শিরোনাম

ঢাকা, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : থাইল্যান্ড ও কাম্বোডিয়ার বিতর্কিত সীমান্ত থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে একটি গ্রামীণ সড়কের চেকপোস্টে দাঁড়িয়ে আছেন নরংচাই পুত্তেত।
নেভিব্লু পোশাকে ৬০ বছর বয়সী এই কৃষক থেকে গ্রাম নিরাপত্তারক্ষীতে পরিণত হওয়া বৃদ্ধের কাঁধে ঝুলছে একটি রাইফেল।
থাইল্যান্ডের উরিরাম থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, যাদেরকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ থাই সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো রক্ষার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে, তিনি তাদের মধ্যে একজন।
টানা এক সপ্তাহ ধরে দুই দেশের মধ্যে চলমান গোলাবর্ষণে অধিকাংশ বাসিন্দাই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত অন্তত ২৭ জন নিহত হয়েছে।
দুই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে, আর ঔপনিবেশিক আমলের এই সীমান্ত বিরোধ থেকেই নতুন করে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটেছে।
এই স্বেচ্ছাসেবকরাই এখন কার্যত নিজ নিজ গ্রামের ‘চোখ ও কান’।
তাদের দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে— খালি বাড়ি ঘরের জিনিসপত্র লুটপাট থেকে রক্ষা করা, গবাদিপশুর দেখাশোনা করা ও গ্রামের প্রবেশপথগুলোতে অবস্থিত চেকপোস্টে পাহারা দেওয়া।
চারদিকে নীরবতা। শুধু শুকনো ধানক্ষেত পেরিয়ে ভেসে আসছে দূরের গোলা ও কামানের গর্জন।
এটি একেবারেই এক ব্যতিক্রমধর্মী সেবা। বিনা পারিশ্রমিকে ও চরম ঝুঁকি নিয়ে এই স্বেচ্ছাসেবকরা গ্রামগুলোকে পাহারা দিয়ে যাচ্ছেন।
নরংচাই এএফপিকে বলেন, ‘আমরা কোনো বেতন বা ভাতা পাই না, তবুও এটা সার্থক।’
তিনি আরও বলেন, ‘অন্তত আমরা আমাদের গ্রামের মানুষদের সাহায্য করতে পারছি, আর আমরা স্বেচ্ছাসেবকের মন থেকেই এটি করে যাচ্ছি।’
উরিরাম প্রদেশের এক গ্রাম প্রধান কমকাই সিহানাম ২০ সদস্যের একটি দল পরিচালনা করছেন। স্বেচ্ছাসেবকদের এই দল প্রায় ৫০০ বাসিন্দার সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে।
শনিবার এএফপিকে বলেন ৫৫ বছর বয়সী গ্রাম প্রধান কমকাই বলেন, ‘আমি কি ভয় পাই? অবশ্যই পাই।’
এই বয়স্ক বাসিন্দা আরও বলেন, ‘তবুও প্রতিবেশীদের জিনিসপত্র দেখাশোনার জন্য কাউকে না কাউকে তো এখানে থাকতেই হবে। আমরা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গেই আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।’
৭ ডিসেম্বর সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে আড়াই লাখের বেশি থাই নাগরিক আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন এবং আরও বহু মানুষকে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
যারা গ্রামে রয়ে গেছেন, তারা দিনে বাংকারে বিশ্রাম নেন এবং রাতে গ্রামে টহল দেন।
এই স্বেচ্ছাসেবকরা প্রতিটি বাড়ি, প্রতিটি খামার চেনেন। কে শূকর পালন করে, কোথায় গরুর খোঁয়াড়— এগুলো সবই তারা জানেন। টহলের সময় তারা গরুকে খাবার দেন এবং কুকুরের জন্য পানি ঢালেন। এ জন্য কুকুরগুলোও তাদের চিনে ফেলেছে। স্বেচ্ছাসেবকরা এলে কুকুরগুলো দৌড়ে এসে তাদের অভ্যর্থনা জানায়।
