শিরোনাম
ঢাকা, ২৮ মে, ২০২৫ (বাসস) : ভাবুন তো, ৫ হাজার বছর আগের একটা রুটির টুকরো! কেউ একজন সেটি সেঁকে মাটির নিচে পুঁতে রেখেছিল তার নতুন ঘর বানানোর সময়। কেন পুঁতেছিল, তার সঠিক কারণ জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ভালোবাসা, পূর্ণতা বা সমৃদ্ধির কোনো রীতির অংশ ছিল সেটি।
সময়ের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া ব্রোঞ্জ যুগের সেই রুটির টুকরো আলোর মুখ দেখেছে তুরস্কের মধ্যাঞ্চলের এস্কিশেহির শহরের কাছে খননকাজের সময়। পরে উদ্ধার হওয়া ঐতিহাসিক রুটির টুকরাটি রাখা হয় স্থানীয় জাদুঘরে।
কিন্তু ঘটনা সেখানেই থেমে থাকেনি। প্রত্নতত্ত্ববিদদের সহায়তায় তুরস্কের শহরের এক বেকারিতে আবার বানানো হচ্ছে সেই রুটি, হুবহু সেই পুরনো উপাদান ও পুরনো পদ্ধতিতেই।
প্রাচীন সেই রুটির স্বাদ নিতে, প্রতিদিনই বেকারির সামনে ভিড় করছেন অনেকে। ইতিহাসের আকর্ষণ, কৌতূহলের টানে, কিংবা হয়তো নিছকই এক নতুন স্বাদের খোঁজে।
বিস্ময়কর আবিষ্কার ও ইতিহাসের ছোঁয়া
প্রায় ১২ সেন্টিমিটার ব্যাসবিশিষ্ট, গোল এবং প্যানকেকের মতো চ্যাপ্টা রুটি টুকরাটি পাওয়া যায় কুল্লুওবা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে।
‘এটি খননে উদ্ধার হওয়া প্রাচীনতম রুটি এবং বিস্ময়করভাবে এটি গঠন অনেকাংশেই অক্ষত রয়েছে,’ বলেন প্রত্নতত্ত্ববিদ ও খনন প্রকল্পের পরিচালক মুরাত তুর্কতেকি।
তিনি আরো বলেন, ‘রুটি সাধারণত খননে পাওয়া যায় না। কিন্তু এটি সংরক্ষিত ছিল, কারণ এটি পুড়িয়ে পুঁতে রাখা হয়েছিল।’
প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, রুটিটি তৈরি করা হয়েছিল প্রাচীন ‘এমার গম’ ও ডাল দিয়ে। খামির জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল অজ্ঞাত উদ্ভিদের পাতা।
ধারণা করা হচ্ছে, বাড়ি নির্মাণের আগে ঐ রুটি জ্বালিয়ে পুঁতে রাখা হয়েছিল ‘সমৃদ্ধির প্রতীকী রীতি’ হিসেবে।
আধুনিক প্রজন্মের জন্য প্রাচীন স্বাদ: ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রুটিটি আবিষ্কারের পর এস্কিশেহির প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে রাখা হয়।
এস্কিশেহির শহরের মেয়র আয়শে উনলুজে বলেন, ‘এই আবিষ্কারে আমরা আবেগাপ্লুত হয়েছিলাম। তখন খনন পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে রুটিটি আবারও তৈরি করা যায় কি না তা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করি।’
তবে প্রাচীন এমার গম এখন আর তুরস্কে পাওয়া যায় না। তাই এর কাছাকাছি জাত ‘কাভিলজা গম’, ডাল ও বুলগুর ব্যবহার করে মূল রেসিপি অনুসারে রুটি তৈরির উদ্যোগ নেয় শহর প্রশাসন। বুলগুর হচ্ছে সেদ্ধ করে শুকানো গমের দানা।
সরকারি মালিকানাধীন হাল্ক একমেক বেকারিতে প্রতিদিন হাতে তৈরি করা হচ্ছে ৩শটি ‘কুল্লুওবা রুটি’। ৩শ গ্রামের এই রুটি বাজারে ৫০ তুর্কি লিরায় (প্রায় ১.২৮ মার্কিন ডলার) বিক্রি হচ্ছে।
সুজান কুরু নামে এক ক্রেতা বলেন, ‘আমি দ্রুত চলে এসেছি, ভাবছিলাম নাও থাকতে পারে। প্রাচীন এই রুটির স্বাদ জানার আগ্রহ ছিল খুব।’
প্রাচীন শস্য ও আধুনিক শিক্ষা: কুল্লুওবা সভ্যতা সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো লিখিত রেকর্ড না থাকায় সেটি আজও রহস্যাবৃত। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ সালের আশেপাশে আনাতোলিয়ার হাত্তিয়ান জনগোষ্ঠী এস্কিশেহির অঞ্চলে বসবাস করত।
আধুনিক গবেষকরা বলছেন, কুল্লুওবা ছিল একটি মাঝারি আকারের নগর এলাকা, যেখানে ব্যবসা, কারুশিল্প, কৃষি ও খনিজ খননের মতো কার্যক্রম চলত।
এই রুটি আবিষ্কারের ফলে প্রাচীন খরারোধী গম চাষ নিয়ে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
মেয়র উনলুজে বলেন, ‘জলবায়ু সংকটের মুখেও আমরা কর্ন ও সূর্যমুখীর মতো প্রচুর পানিনির্ভর ফসল চাষ করছি। অথচ আমাদের পূর্বপুরুষরা শিক্ষণীয় অনেক কিছু রেখে গেছেন। এখন আমরাও তাদের মত করে কম পানিপ্রবণ ফসলের দিকে ঝুঁকতে পারি।’
স্থানীয় প্রশাসনও খরা ও রোগ প্রতিরোধক কাভিলজা গমের চাষ ফের চালু করতে আগ্রহী হচ্ছে। এই রুটি বর্তমানে শুধু খাবার নয়, হয়ে উঠেছে অতীত-বর্তমানের সেতুবন্ধ, যেখানে পুরনো এক শস্যদানার গল্প শোনাচ্ছে টিকে থাকার শিক্ষার।