলক যন্ত্র বানানো যায় কি না। ইউটিউবে সেসময় এমন এক ভিডিও ভাইরাল ছিল।

বাসস : আন্দোলনের আগে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?

ফাহাদ : না, আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। আমি কবি মানুষ। রাজনীতি সচেতন ছিলাম, কিন্তু সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলাম না। তবে আমরা কেউই রাজনীতির বাইরে নই।

বাসস : জুলাইয়ের এমন কোনো স্মৃতি বলেন, যা এখনো কাউকে বলেননি?

ফাহাদ : আগে মাটির প্লেটে খেতাম, এখন কাচের প্লেটে খাই। মানে শুধু প্লেট বদলেছে, খাবার একই আছে। যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমরা রক্ত দিয়েছি, বুক পেতে দিয়েছি, সেই পরিবর্তন এখনো আসেনি। এটাই না বলা গল্প।

বাসস : আপনার সামনে কেউ হতাহত হয়েছিল? সেই স্মৃতি বলুন।

ফাহাদ : খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। ১৯ জুলাই মাগরিবের আজানের সময়। এক ছেলেকে দেখলাম, কালো টি-শার্ট পরে। আরেকজন সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা মাদ্রাসার ছাত্র। হঠাৎ আলোর ঝলকানি। কালো টি-শার্ট পরা ছেলেটার মুখে গুলি লাগে, মাথার একপাশ উড়ে যায়। সে লুটিয়ে পড়ে। মাদ্রাসার ছেলেটার বুকের একপাশে গুলি লেগে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। তার শ্বাস চলছিল, কিন্তু অবস্থা গুরুতর। সেই দৃশ্য যুদ্ধের ময়দানেও দেখা যায় না। গা কাঁপছিল। আমি আর সেখানে থাকতে পারিনি।

বাসস : স্নাইপার দিয়ে কারা গুলি করেছিল বলে মনে করেন? পুলিশের তো হাঁটুর ওপরে গুলি করার নিয়ম নেই। অনেকে মনে করেন, তারা বিদেশি বাহিনী। আপনার কী মনে হয়েছে?

ফাহাদ : সন্দেহ তো হয়। তবে প্রমাণ ছাড়া কিছু বলা উচিত নয়। শোনা যাচ্ছে, ১৯ জুলাই রাতে কাজলা আদর্শ স্কুলের গলিতে বস্তাবন্দী এক লাশ পাওয়া যায়। সে নাকি হিন্দি ভাষায় কথা বলতো। তার পকেটে দুটি পিস্তল ও একটি ভারতীয় আইডি কার্ড পাওয়া যায়। তবে এগুলোও শোনা গল্প। কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

বাসস : যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনকারীরা রাতে কোথায় থাকত?

ফাহাদ : অনেকে রাতে থাকত। ট্রাক দিয়ে রাস্তায় ব্লকেড দেওয়া হতো যেন কোনো গাড়ি ঢাকায় ঢুকতে না পারে। এই কাজগুলো আন্দোলনকারীরা রাতের বেলায় করত। শোনা যায়, তাদের মধ্যে স্থানীয় ছাত্র এবং রাজনৈতিক দলের কর্মীরাও ছিল।

বাসস : আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ কবে থেকে শুরু হয় বলে মনে করেন?

ফাহাদ : আমি ১৬ জুলাই প্রথম মাঠে নামি। সেদিন থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা মাঠে নেমেছিল। ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরের নেতারা ছিল। বিশেষ করে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার পর দেখি, অর্ধেকই বিভিন্ন দলের ছাত্রনেতা। আওয়ামী লীগ বাদে সব দলের নেতারাই ছিল।

বাসস : আপনি একজন  কবি। জুলাই নিয়ে কোনো কবিতা লিখতে পেরেছেন?

