বাসস
  ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৭:৩৪
আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৭:৩৭

লাল-সবুজের জার্সিতে প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন বুকে লালন করেন মাহিন

ছবি : বাসস

ঢাকা, ১৩ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : নেত্রকোনার জেলা শহরে মগড়া নদীর পারে বেড়ে উঠা ২৬ বছর বয়সী আশফিক মাহিনের স্বপ্ন ধীরে ধীরে নিজেকে জাতীয় দলের জন্য যোগ্য প্রমান করা। 

জেলা শহর সাতপাই চক্ষু হাসপাতাল এলাকার এস এম মহসীন আলম এবং মুরিদা রহমান দম্পতির সন্তান আশফিকের ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট খেলা ভালো লাগতো। বাসার আশেপাশে চাচাতো, ফুপাতো ভাইয়েরা যখন ক্রিকেট খেলতো, ছোট্ট মাহিন তখন অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতো।

ক্রিকেটের প্রতি মাহিনের এ আগ্রহ চোখে পরে মাহিনের ছোট ফুপু আলপনা বেগমের, যাকে সে পাপ্পা বলে ডাকে। পাপ্পা তাকে প্রথম একটি ব্যাট কিনে দেন। সেই ব্যাট দিয়েই শুরু হয় তার ক্রিকেট খেলার যাত্রা। 

বাসার উঠানে পাপ্পা বল করতেন আর মাহিন ব্যাটিং করতেন। বাসার পাশে খেলার মাঠে যখন বড়দের সাথে সেই ব্যাট দিয়ে প্রথম রান করেন তখন খুশিতে আত্মহারা হয়ে বাসায় এসে বাবার সাথে তা আনন্দে প্রকাশ করেন।

পাড়ার ছেলেদের সাথে ফুটবল, ক্রিকেট, কাবাডি, ব্যাডমিন্টন খেলতেন মাহিন, তবে বেশি খেলা হতো ক্রিকেট। 

মাহিন ক্রিকেট খেলা ভালোভাবে বুঝতে  শুরু করেন ২০০৭ ক্রিকেট বিশ্বকাপের সময়। আশরাফুল, মাশরাফির খেলা ছোটবেলা থেকে দেখে বড় হয়েছেন। আর তামিম, সাকিব, মুশফিকের বিশ্বকাপে অভিষেক হওয়ার বিষয়টি তাকে আরো বেশি অনুপ্রাণিত করেছে ক্রিকেটের প্রতি। মনেমনে স্বপ্ন দেখতেন আর বলতেন একদিন আমিও যদি তাদের মতো খেলতে পারতাম! 

জেলা শহর নেত্রকোনায় ক্রিকেট খেলার সুযোগ-সুবিধা, একাডেমি না থাকায় নিজে নিজেই শুরু করেন তার প্রস্তুতি। জেলা শহরের মধুমাছি কচিকাঁচা বিদ্যানিকেতনের মাঠে জাতীয় দলের খেলোয়াড় আবু হায়দার রনি, পিণাক ঘোষ, ফুফাতো ভাই সাইফসহ কয়েকজন মিলে অনুশীলন করতেন। কিন্তু বয়সে ছোট হওয়ায় বাসা থেকে গিয়ে ওখানে গিয়ে অনুশীলন করার সাহস পেতেন না। 

আদর্শ শিশু বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে ভর্তি হন জেলা শহরের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়য়ের পাশেই ঐতিহাসিক মোক্তারপাড়া মাঠ, সেই মাঠেই  নিজেকে গড়ে তুলতে শুরু করেন। জেএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পরই প্রথমবারের মতো ক্রিকেট বল দিয়ে খেলা শুরু করেন।

জেলা স্টেডিয়ামে স্বজল নামে একজন কোচের অধীনে খেলা শুরু করেন যিনি জাতীয় দলের খেলোয়াড় আবু হায়দার রনিরও কোচ।

শুরুতে মাহিন পেস বোলার এবং ব্যাটার ছিলেন, অনুশীলন শুরু করার কয়েকদিন পরেই ২০১০ সালের দিকে জেলা পর্যায়ে অনূর্ধ্ব-১৬ ক্রিকেট দলের ট্রায়াল শুরু হয়। মাহিন ট্রায়ালে অংশগ্রহণ করে ৩০ সদস্যদের দলে নির্বাচিত হয়ে যান। 

মাহিন একটি অনুশীলন ম্যাচে উইকেটরক্ষক-ব্যাটার হিসেবে সুযোগ পান। পারফরমেন্স ভালো হওয়ায় মাহিনের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ঐ বছর জামালপুরে জেলা দলের হয়ে ভালো পারফরমেন্স করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিভাগীয় উত্তরাঞ্চলের টিমে অনূর্ধ্ব-১৬ দলে নির্বাচিত হন। মাহিন প্রথমবারের মত ক্যাম্পে ডাক পান, যেখানে ৬০ জন ক্রিকেটার ছিল।

২০১২ সালের তিনদিনের  ক্যাম্প শেষে তিনি ২০ জনের স্কিল ক্যাম্পে সুযোগ পান। সেখান থেকে ঢাকা বিভাগের উত্তরাঞ্চলের ১৪ সদস্যের মূল দলে ডাক পান।

