বাসস
  ১২ জুলাই ২০২৫, ১৩:২৮

সমাজের ভেতর ফ্যাসিবাদী আলামত রেখে দিলে তা হবে শহীদের রক্তের সাথে বেইমানি: ফারাবী জিসান

ফারাবী জিসান। ফাইল ছবি

অর্বাক আদিত্য

ঢাকা, ১২ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : ফারাবী জিসান, জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। জুলাই বিপ্লবের আগে থেকেই তিনি নানা সময়ে সরকারের কঠোর সমালোচনা করতেন। 

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের দলীয় অপতৎপরতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি আলোচনায় এসেছিলেন। এছাড়া প্যালেস্টাইনের নিপীড়িত মানুষের পক্ষে তিনি একাধিক কর্মসূচির আয়োজন করেন।

গত জুলাইয়ে তিনি ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিস্ট সরকারের টার্গেটে পরিণত হন। তাকে থাকতে হয়েছিল আত্মগোপনে। 

জুলাইয়ে অপতথ্য ও গুজব ছড়িয়ে তৎকালীন সরকার আন্দোলনকে প্রতিহত করার কৌশল নিলে ফারাবীরা কয়েকজন মিলে তৈরি করেন ডিসকর্ড সার্ভার। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও এই জুলাই যোদ্ধা তার অবস্থান থেকে একবিন্দুও সরে আসেননি। 

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে বাসসের বিশেষ আয়োজনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এই ছাত্রনেতা তার বিপুল অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। 

বাসস: আপনারা (ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি) আন্দোলনে যুক্ত হলেন কবে?

ফারাবী জিসান: বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনটা তো শুরু হয়েছিল জুন (২০২৪) মাসের দিকে। ওই সময় একটা ছোটখাটো আলাপ চলছিল। কিন্তু ওইভাবে ছড়ায়নি। স্বল্প উপস্থিতিতে বিক্ষোভ-মিছিল চলছিল।  তখনও আমরা যোগ দেইনি। একটা বিষয় হলো কী, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ার কারণে কোটার প্রতি আসলে ওই ধরনের ঝোঁক ছিল না আমাদের। আমার ভাই সরকারি চাকরি করেন। ৩৮তম বিসিএস এর। তো প্রথম ভাইয়ের কাছ থেকে কোটার বিষয়টা জানলাম। জানলাম মানে, ডিটেইলে। এরপর ভাবলাম, এই আন্দোলনে যুক্ত হওয়া দরকার। 

জুলাইয়ের ১৫ তারিখে আমরা অফিশিয়ালি আন্দোলনে যুক্ত হলাম। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সামনে, রামপুরাসহ বেশ কয়েকটা জায়গায় ব্লকেড কর্মসূচি, ছোট পরিসরে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করলাম। 
বাসস: এর আগে এ ধরনের অ্যাক্টিভিজম করেছেন?

ফারাবী জিসান: আমি আন্দোলন-সংগ্রামের সাথে বহুদিন ধরেই জড়িত। আমাদের ক্যাম্পাসে (ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি) যখন ছাত্রলীগের প্রথম কমিটি প্রকাশ হয়, তখন আমি এর প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছিলাম। অবশ্য সেই সময় আমার সাথে কেউই ছিলেন না। বলতে গেলে একাই এর প্রতিবাদে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম ভার্সিটির সামনে। 

এছাড়া প্যালেস্টাইন মুভমেন্টসহ বেশ কিছু মুভমেন্টও আমরা করি। আওয়ামী লীগ সরকারের যেই ভূমিকা, এর বিরুদ্ধে আমি স্কুল লেভেল থেকেই ফেসবুকে লেখালেখি করি। সো যার কারণে আমার বাসায় অনেক সময় ইন্টার্নাল কাউন্সিলের মিটিং হইসে। অনেক থ্রেটও পেয়েছি।

বাসস: জুলাই মুভমেন্টে এসব তো প্রভাব ফেলেছে?

