বাসস
  ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৫৯
আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ১০:১০

ভাঙা দাঁতের খোঁচা থেকেও হতে পারে মরণব্যাধি ক্যান্সার: ডা. সাখাওয়াৎ হোসেন সায়ন্থ

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) ডেন্টাল অনুষদের ডিন ও ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাখাওয়াৎ হোসেন সায়ন্থ। ছবি : বাসস

বরুন কুমার দাশ ও আব্দুর রউফ 

ঢাকা, ২৭ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : মুখের ভেতরের ভাঙা বা ধারালো দাঁতের ক্ষতকে অনেকেই গুরুত্ব দেন না। জিহ্বা বা গালে বারবার লাগা এই সামান্য খোঁচা বা ক্ষতটিই দীর্ঘদিন রাখলে একসময় তা নীরবে ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে।

এছাড়া তামাক ও অ্যালকোহল জাতীয় দ্রব্যের প্রতি আসক্তি এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নেওয়ার প্রবণতার কারণে দেশে ওরাল (মুখের ভেতরে) ক্যান্সারের ঝুঁকি ও মৃত্যুহার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) ডেন্টাল অনুষদের ডিন ও ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাখাওয়াৎ হোসেন সায়ন্থ বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।

মুখের ক্ষত ও ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মুখে নানা কারণে ক্ষত বা ঘা হতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো ‘অ্যাপথাস আলসার’।

মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, ঘুমের ঘাটতি, হরমোনের পরিবর্তন, ভিটামিন ও মিনারেলের অভাব, ব্রাশের খোঁচা বা খাওয়ার সময় অসাবধানতাবশত গাল বা জিহ্বায় কামড় লাগলে এই ঘা হতে পারে। এটি কষ্টদায়ক হলেও এতে ভয়ের কিছু নেই। এই আলসার সাধারণত ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে কোনো ওষুধ ছাড়াই নিজে থেকেই সেরে যায়। তবে এ সময় সামান্য ব্যথানাশক জেল বা মাউথওয়াশ ব্যবহার করলে স্বস্তি মেলে।’

তবে সব ক্ষত সাধারণ নয় উল্লেখ করে ডা. সাখাওয়াৎ বলেন, ‘কিছু ক্ষত শরীরের অন্য কোনো জটিল রোগের লক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পায়। যেমন, যক্ষ¥া রোগীদের ক্ষেত্রে ‘টিউবারকুলাস আলসার’, সিফিলিস রোগীদের ‘সিফিলিটিক আলসার’ কিংবা হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাসের সংক্রমণে জ্বরঠোসা বা ফোসকা থেকেও মুখে ঘা হতে পারে। এর বাইরে কিছু ক্ষত আছে যাকে ‘প্রি-ম্যালিগন্যান্ট লেসন’ বা ক্যান্সারের পূর্বাবস্থার ক্ষত বলা হয়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে এবং জীবনযাপন পদ্ধতি পরিবর্তন না করলে এগুলো ক্যান্সারে রূপ নেয়। এর মধ্যে লিউকোপ্লাকিয়া (সাদা ঘা), এরিথ্রোপ্লাকিয়া (লালচে ঘা), লাইকেন প্ল্যানাস (এলপি) এবং ওরাল সাবমিউকাস ফাইব্রোসিস (ওএসএমএফ) অন্যতম।’

ওরাল সাবমিউকাস ফাইব্রোসিস (ওএসএমএফ) সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিএমইউ’র এ চিকিৎসক বলেন, ‘ওএসএমএফ-এর প্রধান কারণ হলো সুপারি। আমাদের দেশে অনেকেই পানের সাথে কিংবা শুধু শুধু সুপারি চিবান। যারা দীর্ঘসময় মুখে সুপারি রাখেন বা পান-সুপারি চিবান, তাদের মুখের ভেতরের পাতলা মিউকাস ঝিল্লির নিচের অংশ (সাবমিউকাস) ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে যায়। একসময় এটি টান দেওয়া রশির মতো হয়ে যায় বা অনেকটা অংশ শক্ত হয়ে যায়, যা ফাইব্রোসিস নামে পরিচিত। এতে মুখ হা করতে সমস্যা হয়। 

