বাসস
  ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১৭:২৫
আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১৭:২৯

নারী ফুটবলে অবদান রাখতে চায় দিনাজপুরে নওশিন প্রমিলা ফুটবল একাডেমি

দিনাজপুর, ১৬ নভেম্বর ২০২৫ (বাসস) : দিনাজপুর শহরে ক্রীড়া পল্লীর সামনে বড় মাঠে অনূর্ধ্ব-১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী নারী খেলোয়াড়রা নিয়মিত ফুটবল প্রশিক্ষণে অংশ নেয়।

আর এই প্রশিক্ষনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে চলেছে কোচ নুর ইসলামের নওশীন ফুটবল একাডেমি।

এই একাডেমি থেকে ইতোমধ্যেই বয়সভিত্তিক দল পেরিয়ে জাতীয় দলেও খেলার সুযোগ পেয়েছে মেয়েরা। 

একাডেমির সাথে সংশ্লিষ্ট সকলেরই একটাই চাওয়া, প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তারা অনেকদুর এগিয়ে যেতে পারবে। 

প্রতিদিন সকালে অনেকেই যখন ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে, নারী ফুটবলার তন্বী, তনিমা, জয়ন্তী, কাকলীরা তখন মাঠে ফুটবল প্রশিক্ষণ নিতে হাজির হয়ে যায়। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে তাদের বাসা থেকে দুই কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে দিনাজপুর গোর-এ শহীদ বড় মাঠে অনুশীলনে যমজ দুই বোন তন্বী ও তনিমা আসেন। 

এরপর একে একে মাঠে আসে তাদের সহপাঠী জয়ন্তী, রত্না, বুলবুলি, রিমি, লিমা, সাগরিকাসহ ২৫ জন খুদে নারী ফুটবলার। 

জয়ন্তী দিনাজপুর শহরে ঈদগাহ বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। শহরের পুলহাট এলাকায় মা-বাবার সঙ্গে থাকে। টানা ৩ বছর সপ্তাহের ৬ দিন সকালে ফুটবল অনুশীলনে আসে। জয়ন্তীর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল চেহেলগাজী কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী তারামনি। ৫ বছর পূর্বে মাঠে মেয়েদের ফুটবল খেলতে দেখে নিজের বোনকে কোচের কাছে দেন তারামনির ভাই। সেই তারামনি দু'বছর রংপুর সদ্য-পুষ্করিণী যুব সংঘের হয়ে ঢাকায় নারী লিগে খেলে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

একাডেমির কোচ নুর ইসলাম খেলোয়াড়দের কাছে তিনি ‘বেলাল স্যার’ নামে পরিচিত। একসময় তিনি খেলেছেন ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে। ছিলেন জাতীয় দলের স্কোয়াডেও। পায়ের সমস্যায় আর খেলতে পারেননি। 

কিন্তু তিনি ফুটবল ও মাঠ ছাড়তে পারেননি। ১৫ জন মেয়েকে নিয়ে গোর-এ-শহীদ বড় মাঠে ফুটবল অনুশীলন শুরু করেছেন। গড়ে তোলেন নওশীন প্রমিলা ফুটবল একাডেমি।

কোচ নুর ইসলাম জানান, তার একাডেমিতে বর্তমানে নারী খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৩৫ জন। এদের মধ্যে সবাই খেলছেন ঢাকা লিগে। অনূর্ধ্ব-১৪ দলের পাশাপাশি জাতীয় দলেও তার এই একাডেমি থেকে খেলোয়াড়রা সুযোগ পেয়েছেন। 

একাডেমির প্রায় সব খেলোয়াড়ের গল্প প্রায় একই, প্রত্যেকেই দারীদ্রতার সাথে লড়াই করে উঠে এসেছে। 

এক-তৃতীয়াংশ খেলোয়াড় ঈদগাহ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। অধিকাংশেরই দিন কাটে কষ্টের মধ্য দিয়ে। শহরের ঈদগাহ বস্তি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ ফজলুর রহমান কয়েকজন নারী ফুটবলারের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। 

একাডেমির খেলোয়াড় তারামনি নবম শ্রেণিতে পড়াশুনা করছে। তার মা-বাবা দু'জনেই মারা গেছেন। বোনের সংসারে থেকে লেখাপড়ার পাশাপাশি ফুটবল খেলায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।

তার বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক মোঃ জালাল উদ্দীন তার লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছেন।

অনুশীলনের ফাঁকে বাসস’র সাথে কথা হয় তন্বী ও তনিমার। দপ্তরীর কাজ করা মা তাদের খেলাধুলায় উৎসাহ দেন। ঢাকা লিগে দুই বোন ঢাকার উত্তরা ক্লাবের সাথে ফুটবল খেলতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। তনিমা বলে, ‘গত সপ্তাহেও ময়মনসিংহে খেলে এসেছি। খেলে সামান্য যা আয় হয়, মায়ের সংসারে কাজে লাগে। জাতীয় দলে ঢুকতে আমরা দুই বোন কঠোর অনুশীলন করে যাচ্ছি।’

২০২৩ সালে অনূর্ধ্ব-১৫ জাতীয় দলে খেলেছেন সাগরিকা। পরবর্তীতে জাতীয় দলেও খেলার সুযোগ পেয়েছেন এই গোলরক্ষক। সাগরিকা  স্নাতকে পড়াশুনা করছেন। কৃষক বাবার ৬ সন্তানের মধ্যে একমাত্র মেয়ে সাগরিকা। সাগরিকা বলেন, ‘দিনাজপুর নারী ফুটবলারদের জন্য সম্ভাবনাময়ী জেলা। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় খেলোয়াররা মনোবল হারাচ্ছেন। এক জোড়া বুট দিনের পর দিন সেলাই করে খেলছেন মেয়েরা। কিন্তু কারও কোনো সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসতে দেখছিনা।’

কোচ নুর ইসলাম বলেন, খুদে খেলোয়াড়দের নিয়েই সময় কেটে যায় তার। একাডেমিতে তিনি কারও কাছ থেকে পারিশ্রমিক নেন না। মাঠে খেলতে আসা অন্যরা খেলোয়াড়দের খুবই উৎসাহ দেন। মাঝে মধ্যে অনেকে মেয়ে খেলোয়াড়দের টিফিন কিনে দেন। যতটুকু সম্ভব খেলোয়াড়দের জন্য করে যাচ্ছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আরও ভালো খেলোয়াড় বের হয়ে আসবে বলে তার প্রত্যাশা।

দিনাজপুর ফুটবল এসোসিয়েশনের সভাপতি গোলাম নবী দুলাল বলেন, ফুটবলের মানোন্নয়নে তাঁরা বেশ কয়েকবার ক্যাম্পিং করেছেন। এসোসিয়েশন বেশির ভাগ সময় পুরুষদের খেলার আয়োজন করে। নারীদের বিষয়টি জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থা দেখে। কিন্তু এক যুগেরও বেশি সময় কমিটি না থাকায় সংস্থাটি রীতিমতো অকার্যকর হয়ে পড়েছে। 

জেলা প্রশাসক মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার নতুন এ্যাডহক কমিটি গঠন করা হয়েছে। 

এখন ছেলে-মেয়েদের খেলাধুলায় মনোযোগী করতে সহযোগিতা করা হবে। খেলোয়াড়দের মান উন্নয়নে সরকারি পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হবে বলে তিনি আশ্বস্ত করেন।