ফারাবী জিসান: অবশ্যই। যখন ভাইয়ার কাছ থেকে বিস্তারিত শুনলাম। তখনই ডিসিশান নিলাম, এটাতে যুক্ত হতে হবে। তবে সমস্যা দাঁড়ালো, সেসময় আমাদের মিডটার্ম পরীক্ষা চলছিল। আমাদের প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির বিষয়ে কতটুকু জানেন, জানি না। আমাদের এই পরীক্ষাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে একটা কনফিউশান তৈরি হলো। কী করা যায়। আবার ওদিকে ঢাবিসহ সারাদেশের পাবলিক ইউনিভার্সিটিগুলোতে ছাত্রলীগের হামলা চলছিল। পরে আমরা একটা গ্রুপ খুলি। সেই গ্রুপে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আমরা এই মুভমেন্টে জয়েন করবো। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা অফিশিয়াল গ্রুপে পোস্ট করি যে, আমরা আগামীকাল কর্মসূচি পালন করবো। আর আমাদের গ্রুপটাকে আমরা আন্দোলনের কোঅর্ডিনেশন গ্রুপ হিসাবে পরিচালনা করি। ১৬ জুলাই ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে একটা ব্লকেড কর্মসূচি হয়। আমরা এর নাম দিয়েছিলাম ‘বাড্ডা ব্লকেড’। এই নামটা দিলো আমার বন্ধু মেহের। সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। ঐদিন আমাদের ইউনিভার্সিটি মোটামুটি সহযোগিতা করেছে। ভালোই সহযোগিতা করেছে।  

বাসস: পুলিশ বা প্রশাসনের কাছ থেকে সেদিন কোনো বাধা পাননি? 

ফারাবী জিসান: হ্যাঁ। আমাদের কর্মসূচি ছিল পাঁচটা পর্যন্ত। তো ঐ সময় দুপুর দুইটার দিকে বাড্ডা থানার ওসি আমাদের রেজিস্ট্রার ও প্রক্টরকে ফোন দেন। ফোন দিয়ে তারা তাদের জানান, আমাদের কর্মসূচি যেন তিনটার মধ্যে ক্লোজ করি। ওই ফোন পাওয়ার পর স্যার আমাকে ডেকে পাঠান। রেজিস্ট্রার অফিসে যাই। তখনও আমাদের মুভমেন্ট চলছে। রেজিস্ট্রার অফিসে ছোটখাটো বাকবিতণ্ডা হয়। কারণ স্যারের মতামত ছিল কর্মসূচি তিনটার মধ্যে শেষ করতে হবে। আমি স্যারকে বলছিলাম যে স্যার পাঁচটা পর্যন্ত বলা আছে। এইটার বাইরে আমি স্টুডেন্টদের বোঝাতে পারবো না। এক পর্যায়ে স্যারকে বলি, ঠিক আছে আমরা সাড়ে চারটা পর্যন্ত রোড ব্লক করে রাখবো। 

তখন স্যার বললেন, ঠিক আছে, তোমরা যদি পারো তাইলে কর। তো এই আলাপ করতে করতে এক পর্যায়ে চারটার মধ্যে পুলিশ চলে আসে। একই সময়ে আমরা খবর পাই, ভাটারাতে (বারিধারা-নতুনবাজার) ছাত্রলীগ ইউআইইউ, এআইইউবি স্টুডেন্টদের ওপর হামলা চালিয়েছে। ফলে পুলিশ আসার পরে বেশ উত্তেজনা তৈরি হয়। 

পরিস্থিতি বেশ গরম হয়ে গিয়েছিল। তারপর আমি ওসির সাথে কথা বলি। ওসিকে কনভিন্স করি যে আরো কিছুক্ষণ লাগবে আমাদের। তারপরে ফাইনালি ওসি কনভিন্স হয়। ওইদিন তারা আর কোনো সমস্যা করেনি। মোটামুটি পাঁচটা পর্যন্ত আমরা চালিয়েছি। তারপর আমরা উঠে গিয়েছি।

বাসস: পুলিশ কিছুই বললো না? 