ফাহাদ : না। কবিতা লিখতে পারিনি। তবে জুলাইয়ের আগে একটা একটা নাটক লিখেছিলাম। জুলাই সেই ধারণা একেবারে বদলে দিয়েছে। আপনি হয়তো জানেন, জ্যাঁ-পল সাঁর্ত্রের একটা ধারণা আছে ফিলোসোফিক্যাল ডেথট। আমার ধারণা ছিল ফিলোসোফিক্যাল বাস্টার্ড। এটা মূলত আমাদের তরুণ সমাজকে ইন্টিকেট করতেছিলাম। যে এরা পলিটিক্যালি আনঅ্যাওয়ার। রাজনৈতিক সচেতনতা না থাকার ফলেই কিন্তু আমাদের এতদিন ভুগতে হলো। কিন্তু জুলাই সেই চিন্তাকে মাঠে মেরে দিয়েছে। বরং জুলাইতে একজন শিশুও যেন রাজনীতির অংশ হয়ে উঠেছিল!

বাসস : আপনারা ঢাকায় আন্দোলন করেছেন। কিন্তু ওই সময় ঢাকার বাইরে কোনো আন্দোলকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল?

ফাহাদ : এক বন্ধু ছিল নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওরা নোয়াখালীতে আন্দোলন তেমন জমাইতে পারে না। মানে আওয়ামী লীগ ও সরকারি বাহিনীর কারণে সংঘবদ্ধ হতে পারে নাই। পরে ঢাকায় এসে আন্দোলনে যোগ দিয়েছে।

বাসস : আন্দোলনে সময় বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ নানাভাবে আন্দোলনকারীদের সাহায্য করেছে? আপনি কি কাউকে সাহাস্য করতে দেখেছেন? আপনার অভিজ্ঞতা কী?

ফাহাদ : ১৮ ও ১৯ জুলাই এবং আগস্টের ৫ দিন তো পুরাই কারবালার ময়দান। কারণ কে কোথায় মারা যাচ্ছে। কার কখন গুলি লাগছে। কে কোথায় চিকিৎসা নিচ্ছে। কার কোথায় কবর হচ্ছে! কোনো কিছুই কেউ সার্বিকভাবে বর্ণনা করতে পারবে না। এ রকম মুহূর্তে যারা বিস্কুটের দোকান ছিল সে তার সব খাবার বের করে দিয়েছে। কেউ কেউ পানি বিলি করে বেড়াচ্ছে। এই সৌভাগ্য একদিন আমাদেরও হয়েছে। আমার এক বন্ধু রাকিব। তার আপা অস্ট্রেলিয়া থাকে। ওই আপু আমাদের একদিন ৬০ হাজার টাকা পাঠায়। বলে তোরা অটো ভাড়া করে যারা আন্দোলন করছে তাদের বিস্কুট-পানি কিনে বিলি করিস। আমি তো সবসময় আন্দোলনের ফ্রন্টে থাকি। একদিন দেখি রাকিব ঠিকই অটোতে করে বিস্কুট পানি বিলি করতে করতে যাচ্ছে। আমাকে আর আমার জাহাঙ্গীরনগরের বন্ধু রাহাত ছিল সঙ্গে। আমাদের কাছে একটা পানির কেস দিয়ে গেল। বিলি করার জন্য। এই অভ্যুত্থানকে আপনি গণঅভ্যুত্থান না বলে কি বলবেন? যে আন্দোলেনে অংশ নিতে পারছে না কিন্তু অর্থ দিয়ে সাহায্য করছে। এ রকম হাজার হাজার ঘটনা আছে ভাই। আরেকটা বলি। ১৮ সালে নিরাপদ সড়কের ছাত্র আন্দোলনেও কিন্তু মায়েরা খাবার রান্না করে আনছিল। রাস্তায় মুখে তুলে খাওয়াই ছিল। কেউ কাউকে চিনতো না। কিন্তু মায়ের মতো আদর করে খাওয়াইতো।

বাসস : গণআকাঙ্খা কতটা পূরণ হলো? প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নিয়ে বলুন।

ফাহাদ : প্রথমত, এটা কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না। কিন্তু সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর কথাই শুনছে। তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু আন্দোলনটা যে গণআন্দোলন সেই গণমানুষের, সাধারণ মানুষের কথাই তো সরকার শুনছে না। এটা প্রথম ব্যর্থতা। জুলাই ঘোষণাপত্র এখনো প্রকাশিত হয়নি। ফলে এখনো আমরা রাষ্ট্রদ্রোহী। এটা প্রত্যাশা করেছিলাম সবার আগে। যদিও আমি এখনো ড. ইউনূসের ওপর ভরসা রাখতে চাই। তার ওপর বিশ্বাস হারাতে চাই না। এতগুলো মানুষের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে এই সরকার। তিনি যেন আমাদের হতাশ না করেন। সবচেয়ে বড় চাওয়া হলো রাজনৈতিক সংস্কার হওয়া। কারণ আওয়ামী লীগ যা করতো বিএনপি তাই করছে। আগে যুবলীগ চাঁদাবাজি করতো এখন যুবদল করছে। এমন কি আওয়ামী লীগের অফিস এখন বিএনপির অফিসে পরিণত হয়েছে।

এ ছাড়া প্রথম যখন শুনছি বিপ্লবী সরকার হচ্ছে না। তখনই প্রথম দফা আহত হয়েছি। আর দ্বিতীয় শক্ড হয়েছি সেই খুনি রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে শপথ নিয়েছে। আমরা শহীদ মিনার থেকে আন্দোলন শুরু করেছিলাম। শহীদ মিনারেই শপথ নিতে পারতাম। তারপর আহতদের সুচিকিৎসা করানো হয়নি। শহীদদের ন্যায্য সম্মান, তাদের পরিবারের পুনর্বাসনও হচ্ছে না। এটা হওয়া জরুরি।

বাসস : আপনার স্বপ্ন তো রাজনৈতিক দল ছাড়া পূরণ করতে পারবে না মনে হয়! সে ক্ষেত্রে কোনো নতুন রাজনৈতিক দলে যোগ দেবেন কিনা? কেউ কি যোগাযোগ করেছে?

ফাহাদ : হ্যাঁ, দুই একজনের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারাই যোগাযোগ করেছে। তাদের নাম বলতে চাই না। তাদের মোটিফ ততটা মন:পূত হয়নি। তাদের নয়া বন্দোবস্তের কোনো কিছুই নয়া মনে হয়নি। নতুন খামে পুরোনো চিঠি। এছাড়া সরাসরি রাজনীতে যুক্ত হতে চাই না। তবে কোনো না কোনোভাবে রাজনীতি নিয়েই তো আছি। আরও লেখাপড়া করছি। প্রস্তুতি নিচ্ছি। রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা করছি। এই তো।

বাসস : জুলাইকে অনেকে মুক্তিযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে। আপনি একাত্তর ও চব্বিশকে কীভাবে বিচার করবেন?

ফাহাদ : দ্যাখেন ভাই, জুলাই ও মুক্তিযুদ্ধকে মুখোমুখি করে আর রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা যাবে না। কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে আওয়ামী লীগ বাড়াবাড়ি করেছে বলেই কিন্তু আমাদের জুলাই করতে হলো। ফলে একটা প্রথম ফেইস আরেকটা হইলো দ্বিতীয় ফেইস। একাত্তরে মানুষ মুক্তির জন্য যুদ্ধ করেছে। চব্বিশেও কিন্তু সেই মুক্তির জন্য শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ জীবন বাজি রেখে রাজপথে নেমে আসে। এটা ছিল আরেকটার ফুল। সেই ফুল ফলে পরিণত হয়েছে।

বাসস : আবার যদি গণঅভ্যুত্থানে ডাক আসে মাঠে নামবেন?

ফাহাদ : গুড। ভালো প্রশ্ন করেছেন। আবারও মাঠে নামবো। এবং যে কথাটা আপনিও বলেছেন। সেটা আমি আরেকটু জোর দিয়ে বলতে চাই। সেটা হচ্ছে আগামী ১০ বছর না হোক কিংবা ১৫ বছর হোক বোধহয় আমাদের আরেকটা অভ্যুত্থান করতে হবে। তবে রাজনীতিতে শেষ কথা বলে তো কিছু নেই। কত শক্তিশালী দল আওয়ামী লীগ। বর্তমানে তাদের অবস্থা দ্যাখেন। কি বেহাল ধশা। চিন্তা করা যায়। ফলে শাসক না, জনতাই আসল শক্তি।  এ কথা শাসকরা যেন ভুলে না যায়।

বাসস : শহীদ মিনারে দ্রোহের যাত্রায় নাহিদ ইসলাম ১ দফা ঘোষণা করেন। এদিন কোথায় ছিলেন?

ফাহাদ : ওই দিন শনির আখড়া থেকে হেঁটে হেঁটে শহীদ মিনারে এসেছি। সে কি লোকে লোকারণ্য অবস্থা। এত মানুষ জীবনে কখনো দেখিনি। আর দেখা হবে কিনা আল্লাহ জানেন।

বাসস : ৩৬ জুলাই কোথায় ছিলেন? হাসিনা পালানোর খবর কখন কীভাবে পান? অনুভূতি কেমন ছিল?

ফাহাদ : ৫ আগস্ট সকাল ১১টার দিকে আমরা রওনা দিই শাহবাগের দিকে। তো ওদিকের যত স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা আছে সবাই যোগ দেয়। শনির আখড়া থেকে আমরা কাজলার দিকে রওনা দেই। সেখানে মামুনুল হকের বড় মাদ্রাসা আছে। প্রায় ১০-১২ হাজারের মতো শিক্ষার্থী হবে। ওরা বের হয়েছে। মাদ্রাসার সামনে যখন আসি তখন ভয়ানক গোলাগুলি শুরু হয়। এতে চোখের সামনে অসংখ্য মানুষ আহত হয়। অনেকে শহীদ হয়। আমার মাথায় স্প্লিন্টার লাগে। কিন্তু মনে হলো আজ শাহবাগে যেতেই হবে। ধোলাইপাড়, পুরান ঢাকা, খিলগাঁও, রাজারবাগ হয়ে মৎস ভবনে এসে দেখি সেনাবাহিনী। তারা ঢুকতে দিচ্ছে না। তারা বলে, আপনারা এখানে মিছিল করেন। শ’ খানেক মানুষ হলে ছেড়ে দেব! তখন দুপুর ১টার মতো বাজে। এর মধ্যে আমার এক বন্ধু ফোন করে। তার ভাই নাকি জানিয়েছে সেনাবাহিনী প্রধান ১ ঘণ্টা পরে ভাষণ দেবেন। ধারণা করা হচ্ছে হাসিনা পালিয়ে গিয়েছে! দম বন্ধ হয়ে আসছিল তখন! বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! হঠাৎ নেট চলে আসে। প্রথমেই আসিফ নজরুলের একটা ভিডিও দেখি। আমরা উল্লাস করতে করতে দৌঁড়াচ্ছিলাম। আবার ভাবছিলাম এত রক্তের পরও কি আসলে মুক্তি পেলাম? নাকি আবারও কোথাও বন্দী হয়ে যাচ্ছি? কিন্তু এটা ভেবে আনন্দাশ্রু ঝরছিল যে আমরা আমাদের শহীদ ভাইদের রক্তের সাথে বেইমানি করিনি।

বাসস: আপনাকে ধন্যবাদ।

ফাহাদ: বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা এবং আপনাকেও ধন্যবাদ।