একইসাথে এটি ক্যান্সারের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া ‘লাইকেন প্যানাস’ নামক অটোইমিউন 
ডিজিজের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস রোগীদের ঝুঁকি অনেক বেশি। কেননা ডায়াবেটিস কন্ট্রোলে না থাকলে এসব ক্ষত নিয়ন্ত্রণ করা আরও জটিল হয়ে পড়ে।’

মুখের ক্যান্সারের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. সাখাওয়াৎ হোসেন সায়ন্থ বলেন, ‘সরাসরি ক্যান্সার বা ‘স্কোয়ামাস সেল কার্সিনোমা’র প্রধান কারণ হলো ধোঁয়াবিহীন তামাক বা চিবিয়ে খাওয়া তামাকজাত দ্রব্য যেমন- গুল, জর্দা, সাদা পাতা ও খৈনি ইত্যাদি। আমাদের দেশে অনেকে পানের সঙ্গে জর্দা, সাদা পাতা খান, আবার অনেকে গুল ব্যবহার করেন, তাদের ক্ষেত্রে ক্যান্সারের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এর পাশাপাশি ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবনও বড় ঝুঁকির কারণ। কেননা, শরীরের এমন কোনো অঙ্গ নেই যেখানে তামাক ক্ষতি করে না। তবে কেউ যদি ধূমপান, অ্যালকোহল ও জর্দা এই একাধিক অভ্যাসে আসক্ত হন, তবে তার এই ঝুঁকি মারাত্মক আকার ধারণ করে। এছাড়া হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি), যা নারীদের জরায়ু ক্যান্সারের জন্য দায়ী, সেটিও মুখের ক্যান্সারের একটি অন্যতম কারণ হতে পারে।’

দাঁতের যত্ন না নেওয়াও ক্যান্সারের কারণ হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেকে মুখের হাইজিন মেইনটেইন করেন না, নিয়মিত দাঁতের যত্ন নেন না, ঠিকমতো ব্রাশ করেন না।

এতে করে দাঁতে ভাঙা বা ধারালো অংশ তৈরি হয়ে সেটি জিহ্বা কিংবা গালের ভেতরে বারবার ঘষা লাগতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে একই জায়গায় বারবার দাঁতের কামড় পড়তে থাকে। এতে ওই স্থানে শক্ত ভাব বা ছোট ক্ষত তৈরি হয়। এই ক্ষত যদি দীর্ঘদিন থাকে, যদি সময়মতো চিকিৎসা না করা হয়, তবে বারবার আঘাতের কারণে এটি একসময় ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। অনেক সময় বাঁধাই করা আলগা দাঁতের কারণে ক্ষত থেকেও মুখের ক্যান্সার হতে পারে। এছাড়া পুষ্টিহীনতা (ম্যালনিউট্রিশন), বিশেষ করে খাবারে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ সবুজ শাক-সবজি ও ফলের অভাব মুখের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।’

মুুখের ঘা কি সাধারণ ক্ষত নাকি ক্যান্সার, এটি বোঝার উপায় কী? জানতে চাইলে ডা. সায়ন্থ বলেন, ‘সব ক্ষতই ক্যান্সারের লক্ষণ নয়। টিউবারকুলোসিস, সিফিলিস, ভাইরাল বা ব্যাকটেরিয়াজনিত নানা কারণে মুখে ক্ষত হতে পারে, যা পরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই শনাক্ত করা যায়। আবার অ্যাপথাস আলসারের মতো অনেক ক্ষত স্বাভাবিকভাবেই এক সপ্তাহের মধ্যে সেরে যায়। তবে কোনো ক্ষত যদি ১০ দিনের বেশি স্থায়ী হয় এবং সাধারণ চিকিৎসায় ভালো না হয়, তবে সেটিকে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই বিডিএস ডিগ্রিধারী একজন নিবন্ধিত ডেন্টাল সার্জন, ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জন বা হেড-নেক (ইএনটি) সার্জনের পরামর্শ নিতে হবে। প্রয়োজন হলে তারা বায়োপসি ও অন্যান্য পরীক্ষা করে দেখবেন ক্ষতটি ক্যান্সারজনিত কি-না। কিন্তু আমাদের দেশে অনেকে মুখের ক্যান্সার নামটি শুনলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। অথচ এটি যদি প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে, তবে সঠিক চিকিৎসায় সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব।’

