শিরোনাম

ঢাকা, ৫ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : নিউইয়র্কের নতুন মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক জোহরান মামদানি। তার এই উত্থানকে মার্কিন রাজনীতিতে এক বিস্ময়কর অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
অচেনা এক তরুণের আইনপ্রণেতা থেকে বিশ্বের অন্যতম বড় নগরীর শীর্ষ নেতৃত্বে পৌঁছানোসহ সবকিছুই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
নিউইয়র্ক থেকে এএফপি এ খবর জানিয়েছে।
গত জুনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাথমিক নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত জয়ের পর থেকেই ৩৪ বছর বয়সি মামদানির দাড়িওয়ালা হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিউইয়র্কবাসীর কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। টেলিভিশনে, দেয়ালচিত্রে, এমনকি সমর্থকদের গায়ে ঝোলানো ব্যাজেও তার সেই ছবি দেখা গেছে।
উগান্ডায় জন্ম নেওয়া ভারতীয় বংশোদ্ভূত মামদানি সাত বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এবং ২০১৮ সালে দেশটির নাগরিকত্ব লাভ করেন। তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ার (‘মনসুন ওয়েডিং’, ‘মিসিসিপি মাসালা’) এবং অধ্যাপক ও আফ্রিকা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাহমুদ মামদানির সন্তান। এ কারণেই কেউ কেউ তাকে রসিকতার ছলে ‘নেপো বেবি’ বলেও ডাকেন।
মামদানি ধনী ও প্রগতিশীল পরিবারের অন্যান্য তরুণদের পথেই হেঁটেছেন। পড়াশোনা করেছেন ব্রঙ্কস হাই স্কুল অব সায়েন্স ও বোডউইন কলেজে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দু’টি প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার জন্য পরিচিত।
২০১৫ সালে ‘ইয়াং কার্ডামম’ নামে র্যাপ জগতে প্রবেশ করেন। তার র্যাপে প্রভাব ছিল হিপ-হপ গ্রুপ ‘ডাস রেসিস্ট’-এর। এই গ্রুপটি ভারতের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বা সামাজিক বিষয়গুলো নিয়ে গান করত।
পরে মামদানি পেশাদার সংগীতেও কাজ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পরে নিজেই নিজেকে ‘দ্বিতীয় সারির শিল্পী’ আখ্যা দিয়ে রাজনীতিতে মন দেন।
জানা যায়, হিমাংশু সুরি (হিমস) নামের আরেক র্যাপার যখন এক প্রার্থীকে সমর্থন দেন, তখন তিনি রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এমনকি সেই প্রার্থীর প্রচারেও অংশ নেন।
এরপর তিনি ফোরক্লোজার প্রিভেনশন কাউন্সেলর হিসেবে কাজ করেন। অর্থাৎ ঋণগ্রস্থ বাড়িওয়ালাদের তাদের বাড়ি হারানো থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করতেন।
তিনি ২০১৮ সালে কুইন্স থেকে আইনপ্রণেতা নির্বাচিত হন। অঙ্গরাজ্যটিতে প্রধানত দরিদ্র ও অভিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন বেশি বাস করে। নিউ ইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলিতে ওই এলাকার প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি।
নিজেকে সমাজতান্ত্রিক দাবি করা এই নেতা তিনবার কুইন্স থেকে নিউ ইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলিতে আইনপ্রণেতা হিসেবে নির্বাচিত হন। গড়ে তুলেছেন এক প্রগতিশীল, মুসলিম, বৈচিত্র্যপোষক রাজনীতিকের ভাবমূর্তি। তিনি যেমন প্রাইড মার্চে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, তেমনি ঈদ উৎসবেও সমানভাবে উপস্থিত থাকেন।
জনগণের শহর গড়ার অঙ্গীকার
জোহরান মামদানির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে ছিল সবার জন্য সাশ্রয়ী শহর গড়া। বিশেষত ধনী শ্রেণির বাইরে থাকা সাধারণ মানুষের জন্য তিনি এমন শহর গড়তে চান।
বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ, বিনামূল্যে ডে-কেয়ার ও বাস চলাচল সেবা এবং প্রতিটি এলাকায় সরকার পরিচালিত মুদি দোকান চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মামদানি।
দীর্ঘদিন থেকেই তিনি ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছেন। অন্যদিকে ইসরাইলকে ‘বর্ণবাদী শাসনব্যবস্থা’ ও গাজা যুদ্ধকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দেওয়ায় ইহুদি সম্প্রদায়ের একাংশের অসন্তোষের মুখে পড়েন।
গত কয়েক মাসে তিনি প্রকাশ্যে ইহুদী বিদ্বেষ এবং ইসলামবিরোধী বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, উভয়েরই প্রকাশ্যে নিন্দা জানিয়েছেন।
জাতিগত ইস্যু সামনে এনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মঙ্গলবার নিউইয়র্কে ভোট চলাকালে মামদানিকে ‘একজন স্বঘোষিত ও প্রমাণিত ইহুদি-বিদ্বেষী’ বলে আখ্যা দেন। তিনি তাকে ‘ছোট কমিউনিস্ট’ বলেও কটাক্ষ করেন।’
‘অসন্তুষ্ট ভোটারদের প্রতিনিধি’
নর্থইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কস্টাস প্যানাগোপুলোস বলেন, মামদানি প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার একধরনের ‘আউটসাইডার’।
তিনি আরও বলেন, ‘মামদানি এমন ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পেরেছেন যারা প্রচলিত রাজনীতি ও প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বে ক্লান্ত। তিনি এমন এক প্রতীকে পরিণত হয়েছেন, যিনি সাধারণ নাগরিকের বাস্তব চাহিদা নিয়ে কথা বলেন।’
রাজনীতিতে আধুনিক প্রচারণা
ফুটবল ও ক্রিকেটপ্রেমী মামদানি সম্প্রতি মার্কিন চিত্রশিল্পী রামা দুয়াজিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। নির্বাচনী প্রচারে তিনি তার রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতাকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
মাঠ পর্যায়ের সুসংগঠিত প্রচারণা, লিফলেট বিতরণ, আবার কখনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাস্যরসাত্মক প্রচার সবই দক্ষভাবে ব্যবহার করেছেন তিনি।
মামদানি ১৯৭০-এর দশকের প্রচারণার ধারা ও ২০২৫ সালের আধুনিক কৌশল দুটোকেই চমৎকারভাবে মিশিয়ে এক নতুন ধারা তৈরি করেছেন বলে মন্তব্য করেন কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক লিংকন মিচেল।
এভাবেই নিউইয়র্কের মেয়র পদে তার বিজয় প্রমাণ করেছে রাজনীতি যখন জনগণের হাতে ফিরে আসে, তখন ইতিহাসও নতুনভাবে লেখা হয়।