শিরোনাম

।। শফিকুল ইসলাম বেবু ।।
কুড়িগ্রাম, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : উত্তরের সীমান্ত জেলা কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে শীত এখন আর মৌসুমি দুর্ভোগ নয়—এটি ভয়াবহ মানবিক সংকটে রূপ নিয়েছে।
আজ শনিবার রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের তথ্য অনুযায়ী জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমে এসেছে ১১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, বাতাসের আর্দ্রতা ৯৯ শতাংশ। ঘন কুয়াশা ও হিমেল হাওয়ায় জনজীবন কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হচ্ছে নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলের দরিদ্র মানুষজন।
কুড়িগ্রাম জেলায় ছড়িয়ে থাকা ৪৬৯টি চরে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ বসবাস করেন। এদের অধিকাংশই দিনমজুর, জেলে ও কৃষিশ্রমিক। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজের সুযোগ কমে যাওয়ায় অনেকের আয় একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন নদীঘেঁষা চরাঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষ। ফলে খাদ্য, চিকিৎসা ও বস্ত্র—সব দিক থেকেই বেড়েছে অনিশ্চয়তা।
সরেজমিনে চর রাজিবপুর উপজেলা চর উন্নয়ন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোখলেসুর রহমানের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, পুরো উপজেলা ব্রহ্মপুত্র, কালজানি ও জিঞ্জিরাম নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন। এখানে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বসবাস করে, যার মধ্যে ২৯টি চরের মানুষ শীতে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। শীতবস্ত্রের অভাব চরমে।
তিনি বলেন, মোহনগঞ্জ, কোদালকাটি ও চর রাজিবপুর—এই তিনটি ইউনিয়নে স্বাস্থ্যসেবা কার্যত অচল। কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও চিকিৎসক ও ওষুধ পাওয়া যায় না। দ্রুত শীতবস্ত্র ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা না গেলে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে।
কোদালকাটি ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান মাজেদা খাতুনের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, তাঁর ইউনিয়নের মানুষ শীতে চরম কষ্টে আছে। অথচ শীতার্ত মানুষের জন্য তিনি পেয়েছেন মাত্র ২০টি কম্বল। এত কম কম্বল দিয়ে হাজারো মানুষকে সহায়তা করা অসম্ভব বলে তিনি হতাশা প্রকাশ করেন।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর জানান, তাঁর ইউনিয়নে মোট ৩৬ হাজার মানুষের মধ্যে চরাঞ্চলে বসবাস করে প্রায় ১৬ হাজার মানুষ। অথচ শীতবস্ত্র হিসেবে বরাদ্দ এসেছে মাত্র ১০০টি কম্বল।
একই ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড কালির আলগা চরের ইউপি সদস্য হোসেন আলী জানান, তাঁর চরে প্রায় ৩ হাজার মানুষ বসবাস করে। কিন্তু তাঁর ওয়ার্ডে মাত্র চারটি কম্বল বরাদ্দের কথা তিনি শুনেছেন। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য চারটি কম্বল বিতরণ করা একেবারেই অসম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এছাড়া ৮ নম্বর ওয়ার্ড গোয়াইলপুরী চরে ৬টি, ৯ নম্বর ওয়ার্ড ঝুনকার চরে ৭টি এবং ৬ নম্বর ওয়ার্ড পার্বতীপুর চরে ৬টি কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানান চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর।
এদিকে কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. স্বপন কুমার বিশ্বাস বাসসকে জানান, জেলায় ২৯৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ৯ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকেরা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
তবে এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন কুড়িগ্রাম জেলা চর উন্নয়ন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, সিভিল সার্জনের দেওয়া পরিসংখ্যান বাস্তব চিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। চরাঞ্চলের ইউপি সদস্যদের বক্তব্যেই প্রমাণ হয়—স্বাস্থ্যসেবা কার্যত অনুপস্থিত।
যাত্রাপুর ইউনিয়নের ঝুনকাচর ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রায়হান কবির জানান, তাঁর এলাকায় কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও সাধারণ মানুষ চিকিৎসক বা কর্মচারীদের চেনে না।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ওই ক্লিনিকের চিকিৎসক আব্দুল আউয়াল নিয়মিত চিকিৎসা দেন না। শুধু ঝুনকারচর নয়, ভগবতীপুরসহ জেলার অধিকাংশ চরাঞ্চলের ক্লিনিকগুলোতেও কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা নেই বললেই চলে।
অন্যদিকে কুড়িগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুল মতিন জানান, সরকার থেকে ৫৪ লাখ টাকা বরাদ্দে ১৩ হাজার, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে সাড়ে ৭ হাজার, পূর্বের ১ হাজার ৫০০সহ মোট ২২ হাজার কম্বল জেলার ৯ উপজেলায় ৭৩টি ইউনিয়নে বিতরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তিনি আরও জানান, অতিরিক্ত ৮০ হাজার কম্বল বরাদ্দ চেয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পত্র পাঠানো হয়েছে।
তবে চরবাসীর অভিযোগ—সহায়তার পরিসংখ্যান থাকলেও বাস্তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা অতি নগণ্য। দ্রুত ও কার্যকর উদ্যোগ না নিলে কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে শীতজনিত এই সংকট ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে বলে তারা আশংকা করছেন।