ঢাকা বিভাগীয় দলের সাথে তার প্রথম খেলার সুযোগ হয় সিলেটের লাক্কাতুরা স্টেডিয়ামে। কিন্তু বৃষ্টি থাকায় সেবার খেলা হয়নি।

তারপর আর পেছনো তাকাতে হয়নি মাহিনকে। নেত্রকোনা থেকে বিভাগীয় দলে প্রতিবছরই অনুর্ধ্ব-১৬, ১৮ দলে খেলার সুযোগ পেতেন। 

এসএস সি পরীক্ষা শেষ করে ২০১৫ সালে চলে আসেন ময়মনসিংহে, সেখানে ভর্তি হলেন আলমগীর মনসুর মিন্টু মেমোরিয়াল কলেজে। খালার বাসাায় পড়াশুনা করতেন। সেখানে সার্কিট হাউজের মাঠে ব্রাদার্স ক্রিকেট কোচিং এ  ভর্তি হন। এই মাঠ থেকেই উঠে এসেছে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের মত তারকারা।
মাঠে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের নেট অনুশীলন দেখতেন আর স্বপ্ন দেখতেন জাতীয় দলের হয়ে খেলার। তার একাডেমিতেই খেলতেন আরেক জাতীয় দলের খেলোয়াড় শুভাগত হোম চৌধুরী। মাহিন প্রায় ৭ বছর ঐ একাডেমিতে অনুশীলন করেন।

দেড় বছর অনুশীলন করার পর ঐ ক্রিকেট একাডেমির কোচ জাকির তাকে প্রথমবারের মতো প্রথম বিভাগে খেলার সুযোগ কওে দেন। এক ম্যাচে মাহিন ৪৮ রান করেন এবং দলকে জিতিয়ে ফার্স্ট ডিভিশনের রেলিগেশন রক্ষা করেন।

এরপর ময়মনসিংহ প্রিমিয়ার লিগে খেলার সুযোগ পান মাহিন আল হেলাল ক্লাবে। এই ক্লাবে খেলেছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মোসাদ্দেক, শুভাগত হোম, হান্নান সরকারসহ জাতীয় দলের তারকা খেলোয়াড়রা। 

মাহিনের নেতৃত্বে কলেজ ক্রিকেটে ২০১৭ সালে আলমগীর মনসুর মিন্টু মেমোরিয়াল কলেজে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়। কলেজটি জেলা ও জোনাল পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্বে রানার্স আপ হয়। মিন্টু কলজের ৩৬ বছরের ইতিহাসে এতবড় সাফল্য এর আগে আসেনি।

ময়মনসিংহ জেলা ৪৬ বছরের ইতিহাসে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয় করে। মাহিন সেই দলের সদস্য ছিলেন। 

ঢাকায় দ্বিতীয় বিভাগে ইয়াং পেগাসাসে খেলেছেন। দ্বিতীয় বিভাগে ধানমন্ডি প্রগতি দলের হয়েও তিনি ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পান।

২০২৪ সালে ঢাকা প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে ক্যারিয়ারের সেরা সময় পার করেছেন। ২ টা সেঞ্চুরি, ৩ টি হাফসেঞ্চুরিসহ মোট ৬১৯ রান সংগ্রহ করেন। মাহিনের সতীর্থ তানজিদ তামিম, শামিম পাটোয়ারী, আকবর আলীসহ অনেকেই বর্তমানে জাতীয় দলে খেলছেন।

ব্রেন্ডন ম্যাককালাম, এ্যাডাম গিলক্রিস্ট, বিরাট কোহলি আছেন পছন্দের ক্রিকেট খেলোয়াড়ের তালিকায়। বর্তমানে শুভমান গিল তার অন্যতম পছন্দের ক্রিকেটার।

আশফিক মাহিনের মা মুরিদা রহমান বাসসকে জানান," ছোটবেলা থেকেই সে ক্রিকেট খেলতে পছন্দ করতো, পরিবার থেকে সবসময়ই যতটুকু সহযোগিতার দরকার তা সে পেয়েছে এবং নিজ যোগ্যতায় এ পর্যন্ত এসেছে। আমি চাইতাম আমার সন্তান যেন নিজ যোগ্যতায় বড় হয়ে উঠুক এবং ভালো মানুষ হয়ে সুস্থ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকুক।"

মাহিনের পিতা এসএম মহসীন আলম প্রথমে ছেলের ক্রিকেট খেলার আগ্রহকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও যখন বন্ধুরা তাঁর ছেলের অসাধারণ সাফল্যের গল্প করে তখন বেশ গর্ববোধ করেন। মাহিন যেন নিজ যোগ্যতায় বড় হয়ে উঠে সবসময় সেই প্রত্যাশা করেন।

২৬ বছর বয়সী মাহিন বলেন, ‘এ বছর ভালো খেলতে পারলে হয়তো বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে খেলার সুযোগ পাবো এবং সেখানে ভালো করতে পারলো ইনশাল্লাহ জাতীয় দলে খেলতে পারবে। যেকোন ক্রিকেটারের স্বপ্ন থাকে নিজ দেশের জার্সি গায়ে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা। আমিও অবশ্যই তার ব্যতিক্রম নই।’