শিরোনাম
ঢাকা, ১০ জুন, ২০২৫ (বাসস) : মহাসাগরের যে বিশাল জলসীমা কোনো দেশেরই মালিকানার আওতায় পড়ে না। সেখানকার জীববৈচিত্র্য ও সম্পদ রক্ষায় জাতিসংঘের ‘উন্মুক্ত সমুদ্র চুক্তি’ এ বছরের শেষে আইনে পরিণত হতে পারে।
এটি উন্মুক্ত সমুদ্রের পরিবেশ সুরক্ষায় এক নতুন দিগন্ত খুলে দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘ সদর দপ্তর থেকে এএফপি জানায়, জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো ২০২৩ সালের জুন মাসে এই চুক্তিটি গ্রহণ করে। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ৪৯টি দেশ এতে সই করেছে। চুক্তিটি তখনই পুরোপুরি কার্যকর হবে, যখন মোট ৬০টি দেশ এতে সই করবে এবং তার ১২০ দিন পর থেকে এটি আইনে পরিণত হবে।
তবে, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- জো বাইডেন সরকার ২০২৩ সালে চুক্তিটিতে সই করলেও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে এটি চূড়ান্ত অনুমোদন পাবে বলে মনে হচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক জলরাশি: কার অধীনে কতটুকু?
বিশ্বের মহাসাগরগুলোর ৬০ শতাংশেরও বেশি এলাকা কোনো একক দেশের অধীনে নয়। সেই বিশাল আন্তর্জাতিক জলরাশিকে সুরক্ষা দিতেই এই চুক্তিটি করা হচ্ছে।
সহজ কথায়, কোনো দেশের উপকূল থেকে প্রায় ৩৭০.৪ কিলোমিটার (২০০ নটিক্যাল মাইল) দূরের বিশাল সমুদ্র এলাকাকে ঐ দেশের একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল (প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, মাছ ধরা, খনিজ উত্তোলন, বাণিজ্যিক কাজ) বলা হয়। এই সীমার বাইরের ঐ বিশাল সমুদ্র অঞ্চলই এই চুক্তির আওতায় পড়বে।
বিশেষভাবে, এই চুক্তির আওতায় আছে ‘দ্য এরিয়া’ নামে পরিচিত সমুদ্রের গভীরে থাকা সমুদ্রতল এবং মাটির নিচের অংশ। এটি সেই বিশাল এলাকা যা কোনো দেশের নিজস্ব সীমানার বাইরে অবস্থিত। পৃথিবীর মোট সমুদ্রতলের অর্ধেকেরও বেশি অংশ এই ‘এরিয়া’র মধ্যে পড়ে।
চুক্তিটি কার্যকর হওয়ার পর ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস’ (কপ) নামে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কমিটি গঠিত হবে। এই কমিটি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে মিলে সমুদ্রের বিভিন্ন দিক দেখাশোনা করবে।
সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে আঞ্চলিক মৎস্য সংস্থা ও ‘আন্তর্জাতিক সমুদ্রতল কর্তৃপক্ষ’। বর্তমানে এই কর্তৃপক্ষের মধ্যেই গভীর সমুদ্রের খনিজ সম্পদ উত্তোলনের নিয়মকানুন নিয়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে আলোচনা ও বিতর্ক চলছে।
এদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আন্তর্জাতিক সমুদ্রের গভীরে খনিজ সম্পদ আহরণের অনুমতি দিয়েছেন। এর ফলে নতুন এক প্রশ্ন উঠেছে: তিনি কি এমনটা করতে পারেন? কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ‘আন্তর্জাতিক সমুদ্রতল কর্তৃপক্ষ’-এর সদস্য নয়, আর এই কর্তৃপক্ষই এসব নিয়মকানুন দেখে।
সামুদ্রিক সুরক্ষিত এলাকা: উন্মুক্ত সমুদ্রেরও দরকার সুরক্ষা
বর্তমানে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বেশিরভাগ সংরক্ষিত সামুদ্রিক এলাকা দেশগুলোর নিজস্ব জলসীমার মধ্যেই আছে। তবে, এই চুক্তিটি মহাসাগরগুলোর আন্তর্জাতিক জলসীমাতেও এমন সুরক্ষিত এলাকা তৈরির সুযোগ করে দেবে।
সাধারণত, এই সুরক্ষিত এলাকা তৈরির বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত ‘কপ’-এর সদস্যদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নেওয়া হবে। কিন্তু কোনো একটি দেশ যদি বিরোধিতা করে অচলাবস্থা তৈরি করতে চায়, তাহলে তিন-চতুর্থাংশ সদস্যের ভোটের মাধ্যমেও নতুন সংরক্ষিত এলাকা তৈরি করা যাবে।