এ সময় দেরিতে চিকিৎসা নেওয়ার ভয়াবহতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘রোগটি যদি প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে তবে সামান্য সার্জারিতেই রোগী সুস্থ হন। কিন্তু দেরি হলে সার্জারির পাশাপাশি রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপির প্রয়োজন হয়। আর একদম শেষ পর্যায়ে ধরা পড়লে তখন ক্যান্সার গলায় এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। তখন আর অপারেশন করে লাভ হয় না। ক্যান্সারের আকার বড় হলে অপারেশন করে সেই জায়গা ভরাট করতে বুক, হাত বা পা থেকে মাংস ও হাড় এনে মুখে প্রতিস্থাপন করতে হয়। এতে একদিকে যেমন চিকিৎসার খরচ ও হাসপাতালে থাকার সময় বাড়ে, অন্যদিকে রোগীর কষ্ট ও ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করে। অনেক সময় এত চেষ্টার পরেও রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় না।’

আমাদের দেশের চিকিৎসা সেবায় কোনো ঘাটতি রয়েছে কি-না, জানতে চাইলে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমাদের দেশে সঠিক রেফারেল সিস্টেমের (রোগ অনুযায়ী উপযুক্ত ডাক্তারের কাছে পাঠানোর পদ্ধতি) অভাব রয়েছে। রোগীরা প্রথমে সাধারণ চিকিৎসকের কাছে যান, যিনি হয়তো মলম, মাউথওয়াশ কিংবা ভিটামিন দিয়ে চিকিৎসা করেন। এতে দিনের পর দিন মূল্যবান সময় নষ্ট হয়। চিকিৎসকদের উচিত, রোগটি তার এখতিয়ারের বাইরে মনে হলে রোগীকে ধরে না রেখে দ্রুত ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জন বা হেড-নেক সার্জারি বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো। এছাড়া অনেক রোগী ক্যান্সার হলে ভয়ে বা অজ্ঞতাবশত আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথিক অথবা টোটকা চিকিৎসার শরণাপন্ন হন। মনে রাখা দরকার, এসব চিকিৎসায় ক্যান্সার ভালো হয় না, বরং কালক্ষেপণের কারণে রোগী মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।’

ডা. সাখাওয়াত হোসেন সায়ন্থ বলেন, ‘বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী বিএমডিসি’র রেজিস্ট্রেশন এবং বিডিএস ডিগ্রি ছাড়া কেউ ডাক্তার হিসেবে প্র্যাকটিস করতে পারেন না। কিন্তু আইনের প্রয়োগ কম থাকায় অনেক হাতুড়ে ডাক্তার বা কোয়াক ডেন্টিস্ট সাধারণ মানুষকে ভুল চিকিৎসা দিচ্ছেন। তারা অনেক সময় কোনো একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের নাম সাইনবোর্ডে ব্যবহার করে নিজেরা রোগী দেখেন। মানুষ মনে করে দাঁতের চিকিৎসা ব্যয়বহুল, তাই তারা হাতের কাছে কম টাকায় এসব হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে যান। এতে হিতে বিপরীত হয়। ভুল চিকিৎসার কারণে ভালো দাঁত নষ্ট হওয়া থেকে শুরু করে ক্যান্সারের মতো বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হন অনেকে।’

এ সময় মানুষকে সচেতন হবার পরামর্শ দিয়ে বিএমইউ’র এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাদের ধারণা, দাঁতের চিকিৎসা মানেই অনেক ব্যয়বহুল। কিন্তু আর্থিক সমস্যা থাকলে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেন্টাল ফ্যাকাল্টি এবং সরকারি হাসপাতালগুলো যেমন, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেন্টাল বিভাগ কিংবা যে কোন সরকারি মেডিকেল কলেজ বা যেকোনো জেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অত্যন্ত কম খরচে বা বিনামূল্যে অভিজ্ঞ ডেন্টাল সার্জনদের সেবা পাওয়া যায়। এছাড়া প্রতিটি উপজেলা হাসপাতালে এখন ডেন্টাল সার্জন রয়েছে। তাই সামান্য কিছু টাকা বাঁচাতে হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয়। ডাক্তার নির্বাচনের ক্ষেত্রে যিনি চিকিৎসা দিচ্ছেন, তিনি আসলেই বিডিএস ডিগ্রিধারী কিনা, তা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। কেননা ন্যূনতম বিডিএস ডিগ্রী না থাকলে ধরে নেবেন তিনি চিকিৎসক নন।’