ফারাবী জিসান: ভাই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের ওপর নর্মালি কেউ হাত তুলতে চায় না। কারণ এইখানে প্রিভিলিজড ঘরের ছেলেমেয়েরাই পড়তে আসে। কাজেই পুলিশ না জেনে, কারো গায়ে হাত তুলতে চায় না। 

কারণ, দেখা গেলো, যার ওপর হাত তুলেছে, সে হয়তো কোনো বড় আমলা বা ব্যবসায়ী বা মন্ত্রী-এমপির ছেলে। পরে খামোকা তারা ঝামেলায় পড়বে। এই ভয়ে হয়তো আমাদের সাথে তারা সেদিন খারাপ বিহ্যাভ করলো না। 

কিন্তু এই প্রোগ্রামের পর ঝামেলা যেটা বাঁধলো, ইউজিসি জানিয়ে দিল, কোনো ইউনিভার্সিটি খোলা থাকবে না। তো পরদিনের কর্মসূচি নিয়ে দ্বিধায় পড়লাম। রাতে রেজিস্ট্রার অফিসে ফোন দিলাম। জানতে চাইলাম, আগামীকাল ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির গেইট খোলা থাকবে কিনা। তারা আমাকে কোনো উত্তর দেয়নি। পরে রাত বারোটার দিকে রেজিস্ট্রার অফিস থেকে একটা গ্রুপ কল করে। গ্রুপ কল করে বলে যে, আগামীকাল আমরা কোনো সহযোগিতা করব না। ইউনিভার্সিটির গেইট খোলা থাকবে না। কালকে বন্ধ থাকবে। তো আমি আর কথা বাড়াইনি। পরদিন সকাল বেলা চলে আসলাম। সকালের প্রথম দিকে যেহেতু স্টাফরা ঢোকেন, সো ওইসময় গেইট খোলা থাকে। 

স্টাফদের সাথেই আমরা কয়েকজন স্টুডেন্ট ভেতরে ঢুকে প্ল্যাকার্ড ম্ল্যাকার্ড সবকিছু গুছিয়ে নিলাম। সকাল ৯টার দিকে আমরা গেটের সামনে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়ালাম।

ওইসময় পুলিশের একটা প্যাট্রোল টিম যাচ্ছিল। সেই টিমে ওসি ইয়াসিন আর জেলা এসপি হাসান রানা ছিলেন। আমরা আমাদের পেরিফেরির ভেতরেই ছিলাম। তারা এসে বললো, এখানে দাঁড়ানো যাবে না। আজ ভার্সিটি বন্ধ। তারপরও আমরা কেন আসছি? এ ধরনের বিভিন্ন কথাবার্তা বলছিল। এক পর্যায়ে এটা একটু হিটেড কনভারসেশন হয়ে গেছে। বাকবিতণ্ডা শুরু হলো। সে সময় আমরা আমাদের সিকিউরিটি ইনচার্জকে জানালাম। তাকে বললাম, পুলিশ তো এলো। আমরা খবর পেয়েছি, ইউলুপের (মেরু বাড্ডা) ওই জায়গাটাতে ছাত্রলীগের ছেলেপেলে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত আছে। তারা যে কোনো সময় হামলা করতে পারে। আমরা রিকুয়েস্ট করলাম, যেন মেইন গেইটটা খুলে দেওয়া হয়। তিনি জানালেন, গেইট খোলা রাখার কোনো নির্দেশনা তাদের কাছে নাই। গেইট খোলা রাখলে তাদের চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়তে পারে। 