টহলের ফাঁকে নরংচাই ও কমকাই টিনের ছাউনির নিচে অথবা টায়ার ও বালির বস্তা দিয়ে শক্ত করা নতুন বাংকারে বিশ্রাম নেন।
কমকাই বলেন, ‘কারও কাছে চাল বা সবজি থাকলে, তারা তা স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়। দেশের এই অবস্থায় আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে টিকে আছি।’
গ্রামরক্ষীর দায়িত্ব পালন করতে, তাদেরকে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে। এই প্রশিক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে— জীবনরক্ষা কৌশল, প্রাথমিক চিকিৎসা, অবিস্ফোরিত গোলা শনাক্তকরণ ও শত্রু মোকাবিলার পদ্ধতি।
কমকাই বলেন, ‘তারা আমাদের দেখিয়েছেন যে একটি গুলি কতদূর যেতে পারে, গোলা কোথায় পড়তে পারে এবং বিস্ফোরণ না হলে তখন কী করতে হবে, তাও আমাদের শিখানো হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই জ্ঞান আমাদের আত্মরক্ষার পাশাপাশি অন্যদের রক্ষা করতেও সাহায্য করে।’
এই প্রশিক্ষণে গোলাগুলির মধ্য দিয়ে নিরাপদে চলাচলের কৌশলও শেখানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘সবার নিরাপত্তাই আগে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটাই আমাদের দায়িত্ব, আর যাই হোক, এটাই (গ্রাম) আমাদের বাড়ি।’
গ্রাম থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে বুরিরামের চ্যাং ইন্টারন্যাশনাল সার্কিট রেসকোর্সে স্থাপিত আশ্রয়কেন্দ্রে নরংচাইয়ের স্ত্রী উথাই পুত্তেত খড়ের চাটাইয়ে বসে উদ্বিগ্নভাবে তার স্বামীর খবরের অপেক্ষা করছেন।
ভিডিও কলে তিনি স্বামীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘এখন পরিস্থিতি কেমন? আজ কিছু খেতে পেরেছ?’
গত গ্রীষ্মে সীমান্তে সংঘর্ষের সময়ও প্রথমে নারী, শিশু ও বয়স্কদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। পুরুষরা তখনও তাদের বাড়ি ঘর পাহারা দিতে থেকে যান।
চলতি সপ্তাহের গোলাবর্ষণ নরংচাই ও উথাইকে আলাদা করে রেখেছে এবং প্রতিটি নতুন হামলা তাদের বিচ্ছেদ আরও দীর্ঘ করছে।
৫৩ বছর বয়সী উথাই বলেন, ‘জুলাইয়ে আমাকে প্রায় ১৫ দিন আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে হয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন প্রতিদিনই গোলাগুলি হচ্ছে। মানুষ ভাবছে, আমাদেরকে কি মাসের পর মাস, এমনকি এক বছরও এভাবে থাকতে হবে? এটা খুবই হতাশাজনক একটি পরিস্থিতি।’
আরেক আশ্রয়প্রার্থী নাত্তামন পাওয়াপুতো তার স্বামী ও চাচাতো ভাইয়ের খবরের অপেক্ষায় আছেন। তারা অন্য এক সীমান্ত গ্রামে স্বেচ্ছাসেবক পাহারাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
৫২ বছর বয়সী নাত্তামন বলেন, ‘আমি তাদের জন্য খুবই উদ্বিগ্ন। তাদের চিন্তায় আমি ঠিকমতো ঘুমোতে পারি না।’
তবে তিনি বলেন, ‘তবুও আমি তাদের নিয়ে গর্বিত।’
জুলাইয়ের মতো এবারও নরংচাই ও তার দল ভারী গোলাবর্ষণের মধ্যেই নিজেদের অবস্থানে রয়ে গেছেন।
তিনি জানেন, যুদ্ধবিরতি হলেও স্বস্তি মিলবে না।
নরংচাই বলেন, ‘এটা শেষ হলেও, আমরা সব সময় সতর্ক থাকব।’
তিনি আরও বলেন, ‘শেষবারের সংঘর্ষের পর থেকে বজ্রপাতের শব্দ শুনলেও আমার মনে হয় যেন আবার গোলাবর্ষণ শুরু হয়েছে।’