বাসস
  ০১ মে ২০২৫, ১৩:১৪
আপডেট : ০১ মে ২০২৫, ১৪:২৬

যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন খনিজ চুক্তি : প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্য

ঢাকা, ১ মে, ২০২৫ (বাসস) : যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন একটি ঐতিহাসিক খনিজ চুক্তি সই করেছে, যা ইউক্রেনের বিরল খনিজ সম্পদে বড় ধরনের মার্কিন বিনিয়োগ আনবে। চুক্তিটি এমন এক সময়ে স্বাক্ষরিত হলো, যখন ইউক্রেন রাশিয়ার আক্রমণের পর একদিকে যুদ্ধের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে দেশটির অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক সহযোগিতা ও বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, চুক্তি সইয়ের পরেও ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি যুক্ত হয়নি, যা এই চুক্তির বিশেষ তাৎপর্য ও সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করে।

চুক্তির প্রেক্ষাপট

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার আক্রমণ ইউক্রেনকে একটি বিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দেয়। যুদ্ধের ফলে ইউক্রেনের অবকাঠামো, অর্থনীতি ও জনজীবন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রথম দিকে, ইউক্রেনের জন্য মার্কিন সামরিক সহায়তা ছিল প্রধানত যুদ্ধে টিকে থাকার মূল শক্তি। তবে, যুদ্ধের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ইউক্রেনের নেতৃত্বকে এমন একটি কৌশল অবলম্বন করতে উৎসাহিত করেছে, যা শুধুমাত্র সামরিক সহায়তার উপর নির্ভর না করে, দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদ ও খনিজসম্পদের মাধ্যমে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন করতে সক্ষম হবে।

এ প্রেক্ষাপটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেনের জন্য একটি চুক্তি প্রস্তাব করেন, যার মাধ্যমে ইউক্রেনকে ৫০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণের দাবি জানান। ট্রাম্পের দাবি ছিল, তার পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সময় ইউক্রেনকে দেওয়া ১২০ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা পুনরুদ্ধার করা। তবে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এই শর্ত প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ তিনি মনে করেন, এ ধরনের চুক্তি ইউক্রেনের ওপর দশ প্রজন্মের জন্য ঋণের বোঝা চাপাতে পারে। দীর্ঘ আলোচনা ও দ্বন্দ্বের পর, দুই পক্ষ একটি নতুন ধরনের চুক্তিতে পৌঁছায়, যা ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের ওপর বড় ধরনের মার্কিন বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করে।

চুক্তির মূল বৈশিষ্ট্য

এই চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো 'যৌথ পুনর্গঠন বিনিয়োগ তহবিল'। এই তহবিলের মাধ্যমে উভয় দেশ সমানভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে এবং এর লাভ শুধুমাত্র ইউক্রেনের উন্নয়ন ও পুনর্গঠনে বিনিয়োগ করা হবে। ইউক্রেন কোনো ধরনের ঋণ ফেরত দিতে বাধ্য হবে না, যা এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সুবিধা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

চুক্তির আওতায় ইউক্রেনের খনিজ, তেল, গ্যাস এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ ক্ষেত্রগুলোর উন্নয়নে মার্কিন বিনিয়োগ হবে। প্রথম ১০ বছর শুধুমাত্র এই খাতগুলোর উন্নয়ন ও প্রক্রিয়াকরণের জন্য অর্থ বিনিয়োগ করা হবে, যার পর লাভের একটি অংশ দুই দেশ ভাগ করে নেবে। ইউক্রেনের অর্থমন্ত্রী ইউলিয়া শভিরিদেঙ্কো জানিয়েছেন, এই চুক্তি ইউক্রেনের প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন ক্ষেত্রের উন্নয়নে সহায়ক হবে, কারণ এতে প্রযুক্তি স্থানান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে থাকবে।

ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

ইউক্রেন পৃথিবীর বিরল খনিজ সম্পদের এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে পরিচিত। দেশটির খনিজ সম্পদের মধ্যে গ্রাফাইট, ম্যানগানিজ, টাইটানিয়াম, তামা, কোবাল্ট ও লিথিয়ামের বিশাল মজুদ রয়েছে। বিশেষ করে, ইউক্রেনের ২০ শতাংশ গ্রাফাইটের মজুদ ও বৃহত্তম লিথিয়াম মজুদ, যা বৈদ্যুতিক ব্যাটারি তৈরির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,
ইউক্রেনেই রয়েছে। তবে, এসব খনিজ সম্পদের বেশিরভাগ এখন রাশিয়া-অধিকৃত অঞ্চলে অবস্থিত, যা ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বড় বাধা হবে।

চুক্তির নিরাপত্তা বিষয়ক দিক

ইউক্রেন বারবার জানিয়েছে যে কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার প্রয়োজন। তবে, এই চুক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো ধরনের নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি দেয়নি, যা ইউক্রেনের জন্য একটি বড় হতাশার বিষয়। চুক্তির একমাত্র নিরাপত্তা সম্পর্কিত শর্তে বলা হয়েছে, 'যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়ার প্রয়াস চালাবে'। তবে এটি কোনো শক্তিশালী প্রতিশ্রুতি নয়। এর ফলে, ইউক্রেনের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা সুরক্ষিত থাকার বিষয়টি এখনো অনিশ্চিত রয়ে গেছে।

মার্কিন অর্থনৈতিক আগ্রহ ও বিশ্বরাজনীতিতে এর প্রভাব

এই চুক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি নতুন অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ খুলে দিয়েছে। ট্রেজারি বিভাগের এক বিবৃতিতে, রাশিয়ার আক্রমণকে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন হিসেবে উল্লেখ করে ইউক্রেনের জন্য মার্কিন অর্থনৈতিক আগ্রহ ও সমর্থন প্রকাশ করা হয়েছে। এ চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের কাছে এক ধরনের বার্তা, যা রাশিয়ার সঙ্গে চলমান সংঘাতের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ও রাজনৈতিক প্রভাব আরও দৃঢ় করবে।

চুক্তির তাৎপর্য

এই চুক্তি ইউক্রেনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সুযোগ, কারণ এটি দেশের খনিজ সম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জনের একটি পথ তৈরি করবে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও একটি বড় লাভের সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে, কারণ খনিজ সম্পদ থেকে লাভ এবং নতুন প্রযুক্তির স্থানান্তর তাদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হতে পারে।

অন্যদিকে, ইউক্রেনের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, কারণ যুদ্ধের ক্ষতির পর দেশের পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করা অত্যন্ত জরুরি। যদিও নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি ছাড়া এই চুক্তি ইউক্রেনের জন্য একটি সীমাবদ্ধ পদক্ষেপ হতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি দেশটির অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং ভবিষ্যতের উন্নয়নের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করতে পারে।