চুক্তিটির একটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো এর কোথাও বলা নেই, এত বিশাল ও দূরবর্তী সমুদ্র এলাকায় এসব সুরক্ষা ব্যবস্থার নজরদারি ও বাস্তবায়ন কীভাবে হবে। ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ’ বা কপ-এর ওপর এই দায়িত্ব পড়বে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বেআইনি কাজগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব হতে পারে।
আবার, আন্তর্জাতিক সমুদ্রে প্রত্যেক দেশ নিজের অধীনে থাকা, অর্থাৎ তাদের পতাকা বহনকারী জাহাজের সকল কাজের জন্য দায়ী।
সম্পদের ভাগাভাগি: ধনী-গরিবের সমতা
উন্মুক্ত সমুদ্রে বিভিন্ন দেশ ও তাদের সংস্থাগুলো প্রাণী, উদ্ভিদ বা অণুজীব সংগ্রহ করতে পারবে, যার জেনেটিক উপাদান বাণিজ্যিকভাবে মূল্যবান হতে পারে।
যেমন, বিজ্ঞানীরা সমুদ্রের ক্ষুদ্র জীব, স্পঞ্জ বা সামুদ্রিক শামুক থেকে এমন অণু পেয়েছেন যা ক্যান্সার বা অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় কাজে লাগতে পারে।
এই মূল্যবান সম্পদের সুবিধা ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে কীভাবে ভাগ হবে, তা ছিল চুক্তির একটি বড় বিতর্কিত বিষয়।
চুক্তিতে বলা হয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো যেন সহজে সামুদ্রিক গবেষণার প্রযুক্তি পায়, সে ব্যবস্থা করা হবে। তাদের গবেষণার সক্ষমতাও বাড়ানো হবে। পাশাপাশি, গবেষণার তথ্য সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
তবে কোন পদ্ধতিতে এই লাভের টাকা ভাগ হবে, তা ঠিক করবে ‘কপ’। ওই সামুদ্রিক জীব বা জৈব বস্তু থেকে বানানো কোন পণ্য বিক্রি হলে তার লাভের অংশ ভাগ করা হবে বা অন্য সাধারণ কোনো অর্থনৈতিক পদ্ধতি অনুসরণ করে টাকা ভাগ করার নিয়ম করা হতে পারে।
পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা: ক্ষতির আগে সতর্কবার্তা
চুক্তিটিতে সই করা দেশগুলোকে কোনো কাজ শুরু করার আগে তার সামুদ্রিক পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করতে হবে। বিশেষ করে যদি সেই কাজের ফলে পরিবেশের সামান্য বা ক্ষণস্থায়ী প্রভাবের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
চুক্তিতে আরো বলা হয়েছে, নিজ দেশের জলসীমার মধ্যে যেসব কাজ করা হবে, সেগুলো আন্তর্জাতিক সাগরের পরিবেশে বড় ধরনের দূষণ বা ক্ষতি করতে পারে কিনা তা আগে যাচাই করে নিতে হবে।
শেষ পর্যন্ত, কোনো সম্ভাব্য ক্ষতিকর কাজে সবুজ সংকেত দেওয়ার দায় রাষ্ট্রগুলোর ওপরই বর্তাবে। যদিও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো চেয়েছিল এসব বিষয়ে অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা ‘কপ’-এর হাতে থাকুক, যাতে বিতর্কিত কাজগুলো অনুমোদন পাওয়া আরো কঠিন হয়।
চুক্তি অনুযায়ী, দেশগুলোকে তাদের কার্যকলাপের পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে নিয়মিত তথ্য প্রকাশ করতে হবে। যদি অপ্রত্যাশিত কোনো ক্ষতি দেখা দেয়, তবে সেই কাজের অনুমতি বাতিলও করতে হতে পারে।
চুক্তিতে সোজাসাপটা বলা না থাকলেও, জাহাজ চলাচল, মাছ ধরা, গভীর সমুদ্র থেকে খনিজ সম্পদ আহরণ বা জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর জন্য বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহারের মতো বিতর্কিত কাজগুলোও নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে।