শিরোনাম
ঢাকা, ৯ মে, ২০২৫ (বাসস) : সূর্য একটু বেশিই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরার আকাশে, যখন কান চলচ্চিত্র উৎসব শুরুর সময় ঘনিয়ে আসে। উৎসবের লালগালিচায় পা ফেলেন বিশ্বের নামি-দামি তারকারা। ক্যামেরার আলোয় ঝলমলে হয়ে ওঠে ভূমধ্যসাগরের তীর। সমুদ্রের ঢেউ আর সিনেমার দৃশ্য মিলেমিশে সৃষ্টি করে অনন্য এক জাদুর। যেখানে সেলুলয়েডের গল্পরা শুধু দেখা যায় না, অনুভবও করা যায়। কান তখন আর শুধু উৎসব থাকে না। হয়ে ওঠে শিল্প, সৌন্দর্য আর স্বপ্নের মিলনমেলা।
আগামী ১৩ মে, মঙ্গলবার ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরার নীল সমুদ্রের পাড়ে বসছে রঙিন সেই মহাযজ্ঞ-কান উৎসব-২০২৫। তবে, লাল গালিচা, ক্যামেরার ঝলকানি আর গ্ল্যামার ছাপিয়ে এবার আলোচনায় রাজনীতি, সামাজিক আন্দোলন, যুদ্ধ আর নারীর কণ্ঠস্বর। বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাসম্পন্ন এই উৎসব চলবে ২৪ মে পর্যন্ত।
প্যারিস থেকে এএফপি এই খবর জানায়।
উৎসবে গাজার শহীদ ফটোসাংবাদিক ফাতিমা হাসুনার জীবনের গল্প স্ক্রিনে উঠে আসবে। তখন হয়ত রেড কার্পেটে হাঁটবেন টম ক্রুজ, ডি নিরো বা জেনিফার লরেন্স। হলিউডের ঝলক যখন চোখ ধাঁধিয়ে দেবে, তখনই ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার ভিন্ন আলোচনায় মত্ত হবে উৎসবের আঙিনা। তাই এবারের গল্পটা গভীর ও জটিল, তবে প্রাসঙ্গিক।
প্রথম দিনেই মি টুর ছায়া :
উৎসবের প্রথম দিনেই আলোচনার কেন্দ্রে থাকবেন ফরাসি কিংবদন্তি জেরার দেপারদ্যু। তবে তা ভিন্ন কারণে। ‘সিরানো দ্য বের্জেরাক’ খ্যাত এই অভিনেতা তিন বছর ধরে কোনো সিনেমায় অভিনয় করেননি। কিন্তু, তার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের দু’টি মামলা চলমান। একটির রায় ঘোষণা হতে পারে উৎসবের দিনেই।
ট্রাম্পের শুল্ক আর সিনেমার ভবিষ্যৎ:
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, বিদেশে নির্মিত ছবির ওপর শতভাগ শুল্ক আরোপ করা হবে। এই সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র জগতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি শুধু মার্কিন শিল্পীদের নয়, ইউরোপের নির্মাতাদেরও নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।
তারকাদের পদচারণা, তারকাদের প্রতিবাদ:
মিশন ইম্পেসিবলের শেষ পর্ব নিয়ে উৎসবে হাজির হবেন টম ক্রুজ। অন্যদিকে রবার্ট ডি নিরো পাচ্ছেন সম্মানসূচক স্বর্ণপাম। উৎসবের উদ্বোধনী দিনেই পুরস্কারটি তুলে দেওয়া হবে। ক্রুজ বরাবরই রাজনীতি এড়িয়ে চলেন। আর নিরো ট্রাম্প বিরোধী বক্তব্যে বরাবরই স্পষ্ট। তাদের সঙ্গে দেখা পাওয়া যাবে জোয়াকিন ফিনিক্স, ডেনজেল ওয়াশিংটন, এমা স্টোন, জেনিফার লরেন্সের মতো বড় তারকাদেরও। বিচারক হিসেবে থাকবেন জেরেমি স্ট্রং ও হ্যালি বেরি।
পরিচালকের আসনে তারকারা:
এবার পরিচালনায় অভিষেক হয়েছে স্কারলেট জোহানসন ও ক্রিস্টেন স্টুয়ার্টের। স্কারলেটের মুভির নাম ‘ইলেনর দ্যা গ্রেট’ এবং ‘স্টুয়ার্টের দ্যা ক্রোনোলজি অব ওয়াটার’। সঙ্গে তরুণ নির্মাতা হ্যারিস ডিকিনসনের ‘আর্চিন’ ছবিটিও প্রদর্শন করা হবে।
গাজার গল্প, পর্দায় কান্না:
কান উৎসবে অন্যতম আলোচিত ছবি ‘পুট ইউর সেল অন ইউর হ্যান্ড এন্ড ওয়াক’। গাজার ফটোসাংবাদিক ফাতিমা হাসুনাকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছেন ইরানি পরিচালক সেপিদেহ ফারসি। এটি উৎসবের জন্য নির্বাচিত হওয়ার একদিন পরই ইসরাইলি হামলায় প্রাণ হারান ফাতিমা।
এছাড়া ফিলিস্তিনি পরিচালক যমজ ভাই তারজান ও আরাব নাসের তাদের নতুন ছবি ‘ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন গাজা’ নিয়ে হাজির হবেন। যেখানে চিত্রিত হয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় ঘটে যাওয়া এক হত্যা ও বন্ধুত্বের মর্মস্পর্শী গল্প।
প্রতিযোগী কারা?
২০২৫ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘স্বর্নপাম’ বা ‘পাম ডি অর’ জিততে জয়ের লড়াইয়ে করবে ২০টিরও বেশি চলচ্চিত্র। তালিকায় কানের পুরনো চেনা নির্মাতারাদের পাশাপাশি দেখা যাবে নতুন প্রজন্মের সাহসী নির্মাতাদেরও।
দারদেন ভ্রাতৃদ্বয়ের ‘ইয়াং মাদারস’:
উৎসবের পুরনো ও প্রিয় মুখ জ্যাঁ পিয়ের ও লুক দারদেন। তারা দু’বার জিতেছেন স্বর্নপাম। এবার ফিরছেন নতুন ছবি ‘ইয়াং মাদারস’ নিয়ে। চলচ্চিত্রটি বেলজিয়ামের একটি প্রসূতি নিবাসে থাকা পাঁচ তরুণীর গল্প নিয়ে।
মাতৃত্ব ও অতীত মহামারির ছায়া:
এবার প্রতিযোগিতা বিভাগে ‘মাতৃত’¡ মূল থিম হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে আশির দশকের এইডস মহামারি নিয়ে দু’টি ছবি ‘আলফা’ ও ‘রোমেরিয়া’।
ব্রিটিশ তারকা জোশ ও’কনর দ্বৈত চরিত্রে :
ব্রিটিশ অভিনেতা জোশ ও’কনর এবার প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া দু’টি ছবির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সেগুলো হলো, ‘দ্য হিস্ট্রি অব সাউন্ড’ এবং ‘দ্য মাস্টারমাইন্ড’।
ইরানি নির্মাতারা, সেন্সর আর সাহস :
দুই ইরানি নির্মাতা জাফর পানাহি ও সাঈদ রুস্তাই উৎসবে ফিরছেন নতুন ছবি নিয়ে। পানাহির সিনেমার নাম ‘এ সিম্পল একসিডেন্ট’ এবং রুস্তাইয়ের ‘মাদার এন্ড চাইল্ড’। দুই নির্মাতাকেই নিজ দেশের কারাদণ্ড ও নিষেধাজ্ঞা পেরিয়ে আসতে হয়েছে। ফলে তাদের ছবি এবার শুধু কান নয়, দেখবে ইরান সরকারও।
কান মানেই শুধু আলো আর সাজ নয়। এটি সেই মঞ্চ, যেখানে কখনো উঠে আসে প্রতিবাদ, রাজনীতি আর বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্পও। এই বছরও তার ব্যতিক্রম নয়। একদিকে লাল গালিচায় হাঁটা তারকাদের গ্ল্যামার আর সৌন্দর্যে চোখ জ্বলজ্বল করবে। অন্যদিকে চোখ ছলছল করে উঠবে ফাতিমা-তারজান-নাসেরদের গল্পে। এবারের কান তাই শুধু দেখার নয়, বোঝারও। সময় এলে, বলারও।