আমি তাদের আরেকবার জিজ্ঞেস করলাম, আপনি গেইট খুলবেন, নাকি খুলবেন না। তিনি জানালেন, গেইট খুলবেন না। তার সাথে আর কথা না বাড়িয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম গেইটের তালা ভাঙবো। গেইট টপকে ভেতরে ঢুকলাম। গেইটে যারা দায়িত্বে তারা ইতস্তত করছিলেন। আমরা বললাম, আপনারা বলবেন, জোর করে আপনাদের তাড়ায়ে দিয়ে আমরা গেইটের তালা ভাঙছি। তো ভেতরে ঢুকে আমরা বেসিক্যালি হাতুড়ি টাইপের কিছু খুঁজতেছিলাম, পাইনি। পরে নো পার্কিং এর একটা পাইপ (স্টিল টাইপের) পেলাম। ওটা দিয়ে তালার ওপরে মনে হয় প্রায় পঞ্চাশটা বাড়ি দিলাম। তিরিশটা মারার পরে আমার হাত অবশ হয়ে গেল প্রায়। আমি হাঁপিয়ে উঠলে আমার বন্ধু বাড়ি মারলো। অবশেষে তালাটা ভেঙে পড়ে গেল। আমরা গেইটটা খোলা রাখলাম। গেইট খোলার পরে আমরা বাইরে এলাম। বাইরে আসতেই এসপি রানা এলেন। বললেন, আপনাদের পাঁচ মিনিটের আল্টিমেটাম দেওয়া হলো। আপনারা যদি না উঠেন, উই উইল শ্যুট। তো তখন আমি বললাম ঠিক আছে। আমি তাদের পাল্টা পাঁচ মিনিটের আল্টিমেটাম দিলাম। বললাম, আপনারা থানায় ফেরত যান। আর না হলে আপনাদেরও কাউন্টারেকশন ফেস করতে হবে। তখন তিনি বললেন, ওকে লেটস সি। তারা চলে গেল। চলে যাওয়ার দুই মিনিটের ভেতরে তারা প্রথমে সাউন্ড গ্রেনেড পরে টিয়ারশেল মারতে শুরু করলো। আমি প্রায় ২০ থেকে ২৫টা টিয়ারশেল খাই।

বাসস: আপনারা কী তখন ভয় পেলেন বা ছত্রভঙ্গ হলেন?

ফারাবী জিসান: এখানে একটা বিষয়ে একটু বলি, সেইটা হলো- পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে আবাসিক হল থাকে। ফলে সেখানে যে কোনো একটা মুভমেন্ট রান করা সহজ। খুব দ্রুত স্টুডেন্টদের জড়ো করা যায়। প্রাইভেটের জন্য যেটা কঠিন। এখানে বিভিন্নজন বিভিন্ন এলাকায় থাকে। তাদের নিয়ে আসা খুব কষ্টকর। আবার ওপেন গ্রেড সিস্টেমের কারণে আমরা আসলে একে অপরকে চিনিও খুব কম। এ জন্য আমরা অল্টারনেটিভ একটা চিন্তা করলাম।

ভাবলাম, এভাবে আসলে হবে না। আমরা দিনদিন সংখ্যায় কমে যাবো। ভালো হয় যদি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্মিলিতভাবে মুভ করতে পারি। হয়ত প্রত্যেক ইউনিভার্সিটি থেকে যদি অল্পসংখ্যক স্টুডেন্টও আসে, তারপরও সেইটা চার থেকে পাঁচশো হয়ে যাবে। এটা বিশাল গ্যাদারিং হয়ে যাবে তখন। এই ভাবনা থেকে আমরা আনঅফিশিয়াল প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি অ্যালায়েন্স নামের একটা ফোরাম গঠন করি। ওই ফোরামে প্রায় ১৮টা ইউনিভার্সিটি ছিল। তো পুলিশের হামলার পর ওই ফোরামের গ্রুপে মেসেজ স্টার্ট করি। কিছুক্ষণের মধ্যে বাড্ডার দিক থেকে একটা মিছিল আসে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদের, আবার ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরাও রামপুরার দিক থেকে আসে। তখন আমরা ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে বাইরে বের হই। সে সময় পুলিশ দুইভাগ হয়ে যায়, একটা ভাগ অবস্থান নেয় কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির ওই দিকটাতে, আরেকটা অবস্থান নেয় হাতিরঝিলের সাইডে।

ওই যে টিয়ারশেল খাওয়ার কারণে আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। একপর্যায়ে আমাদের মেডিকেলে গেলাম। আমার সাথে আমার বন্ধু ঐতিহ্য ছিল। সে সময় আমাদের মেডিকেলে একটা ছেলেকে ধরাধরি করে নিয়ে আসে। ছেলেটা গুলি খেয়েছে। ও রাস্তায় থাকতেই মারা গেছে। তাকে একটা স্ট্রেচারে বাংলাদেশের পতাকা মোড়ায়ে আমাদের ইউনিভার্সিটি প্রেমেজের ভেতরে আনা হলো। ওই প্রথম আন্দোলনে গুলি খেয়ে মৃত্যু দেখলাম। তার গায়ে জড়ানো পতাকাটা খুলে দেখি ছেলেটা আকাশের দিকে তাকায়ে আছে।

বুকের ভিতরে মিনিমাম ২০০-৩০০টা গুলি আছে। 

পুরা বুকটা একদম ঝাঁঝরা হয়ে আছে। তখন ওই ছেলেটার বাবা-মা জানে না তাদের ছেলে মারা গেছে। ছোট্ট একটা ছেলে, কলেজে পড়ে, ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। ওই সময়টাতে অনেক কষ্ট পেয়েছি। আমরা যারা সেখানে ছিলাম, মিটিং করলাম। বললাম, গদিটা কি আসলেই এত ইম্পর্ট্যান্ট যে মানুষ মেরে ফেলতে হচ্ছে! বেশ উত্তেজনা তখন আমাদের মধ্যে। আমি আহত হয়েছি শুনে মা এক বাইকারকে রিকুয়েস্ট করে ব্র্যাকে পৌঁছালেন। 

পরে আমার ফ্যামিলির অনেকে এলেন। আহত অবস্থায় আমাকে নিয়ে তারা সিএনজিতে উঠলেন। তখন বেশিরভাগ রাস্তাই ছাত্রদের দখলে। আইডি কার্ড দেখিয়ে আমরা এসে উঠলাম মোহাম্মদপুরে। তখন আমার ফোনও নেই। গুলি লেগে ফোনটা নষ্ট হয়ে গেছে। সিমও ওপেন করতে পারছি না। এদিকে ভয় আর আতঙ্ক। কারণ ততক্ষণে পুলিশ রাতে রেইড দেওয়া শুরু করেছিল। ভাইয়ার একটা নম্বর আমি মাঝেমধ্যে ব্যবহার করতাম সেই নম্বর থেকে বন্ধুদের খোঁজ নিলাম। অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। 

বাসস: এটা কী কারফিউয়ের সময়ে?

ফারাবী জিসান: হুম! এর মধ্যে জানতে পারি, নাহিদ ভাইদের (নাহিদ ইসলাম) ডিবি অফিসে তুলে নেওয়া হয়েছে। 

তখন তো পেপার আর টিভি স্ক্রলই ভরসা। দেখলাম, তাদের গণস্বাস্থ্যে নিয়ে আসা হয়েছে। আমি ঠিক করলাম, সেখানে যাবো। ভাইয়ার এক বন্ধু গণস্বাস্থ্যে চাকরি করতেন।

