বাসস
  ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:৫৯

ঠাকুরগাঁওয়ের লামিয়া এখন শামসুন্নাহার হলের ক্রীড়া সম্পাদক

ঠাকুরগাঁও, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ (বাসস) : ঠাকুরগাঁওয়ের প্রত্যন্ত গ্রামের বেড়ে ওঠা মেয়ে হকি ও খো খো খেলোয়াড় লামিয়া আক্তার লিমা নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়।

এবার তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় শামসুন্নাহার হল সংসদের বহিরাঙ্গন ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। তার এই সাফল্যে আনন্দে আত্মহারা মা-বাবা সহ পাড়া-প্রতিবেশিরা। অভিনন্দন আর শুভেচ্ছায় ভাসছেন তার মা-বাবা।

তবে এখানে পৌঁছাতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে লামিয়াকে। দরিদ্র ঘরে বেড়ে ওঠা এই মেয়ের সংগ্রামের গল্পটাও দীর্ঘ। 

লামিয়া ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সালন্দর ইউনিয়নের মধ্যজামুরী পাড়া গ্রামের দিনমজুর দুলাল ইসলাম ও গৃহিণী সুমি বেগম দম্পতির মেয়ে। চার ভাই-বোনের মধ্যে লামিয়া সবার বড়। মেজো বোন লিজা আক্তার বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি), আরেক বোন খুশি আক্তার এবার সালান্দর উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী ও ছোট ভাই সেকেন্দার বাদশা স্থানীয় এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে।

লামিয়া ২০১৯ সালে সালন্দর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০২১ সালে এইচএসসি পাশ করে ঠাকুরগাঁও সরকারি মহিলা কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হন। সেখানে এক বছর পড়ার পর খেলোয়াড় কোটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হয়। দারিদ্র্য ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। এবার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্যানেল থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় বহিরাঙ্গন ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন।

কোচ আবু ইয়াসিন মো. মাসুদ রানার হাত ধরে লামিয়ার হকি খেলায় হাতেখড়ি। সালন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক ও প্রশিক্ষক তিনি। কোচ মাসুদ রানার হাত ধরেই ক্রীড়াঙ্গনে উঠে আসা লামিয়ার। ছোটবেলা থেকেই খেলার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ছিল। জেলাভিত্তিক খেলা দিয়ে তার যাত্রা শুরু। 

এরপর বিভাগীয় পর্যায়েও খেলেছেন বেশ কয়েকবার। চার ভাইবোনের সবার বড় লামিয়া। তাই দায়িত্বও একটু বেশি। দিনমজুর বাবাও মেয়ের স্বপ্ন পূরণে পরিশ্রম করে চলেছেন রাত-দিন। লামিয়া শুধু হকি খেলায় নয়, খো খো খেলোয়াড় হিসেবেও বেশ খ্যাতি কুড়িয়েছেন জাতীয় পর্যায়ে। তবে পাসপোর্ট জটিলতায় ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় খেলতে পারেননি।

লামিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছোট জীর্ণ একটি পাকা ঘর। একটি কক্ষে তিন বোনকে খুব কষ্ট করে থাকতে হয়। আর পাশে আরেকটি ঘর রয়েছে সেখানে তার মা-বাবা ও ছোট ভাই থাকে। বেড়ার টিন, কাঠের ভাঙ্গাচোরা দরজা ও জানালা নেই বলা যায়, যা আছে তা একেবারেই  জরাজীর্ণ। বৃষ্টির পানি ঠেকাতে টিনের চালের নিচে পলিথিন টাঙ্গানো হয়েছে।

এসব ঘরে কষ্ট করেই থাকছে লামিয়ার পরিবার। তবে ইতোমধ্যেই একটি নতুন বাড়ি তৈরী করেছেন লামিয়ার বাবা দুলাল ইসলাম। কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে উঠবে লামিয়ার পরিবার

তবে লামিয়ার এই অর্জনে খুশি পাড়া প্রতিবেশিরা। তারা জানান, লামিয়া জীবনে অনেক কষ্ট করেছে। 

আমাদের ভাবতেই অবাক লাগে আমাদের পাড়ার মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। এটা সত্যিই আমাদের জন্য গর্বের। অন্যনের জমি চাষাবাদ করে খায়, আর তার বাবা মাঝে মধ্যে কুলির কাজ করে। এ দিয়েই তাদের ৬ সদস্যের সংসার চলে। তবে মেয়ে খুবই মেধাবী। সেও অনেক কষ্ট করেছে। বলা যায় নিজের একান্ত চেষ্টায় সে এই পথে গেছে। লামিয়ার জন্য শুধু তারা মা-বাব নয়, আমরাও গর্বিত। তাকে দেখে অনেক কিছু শেখার আছে।

হকি খেলোয়াড় মনি বলেন, নিঃসন্দেহে এটা খুশির খবর। লামিয়া ডাকসু নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছে। সে পড়াশোনা ও খেলাধুলায় অনেক মেধাবী। আমরা দুইজনেই এক সঙ্গে খেলতে যেতাম। তারা অনেক দরিদ্র। 

তার বাবা দিনমজুরীর কাজ করে তার পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। 

লামিয়ার মা-বাবা বলেন, আমরা খুশি। অনেক কষ্ট করে মেয়েকে পড়াশোনা করিয়েছি। মেয়ে আজ আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে। সবাই এখন ফোন করে অভিনন্দন জানায়। আমাদের কষ্ট সার্থক হয়েছে।

লামিয়া আক্তার লিমা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের শিক্ষার্থীরা আমাকে এই হলের বহিরাঙ্গন ক্রীড়া সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়ে সম্মানিত করেছেন। আমি এই সম্মানকে একটা গুরু দায়িত্ব ভেবে গঠনমুলক কাজ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে সমৃদ্ধ করার কাজকে সবার সহায়তায় এগিয়ে নিতে চাই । শামসুন্নাহার হলের ক্রীড়াঙ্গনে স্বচ্ছতার সাথে কাজ করার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ আমি। সেই সাথে জেলা ও দেশের নারীদের ক্রীড়াঙ্গনে বৈষম্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বদা সচেষ্ট থাকব। এ ক্ষেত্রে আমি চাই আমার হলে দুর্নীতি, দখলদারিত্ব এসবের বিরুদ্ধে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা মুলক ক্রীড়াঙ্গন গড়ে তুলতে।

তিনি আরও বলেন, আমার হাতেখড়ি মুলত সালন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষক আবু ইয়াসিন মো. মাসুদ রানা স্যারের কাছে। ওনার হাত ধরেই আমার খেলার জগতে আসা। স্যারের দোয়া ও ভালোবাসায় আজ আমি এতদূর আসতে পেরেছি।

সালন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষক মাসুদ রানা বাসস কে বলেন, লামিয়াসহ দেশের পিছিয়ে পড়া নারী খেলোয়াড়কে এগিয়ে নেয়ার কাজকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম । মাঠে নিয়ে আসার পরে বিভিন্ন প্রতিকূলতার সৃষ্টি হয়। সব কিছুই আমি মোকাবেলা করেছি। সব চেয়ে বড় জিনিস হলো তাদের আগ্রহ, সময়ানুবর্তিতা ও নিষ্ঠা যা আমাকে অভিভুত করে । তারা যে পরিশ্রমি তার ফল সবাই দেখতে পারছে। আমার বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলে আসছে। 

তিনি আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন খেলার কোটায় মেয়েরা সুযোগ পায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রতিটি পরিবারের মা-বাবাদের আগ্রহ ছিল যেন তাদের সন্তানরা ভালো জায়গায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়। তারা খুবই গরিব ছিল। তাদের আয় রোজগারের পথ সীমিত। তারপরেও তারা সেই সব পথ অতিক্রম করে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। লামিয়া এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শামসুন্নাহার হলের ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছে। এটা আমাদের জন্য গর্বের। আমরা গর্ববোধ করি লামিয়ার জন্য। 

লামিয়ার সাফল্যে নিজের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সালন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মকবুল আলম বাসস কে জানান, লামিয়া ২০১৯ সালে আমাদের স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে। সে অত্যন্ত মেধাবী মেয়ে। 

আমাদের স্কুলের শারীরিক শিক্ষক রানা স্যার তাকে প্রতিনিয়তই খেলাধুলায় প্রশিক্ষণ দিতেন। সে এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। আমরা খুবই খুশি। স্কুলের পক্ষে থেকে তাকে স্বাগত জানাই।