তিনি তাকে ফোন দিলেন, জানলেন যে তাদের আবারও উঠায়ে নেওয়া হয়েছে। আমি আসলে যাইতে চাইছিলাম, আলাপ করার জন্য। কী করা যায়। কেমন কর্মসূচি দেওয়া যায় এ নিয়ে। তার আগেই শুনি তাদের উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরে আমরা নিজেরাই ২৬ তারিখ একটা প্রোগ্রাম দিলাম। কিন্তু সেইটা খুব বড় কিছু না। ইস্টওয়েস্টের ওখানে দিছিলাম। ২৭ তারিখ আমরা ডিসিশন নিতে থাকি যে আসলেই কি করবো। এখন আমাদের আসলে কর্মসূচিগুলো কি রকম হওয়া উচিত। ২৭ তারিখ কোনো কর্মসূচি রাখিনি। ২৮ তারিখে ছোটখাটো একটা কর্মসূচি হইছিল। এই সময়টা আমরা ভার্সিটির শিক্ষকদের যুক্ত করার চেষ্টা করছিলাম। ২৮ তারিখে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে আমরা পরবর্তী তিনদিন কোনো কর্মসূচিতে যাবো না। এটা আমাদের একক (ব্র্যাকের) সিদ্ধান্ত। অন্য প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলো যদি প্রোগ্রাম দেয়, দেবে। আমরা দেবো না। এর কারণ, আমরা যাই করার সিদ্ধান্ত নিই না কেন, সব বাইরে আগেই চলে যাচ্ছিলো। আমরা যা আলোচনাই করি না কেন, পুলিশ জেনে যাচ্ছিল। তখন আমার এক বন্ধু পরামর্শ দেয়, আমরা তাইওয়ানের একটা মুভমেন্টের আদলে মুভ করবো। সেইমতো আমরা ২৮ তারিখ রাতে একটা ডিসকর্ড সার্ভার খুলি। খুবই সতর্কতার সঙ্গে এখানে মেম্বার এড করা শুরু করি। প্রায় ৩০ জনের মতো একটা টিম কাজ করে। যারা মেম্বার হওয়ার জন্য রিকুয়েস্ট দিত, তাদের সমস্ত ডাটা আমরা ক্রসচেক করতাম। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেটাতে সেইটা চেক করতাম। দুই দিনে আমরা প্রায় ৮ হাজার মেম্বার এড করতে পারলাম। আমাদের সমস্ত ইনফরমেশন সিকিউর করলাম। এরপর আমরা আন্দোলনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন পুলিশ কোনোভাবে আমাদের প্রোগ্রাম সম্পর্কে ধারণা করতে পারতো না। কারণ আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক গ্রুপে ভিন্ন তথ্য দিতাম, আর মূল তথ্য পাওয়ার জন্য সার্ভার ফলো করতে বলতাম। যখন কর্মসূচিতে ফিরলাম, তখন অসহযোগ চলছে। আমরা ব্লকেড কর্মসূচি করছি। চার তারিখ বিকালে আমার ভাই এলো, বললো, তুই চল। সে সময়টা বেশ চাপে ছিলাম। ফেরারি, বাসায় তো ফেরা হয় না। এখানে সেখানে থাকি। আমাকে তখন রীতিমতো গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন খুঁজে বেড়াচ্ছে। 

আমাকে না পেয়ে আমার নামের সঙ্গে মিল আছে এমন চারজনকে আটকও করে তারা। হাসিনার পতনের পর ৭ তারিখ যখন সারজিস ভাইয়ের সাথে দেখা হলো, তিনি বলছিলেন যে আমার ছবি তারা ডিবি অফিসে দেখেছিলেন। 

আমাকে ধরার নির্দেশনা ছিল। চার তারিখ সিদ্ধান্ত হলো, মূল কর্মসূচি মানে লং মার্চ টু ঢাকা হবে ৬ তারিখ। কিন্তু সেইটা এগিয়ে নেওয়া হলো। কিন্তু পরদিন বের হতে গিয়ে দেখি সব জায়গায় আর্মি দিয়ে ভর্তি। এগুনোর কোনো উপায় নেই। আস্তে আস্তে খবর আসা শুরু করলো, উত্তরা থেকে বড় মিছিল আসছে, যাত্রাবাড়ী থেকে বড় মিছিল আসছে। সেসব খবর যখন সার্কুলেট হলো, রাস্তার পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করলো। এরপর তো আর্মি চিফ জানালেন, তিনি ভাষণ দেবেন। ততক্ষণে খুনি হাসিনার পতনের খবরও পেয়ে গেছি।

বাসস: নতুন বাংলাদেশে আপনার প্রত্যাশা কী?

ফারাবী জিসান: দেশের মানুষ কিন্তু রাস্তায় নেমেছে একটা ফ্যাসিবাদী শাসন, কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে। দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন একটা দেশ নির্মাণের স্বপ্ন মানুষ দেখতে শুরু করেছে। দেশটাকে নতুন করে গড়ার একটা সময় এসেছে। আমাদের যে পুরোনো রাজনৈতিক কালচার- সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। 

বাংলাদেশি হিসেবে জাতিসত্তার পরিচয় নির্মাণের একটা সময় এসেছে। আমরা আমাদের রাষ্ট্রীয় ইন্সটিটিউশনগুলোকে যদি নতুন করে সাজাতে না পারি, সমাজের ভেতর যদি ফ্যাসিবাদী আলামতগুলো রেখে দেই তাহলে শহীদদের রক্তের সাথে তা হবে বেইমানি। আমরা চাই, সবাই সম্মিলিতভাবে দেশটাকে গড়তে।